দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য আল্লাহ তাআলা জিহ্বা দিয়েছেন। যা আমাদের কথা বলতে এবং মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে। জিহ্বার ব্যবহার ছাড়া কোনো মানুষই কথা বলতে পারে না। জিহ্বা এমন একটি অঙ্গ যা দিয়ে আপনি অনেক নেক অর্জন করতে পারেন।আবার এর অজাচিত ব্যবহারে আপনি বদ নসীবও হতে পারেন। জিহ্বা আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত, আমরা দেখতে পাই, জিহ্বা সব সময়ই ভেজা থাকে। আল্লাহ তাআলা জিহ্বার গোড়া থেকে প্রতিনিয়ত পানি সৃষ্টি করছেন। যখন চুপ থাকি, তখন পানি অল্প পরিমাণে আসে, যখন কথা বলি তখন বেশি আসে। খাওয়া দাওয়ার সময় আরো বেশি আসে। কারণ খাবার গলাধঃকরণের জন্য চিবানোই যথেষ্ট নয়, বরং জিহ্বার পানি দিয়ে ভিজে পিচ্ছিল হতে হয়। আল্লাহ তাআলা জিহ্বার গোড়ায় প্রতিটি লোকমার সঙ্গে পরিমিত পরিমাণে পানিও সৃষ্টি করে দেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আমি কি তার জন্য দুটি চোখ বানাইনি? আর একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট।’ (সুরা : বালাদ,আয়াত : ৮-৯)
হাদিসে পাকে জিহ্বার হেফাজতের ব্যাপারে প্রিয়নবী অনেক উপদেশ প্রদান করেছেন। কারণ এ জিহ্বা অনেক বিপদ ডেকে আনে। এ থেকে উচ্চারিত একটি শব্দই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যেতে পারে মহাপ্রলয়। জগৎজুরে রয়েছে এর অসংখ্য নযীর। তাই জিহ্বাকে সংযত রাখতে রাসূল সা: অসংখ্য হাদীসে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ সাকাফি (রা.) বলেন, একবার আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আমার জন্য যে জিনিসগুলো ভয়ের কারণ বলে আপনি মনে করেন, তার মধ্যে সর্বাধিক ভয়ংকর কোনটি? তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের জিহ্বা ধরলেন এবং বললেন, ‘এটা (অর্থাৎ জিহ্বা)’। (জামে তিরমিজী, হাদিস : ২৫৬৬)
আরেক হাদীসে জিহ্বাকে বাহুল্যবর্জিত রাখার ব্যপারে রাসূল সা: সূসংবাদ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিসের (জিহ্বা বা বাকশক্তি) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিসের (লজ্জাস্থান) নিশ্চয়তা দিতে পারবে, আমি তার জন্য বেহেশতের জামিনদার হতে পারি।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৮৮৪) জিহ্বার অসংযত ব্যবহারের কারণেই আজ স্বামী-স্ত্রী, মানুষে-মানুষে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে অশান্তি বিরাজ করছে।
গীবত,পরনিন্দা,অশ্লিল ও অযাচিত কথা বলা এবং মিথ্যা বলা এই সবগুলো হচ্ছে জিহ্বার অপকর্ম। তাই যে ব্যক্তি নিজের জিহ্বাকে সংযত রাখতে সক্ষম হবে সে অনেক অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন আমরা যা কিছু উচ্চারণ করি সবি লিপিবদ্ব হয়। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে। (সূরা ক্বাফ:১৮)
আমরা অনেক সময় অসতর্কতা বসত এমন কথা বলে ফেলি যা আল্লাহর নিকট অনেক ঘৃণিত। এক হাদীসে এসেছে আবু হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ নিশ্চয় বান্দা কখনও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির কোন কথা বলে অথচ সে কথা সম্পর্কে তার চেতনা নেই। কিন্তু এ কথার দ্বারা আল্লাহ্ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আবার বান্দা কখনও আল্লাহ্র অসন্তুষ্টির কথা বলে ফেলে যার পরিণতি সম্পর্কে তার ধারণা নেই, অথচ সে কথার কারণে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। (সহীহ বুখারী,হাদীস :৬৪৭৮)
জিহ্বার কারণে অনেক মানুষ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে তাই শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মানুষ সকালে ঘুম হতে উঠার সময় তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনীতভাবে জিহবাকে বলে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা›আলা কে ভয় কর। আমরা তো তোমার সাথে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সোজা পথে দৃঢ় থাক তাহলে আমরাও দৃঢ় থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য।(জামে তিরমিজী,হাদীস: ২৪০৭)
বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্তার কাজ কথা বলার আগে ভেবে দেখা, এ কথাটি আমার জন্য ফলপ্রসূ কিনা ? যদি ভালো হয়ে থাকে তাহলে তা বলবো অন্যথায় তা থেকে বিরত থাকব। প্রাথমিক দৃষ্টিতে বিষয়টি অনেকের জন্য কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু কিছুদিন নিজেকে এভাবে অভ্যস্ত করে নিলে আপনার মুখ আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। সর্বদা মুখের ভালো মন্দ বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করলে পরকালের ভয় আপনাকে অযাচিত কথা থেকে বিরত রাখবে।
হযরত আলী রা: বলেন: যদি শরীরের কোন অঙ্গে বিষ থাকে তাহলে তা হচ্ছে বাকযন্ত্রে।(কাওয়ায়েদুন নবওয়্যিাহ:২৯৯)
সত্যিই জিহ্বার বিষ এতটাই বিষাক্ত সে সবকিছু মূহুর্তেই তছনছ করে দিতে সক্ষম। জিহ্বা বিভিন্ন অনিষ্টের মূল। জিহ্বা ব্যবহার করে স্বার্থবাদী মানুষেরা কথায় ভুলিয়ে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু হাসিল করে নিতে পারে। অন্যকে বন্ধু বানাতে সক্ষম হয়। আবার কথাতেই মানুষ অনেক কিছু হারায় এবং অন্যকে জীবনের পরম শত্রু বানিয়ে ছাড়ে।
এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান আনে সে যেন উত্তম কথা বলে কিংবা চুপ থাকে। (সহিহ বোখারি, হাদিস নং: ১০২) চুপ থাকাটাই অধিক নিরাপদ। যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়। আর যে যত বেশী কথা বলবে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তার তত বেশী। হযরত ওমর রা: বলেন: যে বেশী কথা বলে তাঁর ভুল বেশী হয়।
অন্য এক হাদীসে রাসূল সা: বলেন অধিকাংস মানুষ জাহান্নামে যাবে তার কথার কারণে। তিনি আরো বললেনঃ আমি কি এসব কিছুর সার সম্পর্কে তোমাকে বলব না? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহ্র রাসূল! তিনি তাঁর জিহ্বা ধরে বললেনঃ এটা সংযত রাখ। আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহ্র নাবী! আমরা যে কথা-বার্তা বলি এগুলো সম্পর্কেও কি পাকড়াও করা (জবাবদিহি) হবে? তিনি বললেন: হে মু‘আয! তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক! মানুষকে শুধুমাত্র জিহ্বার উপার্জনের কারণেই অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।(জামে তিরমিজী:২৬১৬)
জিহ্বা হচ্ছে মুখের প্রহরী সে ভালো মন্দ যাচাই করার পর তা গলদ:করণ করা হয়। যে ঘরের প্রহরী অসুস্থ হয়ে যায় সে ঘরের লেকজন নিরাপত্তাহীন থাকে। তেমনি জিহ্বা যদি অসুস্থ হয়ে যায় তাহলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিরাপদ নয়। হযরত আলী রা: বলেন: জিহ্বা হচ্ছে শরীরের স্থিতি যখন জিহ্বা ঠিক হয়ে যায়, আর যখন জিহ্বা বিশ্রঙ্খল হয়ে যায় তার অঙ্গ প্রতঙ্গ ঠিক থাকেনা। হযরত তাউস রহ: বলেন জিহ্বা হচ্ছে হিংস্র প্রাণীর ন্যায়, তাকে ছেড়ে দিলে সে আমাকে খেয়ে ফেলবে। (কাওয়ায়েদুন নবওয়্যিাহ:৩০০)
অনেকে হয়ত মনে করতে পারেন বাক স্বাধীনতা সবার মৌলিক অধিকার। যচ্ছে তাই বলব। অথচ তার এই বাক-শক্তির অপব্যবহার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে। অনাকাঙ্খিত অনেক কিছু ঘটতে পারে জিহ্বার উলট-পালট ব্যবহার। এ জন্য ইসলাম এ বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব প্রদান করেছে। কথা বলার ক্ষেত্রে সাবধনতা অবলম্বন করার নির্দেশ প্রদান করেছে। তাই চলুন রাসূলের আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের জীবনকে রাঙ্গিয়ে তুলি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওফিক দান করুন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর ঢাকা-১২৩০
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।