বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মহিউদ্দিন খান মোহন
বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক বদরুদ্দিন উমর দেশের জঙ্গি তৎপরতা এবং তা মোকাবেলায় সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে একটি চমৎকার নিবন্ধন লিখেছেন দৈনিক যুগান্তর-এ, যা গত ৩১ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটিতে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা ‘জুতা আবিষ্কার’ এর দুটি পংক্তি উদ্ধৃত করে সরকারের ‘জঙ্গি বিরোধী’ কর্মকা-কে চিত্রিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। জুতা আবিষ্কার কবিতার দু’টি চরণ ‘জগৎ হতে করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর’ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন- ‘দেশে জঙ্গি তৎপরতা নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে পুলিশ ও সমগ্র প্রশাসন এখন যেভাবে তৎপর হয়েছে এবং যেভাবে তারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা মানুষের ঘরে ঘরে হানা দিচ্ছে এর সঙ্গে যে হবু রাজার মন্ত্রীদের দ্বারা ধুলো দূর করার প্রচেষ্টার সাযুজ্য আছে এতে সন্দেহ নেই। কারণ, বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গি তৎপরতা দেখা দিয়েছে লুণ্ঠনজীবী শাসকশ্রেণী ও তাদের সরকারের দ্বারা দেশের সমাজ ভূমিতে চরম এবং অদৃষ্টপূর্ব বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণে। কাজেই চুরি, দুর্নীতি ও সরকারের দ্বারা সৃষ্ট এই বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য যতদিন থাকবে, ততদিন এদেশে ধর্মীয় জঙ্গি তৎপরতাসহ কোনো ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়। উপরন্তু, আন্তর্জাতিক নানা ধরনের জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এই জঙ্গি তৎপরতা দিন দিন উত্তোরোত্তরভাবে আরো বিস্তৃত হবে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।’
শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দিন উমরের সরকারের জঙ্গি দমন কার্যক্রমকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতার সঙ্গে তুলনা করাটা আমার কাছে যথার্থ মনে হচ্ছে। আমার ধারণা, সচেতন ব্যক্তিরাও তাঁর এ তুলনাকে সঠিক বলেই মনে করবেন। কেননা জুতা আবিষ্কার কবিতায় ‘হবু চন্দ্র রাজা’ ধুলার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য তার মন্ত্রীদের উপায় খুঁজে বের করার নির্দেশ দিলে তারা গোটা রাজ্যব্যাপী যে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল এখানে তার বিশদ বর্ণনার প্রয়োজন নেই। ঝাঁট দিয়ে ধুলা দূর করা, চামড়া দিয়ে পথ-ঘাট সব ঢেকে দেয়া, পানি ঢেলে সব রাস্তা কর্দমাক্ত করে তোলা ইত্যাদি সব অভিনব কা- তারা ঘটিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ধুলার কবল থেকে হবু চন্দ্র রাজা কীভাবে মুক্তি পেয়েছিলেন তাও অনেকেরই জানা। মন্ত্রীদের সব প্রচেষ্টা যখন বিফলে গেল তখন এক মুচি এসে হবু চন্দ্র রাজাকে বলল, ‘নিজের চরণ দুটি আগে ঢাকো/ধরণী আর ঢাকতে হবে নাকো।’ এরপর মুচি রাজার পা দুটি চামড়ার জুতো বানিয়ে ঢেকে দিল। তা দেখে মন্ত্রী বলল, ‘এটাতো আমারও ছিল মনে, কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে!’
