দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
গত ১২জুলাই (রবিবার) অন-লাইনের খবর অনুযায়ী, আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী (দুবাগী ছাব) ১০ জুলাই (শুক্রবার) জুমার পূর্বে লন্ডন উইপসক্রস হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর নামাজে জানাজা গত রবিবার (১২ জুলাই) বাদ যোহর লন্ডন ব্রিক লেন জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় ।
বিলাতে ইসলাম প্রচারকারী এ মহান সাধকের ইন্তেকালের শোকাবহ খবরে দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্তদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে। আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত ও বেহেশতে উচ্চ আসন কামনা করি এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবার বর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। মুসলিম উম্মার এ কঠিন দু:সময়ে আল্লামা দুবাগী সাহেবের দুনিয়া ছেড়ে না ফেরার স্থানে চলে যাওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক খবর।
আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী (দুবাগী ছাব ) ১৯২৯ সালের ২ফেব্রুয়ারী সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার থানার অন্তর্গত এবং দুবাগ ইউনিয়নের দুবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আফতাব আলী চৌধুরী। তাঁর ছোট চাচা আকবর আলী ছিলেন একজন মজযুব দরবেশ। মজযুব দাদা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, আমার এ নাতি ইনশাআল্লাহ একজন কামিল ওয়ালিয়ল্লিাহ হবে। বাস্তবে তিনি তাই হয়েছিলেন। আল্লামা দুবাগী সাহেব বাল্যকালে মাতৃহারা হয়ে যান। তিনিও ছিলেন একজন জ্ঞানী ওয়ালিয়াতুল্লাহ। মুজাহিদ উদ্দীন সাহেব বাল্যকালে একবার কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর মাতা পুত্রের আরোগ্যের জন্য একগলা পানিতে নেমে দোয়া করেছিলেন। পুত্র আরোগ্য লাভ করেন এবং মাতা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।
মুজাহিদ উদ্দীন প্রাথমিক শিক্ষা হয় বিশুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে। অত:পর চার বছর ব্যাপী মক্কা মোয়াজ্জামায় অবস্থানকারী পঞ্চখন্ড কোনা গ্রাম নিবাসী হযরত কারী বশির উদ্দীন এর কারিয়ানা মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং তাঁর কাছ থেকে বিখ্যাত সাত কেরাতের সনদ লাভ করেন। এরপর তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে নিজ গ্রামের মাদ্রাসায় কেরাত শিক্ষা শুরু করেন।
মুজাহিদ উদ্দীন ছিলেন অসাধারন মেধাবী এবং তাঁর কন্ঠস্বর ছিল সুমধুর । তাঁর তেলাওয়াত ও আযান শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ ও মোহিত হতো। তাঁর বদৌলতে হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা কোরাআন শরীফ ও তাজবীদ সহ শিক্ষা করে নির্ভরযোগ্য কারী হয়েছেন এবং অসংখ্য লোক শুদ্ধ করে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা শিখেছেন। এরপর ইলমে কেরাতের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষালাভ করেন। তিনি ৬ থেকে ১০ বছরের এ কোর্সটি মাত্র ৩বছরে শেষ করেন।
ইলমে কেরাত শিক্ষাকালে মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক জামাতগুলো ও একই সাথে অতিক্রম করতে থাকেন। খুবই কৃত্বিতের স্বাক্ষর রাখেন এবং কোনা গ্রামে আলিয়া মাদ্রাসা হতে তিনি আলিম পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার পর ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী জামেউল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা হতে আলিম পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম হন।পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতেও তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল সর্ব্বোচ্চ। তিনি আরবী, ফারসি এবং উর্দু ভাষায় যেমন ছিলেন পারদর্শি তেমনি তার এসব ভাষায় হস্তলিপিও ছিল অতি সুন্দর ও চমৎকার। তিনি গাছবাড়ি আলিয়া মাদ্রাসায় দীর্ঘ ৮বছর অধ্যয়ন করেন । দেশের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা মুশাহেদ এবং বিশিষ্ট হযরত ফুলতলী সাহেব কেবলা ও ছিলেন তাঁর ওস্তাদ। তাঁরা তাঁকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং তাদের বিভিন্ন জনসভায় নিয়ে যেতেন এবং তাঁকে দিয়েই কোরআন তেলাওয়াত করাতেন।তিনি কামেলমুহাদ্দিস সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা হতে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন
আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী শিক্ষা সমাপ্ত করার পর শিক্ষকতার পবিত্র পেশায় নিয়োজিত হন এবং সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসায় অধ্যাপনা শুরু করেন। বিভিন্ন আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস ও মুফতী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশের হাজার হাজার ছাত্র তাঁর নিকট বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন । সিলেটের বিভিন্ন মাদ্রাসায় তাঁর অধ্যাপনা জীবন প্রায় ১৬/১৭ বছর। ১৯৬৭ সালে প্রথম তিনি পবিত্র হজ্জ্ব উপলক্ষে হারামাইন শরীফাইন যিয়ারত করেন। সিলেটে ইসলামী শিক্ষার প্রসার এবং বিশুদ্ধ কেরাত শিক্ষাদানে তাঁর ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ।
আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী বিলাতের (লন্ডন) গমনের কাহিনীও খুব তাৎপর্যপূর্ণ । তখনকার দিনে বৃটেনের লেষ্টারে বাংলাদেশী লোকের কোন স্মৃতি নিদর্শন ছিল না। তাদের স্বতন্ত্র কোন মসজিদও ছিল না।সুতরাং ইংল্যান্ড বাসীদের প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৭৮ সালের ১জানুয়ারী তিনি লেষ্টার শহরে গমন করেন।কথিত আছে যে, সেখানে অবস্থানকারী সিলেটের মুসলমানগণ ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হওয়ায় সেখানে কোন মসজিদ না থাকায় দুশ্চিন্তায় ভোগছিলেন এবং ইসলামের রীতিনীতি তথা অনুশাসন ও ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষার অভাব অনুভব করায় তাদের একান্ত ইচ্ছা ছিল , কোন ধর্মীয় আলেম যদি তাদের মধ্যে থাকতেন তাহলে তাদের বিশেষ উপকার হতো । তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লামা দুবাগী সাহেবের ভক্ত -অনুরক্ত ছিলেন এবং তাকে ভালভাবে চিনতেন, তাঁর কাছে তারা সংবাদ প্রেরণ করেন কিংবা পত্র লিখে তাঁকে লন্ডনে আসার জন্য অনুরোধ জানান।আল্লাম মুজাহিদ সাহেব এ আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে যাওয়ার জন্য মনস্থ করেন এবং প্রস্তুতি গ্রহন করে সেখানে চলে যান ।
তিনি ব্রিটেনের লেষ্টার শহরে গমন করেন, সেখানে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশী মুসলমানগণ দারুনভাবে আনন্দিত হনএবং তাকে সাদরে গ্রহণ করেন । কেননা তাঁর যোগ্যতা , দক্ষতা , প্রতিভা এবং ওয়াজ-বয়ান সর্ম্পকে তারা প্রথম থেকেই অবহিত ছিলেন এবং তাঁর অবস্থানের জন্য যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন। তিনি বাংলাদেশী মুসলমানগণকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে থাকেন ।ফলে প্রথমেই সেখানে মসজিদ , মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার পরিকলপনা গ্রহণ করেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সকলের সাহায্য সহযোগীতায় লেষ্টারে প্রথম একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি ইমাম হিসেবে নামাজ পড়ানো শুরু করেন। এ মসজিদের প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু থেকে পূর্ণতা লাভ করার পর্যন্ত আল্লামা দুবাগী সাহেবকে কঠোর-অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল। প্রায় সভা সমাবেশের শেষভাগে মসজিদের উন্নতিকল্পে তিনি উপস্থিত জনতার নিকট মুক্তহস্তে দান করার জন্য চাঁদার ওয়াজ করতেন। তাতে হাজার হাজার পাউন্ড সংগ্রহ হতো। তাছাড়া তিনি নিজে একজন ইমাম হওয়া সত্তে¡ও স্বীয় শহর ছাড়াও বিলাতের বিভিন্ন শহরে গিয়ে লোকের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং চাঁদা সংগ্রহ করতেন। মসজিদ প্রতিষ্ঠা লগ্ন হতে এই মসজিদেই তিনি মাদ্রাসা শুরু করেছেন। বহু ছাত্র-ছাত্রী তাঁর নিকট অধ্যয়ন করে সুযোগ্য কারী হয়েছেন।
আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন দুবাগী টানা ১৭বছর পর্যন্ত এ মসজিদের ইমামতি করে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি জনসেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি লেষ্টার শহরে সর্বপ্রথম ‘আঞ্জুমান আল-ইসলাহ’ সংগঠনের বুনিয়াদ স্থাপন করেন। তিনি আরো কয়েকটি সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিলাতে গমনের পর থেকে মুফতী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তরীকত পন্থীদের তালিমের জন্য তিনি বিলেতে বিভিন্ন শহরে খানকাহ স্থাপনের ব্যবস্থা করেন।একই সাথে তিনি লেখনীর মাধ্যমেও তা অব্যহত রাখেন এবং মাছআলা মাছাইল সমূহ লিফলেট আকারে জনগনের কাছে তুলে ধরেন।এ সর্ম্পকে তাঁর আরো একটি গুরুত্তপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে তিনি সুন্নী মুসলমান ভাই-বোনদেরকে ভ্রান্ত মতবাদ হতে নিরাপদ করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেন। তাছাড়া মুসলিম পর্ব -দিবসগুলো যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদার সাথে উদযাপনে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সেগুলোর ফযীলত তাৎপর্য লিফলেট আকারে সর্বত্র ছড়িয়ে দেন। বিলাতে তাঁর এরূপ কর্ম-তৎপরতার সূদুরপ্রসারী প্রভাব দেখা দেয় ।
মানবতার সেবা আল্লামা সাহেবের কেবল বিলাতে সীমাবদ্ধতা ছিল না । স্বদেশে ও তার প্রতিফলন ছিল। যখনই বাংলাদেশে কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিয়েছে তিনি তখন চাঁদা সংগ্রহ করে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে দূর্গতদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছেন। তাছাড়া বসনিয়া, কাশ্মীর, আফগানিস্তান, ফিলিস্তীনি প্রভৃতি দেশের মজলুম মুসলমানদের জন্যও অনুরূপভাবে সাহায্য প্রেরণ করেছেন।
আল্লামা দুবাগী সাহেব তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে ব্যাপক সফর অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিলেন। তিনি বহুবার পবিত্র হজ্জ্ব এবং হারামাইন শরীফাইন যিয়ারত ছাড়াও অসংখ্য দেশ ভ্রমন করেছেন।
আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন (রহঃ) আরবী, উর্দু এবং বাংলা ভাষায় বহু পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন যার সংখ্যা দুই ডজনের কম হবে না। ইসলামের নানাদিকের ওপর তিনি তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও রয়েছে এবং তাতে কিছু জীবনীও রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৭ সালে মরহুম মাওলানা এম.এ.মান্নান এর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে ইনকিলাবের বিশেষসংখ্যায় দুবাগী সাহেব রচিত একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধের উপসংহার টানতে চাই। তাতে একস্থানে তিনি বলেনঃ
প্রখ্যাত আলেম, মোহাক্কেক মাওলানা আব্দুল মান্নান (রহঃ) কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত বহুসংখ্যক মসজিদ-মাদ্রাসা এবং দৈনিক ইনকিলাব ইসলামী অঙ্গনে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে.......... ।
রচনার শেষদিকে বলা হয় ঃ ‘মাওলানা আব্দুল মান্নান (রহঃ) এর আজীবনের স্বপ্ন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বর্তমান সরকারের অবিস্মরনীয় কীর্তি, যা জমিয়তের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক বাহাউদ্দিন সাহেবের আপ্রাণ চেষ্টার ফল ।’
লেখক : ধর্মতত্ত্ববিদ, গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।