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ‘জঙ্গি তৎপরতা’। এ সর্বনাশা তৎপরতা যদি এখনই প্রতিহত করা না যায়, তাহলে একদিন তা আমাদের জাতীয় জীবনকে দুবির্ষহ করে তুলবে এবং এই জনপদ পরিণত হবে মৃত্যু উপত্যকায়। এটা আমার কথা নয়। গুলশান এবং শোলাকিয়া ঘটনার পর দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের কাছ থেকেই আমরা এ আশঙ্কার কথা শুনেছি। তাদের সে আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় আছে বলে মনে হয় না। কেননা, যে জঙ্গিবাদের শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে ইতোমধ্যে প্রোথিত হয়েছে, তা যদি এখনই উপড়ে ফেলা না যায়, তাহলে এটা একদিন বিশাল বৃক্ষের রূপ নিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনকে ছেয়ে ফেলতে পারে আর সে আশঙ্কা অমূলক নয়। আর সেজন্য সমাজ চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্ট নাগরিকগণ এ বিষবৃক্ষকে অংকুরেই বিনষ্ট করার ওপর জোর দিচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে বর্তমানে বাস্তব যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে দেশবাসী খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেনÑ এমনটি বলা যাবে না।
একটি দেশে যখন কোনো দুর্যোগ আসে সে প্রাকৃতিকই হোক বা মনুষ্যসৃষ্টই হোক, তা প্রতিহত বা প্রতিরোধ করার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় দেশটির সরকারের ওপর। সরকার যদি সক্ষম হয় পরিস্থিতি একা নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবেলায়, তাহলে তো কথাই নেই। তবে, সমস্যাটি যদি হয় সর্বব্যাপী এবং জাতীয় স্বার্থবিরাধী, তাহলে সেক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে সে দুর্যোগ বা সমস্যা মোকাবেলায় অবতীর্ণ হতে হয় সরকারকে। এক্ষেত্রে সরকারের সুবিধাটা হলো সবাই মিলে সমস্যা নিরসনে মাঠে নামলে তার সাফল্য-ব্যর্থতার দায় একা সরকারের ওপর বর্তায় না। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের জনগণ ধরে নিয়েছিল যে, জঙ্গিবাদের যে ভয়ঙ্কর থাবা আমাদের জাতীয় জীবনের দিকে বিস্তারলাভ করতে শুরু করেছে, তাকে প্রতিহত করতে সরকার সবাইকে নিয়ে মাঠে নামবে। সবারই প্রত্যাশা ছিল যে, অন্তত এ ইস্যুতে দেশে একটি জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠবে। তারা আশান্বিত হয়েছিল এ জন্য যে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জাতীয় এ সংকটে সরকারের সঙ্গে এক সাথে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু ‘জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে’- প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্যের পর দেশবাসীর সে প্রত্যাশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।
সরকার যদি তার শক্তি ও কৌশল দ্বারা উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে সমর্থ হয় তাহলে তো কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। বরং সবারই খুশি হবার কথা এই ভেবে যে, একটি সবল, চৌকস এবং সামর্থবান সরকার আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেশবাসী খুশি হওয়ার মতো সে রকম কোনো আলোর রেখা এখন পর্যন্ত দেখতে পায়নি। জঙ্গি প্রতিরোধে বক্তৃতা-বিবৃতি, কমিটি গঠনের ঘোষণা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দায়ী করা ছাড়া সরকারের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন এখনো দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি। বরং জঙ্গি দমন বা তাদের হামলা প্রতিরোধে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা জনমনে ইতোম্যেধই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
১ জুলাই গুলশানের যে রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে পরবর্তীতে জানা গেল অবৈধভাবে ওটা স্থাপন করা হয়েছিল। এ খবর প্রকাশের পরপরই দেখা গেল রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশন ঘুম থেকে জেগে উঠল। তারা গুলশান-বনানী-বারিধারা এমনকি ধানমন্ডি-বনশ্রী এলাকা থেকে সব দোকান-পাট, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছেদে নেমে পড়ল। গত কয়েক দিনে বেশকিছু স্থাপনা তারা ভেঙেও দিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে, আবাসিক এলাকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোই বোধকরি জঙ্গি উত্থানের প্রধান কারণ। এটা হয়তো ঠিক যে, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করেই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এখন ওই রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার কারণে ওই এলাকার সব রেস্তোরাঁ খাবার দোকান ইত্যাদি সব ভেঙে দিলেই কি জঙ্গি নির্মূল হয়ে যাবে? জঙ্গি তৎপরতার উৎসমূলের অনুসন্ধান না করে, তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে আবাসিক এলাকা রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট ভাঙা আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর কথিত ‘নজরদারি’র তথ্য প্রচার করলেই কি সমস্যা নিরসন হবে?
দেশবাসী উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে যে, পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয়-উপসম্পদকীয়, টিভি টক শো’র আলোচনায় বিশিষ্ট নাগরিকগণ জঙ্গি উত্থান ও এর প্রতিরোধ বিষয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত ও উপায় তুলে ধরছেন, সরকার তা মোটেও আমলে নিচ্ছে না। তারা এখন ‘জঙ্গি তৎপরতার পেছনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মদতের’ কোরাস সমস্বরে গাইতে শুরু করেছে। জঙ্গি তৎপরতার মূল হোতাদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে হাতের কাছের ‘রেডিমেড’ প্রতিপক্ষকেই জঙ্গি তৎপরতার জন্য দায়ী করে সরকার আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার চেষ্টা করছে। এট যে একটি অপরিণামদর্শী চিন্তাপ্রসূত কাজ সেটা না বললেও চলে। কেননা, সরকার যেভাবে জঙ্গি তৎপরতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে চলেছে, তাতে ওই অশুভ তৎপরতার নেপথ্য কারিগররা আপাতত বেশ নিশ্চিন্তে নিরাপদেই আছে। সরকারের আক্রমণের তীর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি অনুশীলনরত রাজনৈতিক দলের দিকে ধাবিত হওয়ায় জঙ্গির হোতারা এখন আরো বেশি সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
জঙ্গি প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত একটি পদক্ষেপও দেশবাসীকে আশান্বিত করতে পারেনি এটা কোনো অতিশয়োক্তি নয়। এমনকি গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে পুলিশের অভিযানে যে নয় জঙ্গি নিহত হলো তা নিয়েও নানা কথা উঠেছে। নয়জন জঙ্গিই পেছন থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলো কেন এ প্রশ্ন সচেতন ব্যক্তিরা তুলেছেন। তাহলে কি ওরা পালাানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছিল? যদি তাই হয় তাহলে পলায়নরত ওই জঙ্গিদের পায়ে গুলি করে আহতাবস্থায় কেন গ্রেফতার করা হলো না? বিরাজমান পরিস্থিতিতে সেটাই হতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জঙ্গিদের জীবিত ধরে ওদের কাছ থেকে এ ভয়ঙ্কর তৎপরতার উৎস ও মূল হোতাদের সন্ধান লাভের চেষ্টাই তো এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। ঠিক এ প্রশ্নটি বিএনপির পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে। আর সেজন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেছেন, ‘নিহত জঙ্গিদের জন্য তাদের এত দরদ কেন?’ অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতেও অপরাধীকে মেরে ফেলার চেয়ে জীবিত ধরার গুরুত্ব অনেক বেশি। এ সত্য কথাটি কেউ বললে তাকে যদি অপরাধীদের মদতদাতা বলে অপবাদ দেয়া হয়, তাহলে বলতেই হয়, দিশেহারা হলে অনেক ধরনের বিভ্রমই ঘটতে পারে!
জঙ্গি দমন করতে গিয়ে সরকার যেসব পদক্ষেপ এ পর্যন্ত নিয়েছে, সেগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ বলে কেউই মনে করছেন না। বরং এক ধরনের আই ওয়াশ এবং তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের একটি চেষ্টা অনেকটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সরকারের কোনো কোনো পদক্ষেপ জনজীবনে ভোগান্তিরও সৃষ্টি করছে। এ প্রসঙ্গে গত ২৯ জুলাই দৈনিক ইনকিলাবের ‘জঙ্গি ইস্যুতে নতুন উপসর্গ’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদনটির উল্লেখ করা যায়। প্রতিবেদনটিতে মেয়েদের হোস্টেল ও মেসে রেখে লেখাপড়া করানোর বিষয়ে অভিভাবকরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন উল্লেখ করে বলা হয়- ‘ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইডেন কলেজে ও কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের হোস্টেল থেকে পর্দানশীন ছাত্রীদের জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতারের পর অভিভাবকদের মধ্যে এই দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের চেয়ারম্যান ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন ‘হিজাব-বোরকা পরলেই ছাত্রীরা চরমপন্থী হবে এমন কোনো কথা নেই।’ একই প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগে বাড্ডায় ফটোকপি করতে যাওয়া হিজাব পরিহিত এক ছাত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। এরও আগে খবর বেরিয়েছিল যে, নোয়াখালীর এক এলাকায় বৈঠক করার সময় ৮/১০ জন নারীকে আটক করে পুলিশ। তারা নাকি জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লক্ষণীয় হলো, এ ধরনের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ বলে যে, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু কথিত সে জিহাদি বইয়ের নমুনা দেশবাসী অদ্যাবধি দেখতে পেয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি।
গুলশান হামলার পর সচেতন ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ওই ঘটনার সঙ্গে বর্হিবিশ্বের কোনো অপশক্তির যোগসাজশ থাকতে পারে। অনেকেই সন্ত্রাসী সংগঠন আইএস-এর সংযোগ থাকার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই বলে আসছে যে, দেশে আইএস নেই। তারা এটাও বলেছেন, গুলশান-শোলাকিয়া ঘটনার মদতদাতারা দেশের ভেতরেই আছে। তাদেরকে অচিরেই খুঁজে বের করা হবে। গত ২৪ জুলাই ডিএমপি কমিশনার গুলশান হামলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘হামলার নেপথ্যে কারা রয়েছে, কীভাবে হামলা হয়েছে, সেসব তথ্য আমরা পেয়েছি। তাদের গ্রেফতার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘গুলশান হামলার তদন্তের এখন পর্যন্ত দেশীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে।’
ডিএমপি কমিশনারের সেদিনের বক্তব্য অনেককেই আশান্বিত করেছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে, হয়তো তদন্তের মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতার নেপথ্য কুশীলবদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে এবং এর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিষয়টিও তুলে ধরা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে শাসক দলের নেতা এবং সরকারের মন্ত্রী, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর এখন আর সত্য উদ্ঘাটনের বিষয়ে কেউ-ই বোধকরি আশাবাদী নন। কেননা, তারা ইতোমধ্যেই কেউ সরাসরি, কেউ ইঙ্গিতে তাবৎ জঙ্গি হামলা ও তৎপরতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে ফেলেছেন। তাদের সে ইঙ্গিত পুলিশ প্রশাসনের জন্য এক ধরনের ‘গাইড লাইন’ বা দিক নির্দেশনা বলে ধরে নেয়া যায়। পুলিশ বা গোয়েন্দারা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের গাইড লাইনের বাইরে গিয়ে ‘সত্য’ উদ্ঘাটন করবে এমনটা আশা না করাই ভালো। বরং সরকারের মন্ত্রী-নেতাদের অঙ্গুলি নির্দেশনা অনুসরণ করতে করতে তারা (পুলিশ) এক সময় জঙ্গি তৎপরতার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন-মদতের তথ্য আবিষ্কার করে ফেলবে! তবে নির্মম বাস্তবতা হলো- তাতে জঙ্গি সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। উল্টো আসল জঙ্গিরা নির্বিঘেœ তাদের তৎপরতা চালানোর একটা অবারিত সুযোগ পাবে।
গুলশান হামলার পর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন এবং বহির্বিশ্ব থেকৈ জঙ্গি সমস্যা নিরসনে সরকারকে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেসব পরামর্শ শোনা তো দূরের কথা, কোনো রকম পাত্তা দিয়েছে বলে মনে হয় না। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব তো প্রথম দফাতেই এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অবজ্ঞা করা হয়েছে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের জাতীয় ঐক্যর তাগিদকেও। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস দমনে বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। গুলশান ঘটনার পর মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। সে সময় তিনি এ প্রস্তাব দেন। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ সে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। ঘটনা পরপর বাংলাদেশে অবস্থানরত কূটনীতিকরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। তারা বলেছিলেন, বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর নয়। ওই সময় ইতালি ও জাপান সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশে সমন্বিত কূটনৈতিক ও যৌথ গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল।
পরিতাপের বিষয় হলো, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী তৎপরতা প্রতিরোধে দেশি-বিদেশি সেসব প্রস্তাবের কোনোটিই সরকার গ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। শুধু একটি ‘অভয় বাণী’র প্রতি সরকার শত ভাগ আস্থা স্থাপন করেছে এটা বোধ করি সবার কাছেই পরিষ্কার ধরা পড়েছে। আর সে অভয় বাণীটি এসেছে প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাশ মোদির কাছ থেকে। গত ২১ জুলাই এক ভিডিও কনফারেন্সে আলাপকালে মি. মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘আপনি একা নন, সমগ্র ভারত আপনার পাশে রয়েছে।’ এ আশ্বাস বাণীর ওপর নির্ভর করেই বোধকরি তারা সন্ত্রাস দমন প্রশ্নে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্ব করেছে। তারা জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে ‘দলীয় ঐক্য’ গড়ার চেষ্টায় রত হয়েছেন। প্রকৃত জঙ্গি এবং তাদের মূল মদতদাতাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা বাদ দিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে জড়ানোর কসরৎ করছেন, যাকে-তাকে জঙ্গি বলে ধরে নেয়া শুরু করেছেন। সরকারের এসব কর্মকা-ের সঙ্গে কবিগুরুর ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় বর্ণিত মন্ত্রীদের কা--কারখানার সঙ্গে যদি কেউ মিল খুঁজে পান, তাহলে কি তা খুব দোষের হবে? জুতা আবিষ্কার কবিতায় তাও তো একজন মুচি পাওয়া গিয়েছিল যে হবু চন্দ্র রাজার পা চামড়া দিয়ে মুড়ে ‘ধুলো সন্ত্রাসে’র আক্রমণ থেকে তাকে নিস্তার দিয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশে কী সেরকম একজন পাওয়া যাবে, যে সমস্যার মূল জায়গটা সরকারকে দেখিয়ে দেবে? আর পাওয়া গেলেও সরকার যে তার বা তাদের সে পরামর্শ কানে তুলবে তারই বা ভরসা কী?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।