পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মামলাবাজ চক্রের দায়ের করা অপ্রয়োজনীয় মামলায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আদালতকে। এই চক্র বিশেষ উদ্দেশে বছরের পর বছর মামলা টেনে নেয়। অন্যদিকে যাদেরকে আসামি করা হয় যুগ যুগ ধরে তারা টানেন মামলার ঘানি। আদালতের বারান্দায় ছুটোছুটিতে বিক্রি করেন সহায়সম্বল। মাঝখান থেকে পকেট ভারী হয় আইনজীবী এবং সহায়ক কর্মচারীর। ন্যায় বিচার লাভ কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই যেন মামলার মূল উদ্দেশ্য নয়।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়াই যেন মূল লক্ষ্য। আইনের শাসনের প্রতি বুড়ো আঙুল প্রদর্শনকারী মানুষের ব্যক্তিগত রেষারেষি, বৈরিতা, শত্রুভাবাপন্ন প্রবণতার মাঝখানে পড়ে বিচার বিভাগের এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। বিচারকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে মামলা নিয়ে। বিচারক, জনবল ও আদালত বাড়িয়েও কমছে না এমন অপ্রযোজনীয় মামলাজট। এক মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে একাধিক মামলা। এসব মামলা নিয়েই বছরের পর বছর ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আদালতকে।
অপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বহীন মামলার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃত মামলার বিচার। অনিয়ন্ত্রিত মামলা-প্রবাহের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় মামলার বিচারের দাবি। সরকারকে বহন করতে হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয় ভার। বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বিচার বিভাগ, মামলা সংস্কৃতি, দুর্ভোগ ও বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। মানুষের মধ্যে মামলা করা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে জট। কেন মানুষ মামলা প্রবণ হয়ে উঠছে, কারণটির গভীরে সরকারকে হাত দিতে হবে। বিষয়টি মনস্তাত্তি¡ক নাকি বাস্তবিক কোনো সঙ্কট থেকে ভেবে দেখা দরকার।
আইনজ্ঞদের মতে, সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় নিতে পারেন যেকোনো নাগরিক। আর এই অনুচ্ছেদটির দায়িত্বহীন চর্চাই বাড়িয়ে তুলছে ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘উদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘মিথ্যা মামলা’র সংখ্যা। ফৌজদারি কার্যবিধিতে এক সময় মামলা রেকর্ডের আগে যাচাই-বাছাইয়ের বিধান ছিলো। পরে তা বাতিল করে দেয়া হয়। এখন যেকোনো ব্যক্তি যে কারো বিরুদ্ধে ঠুকে দিচ্ছে মামলা।
এ ক্ষেত্রে মামলাকারীকে মামলা নিবন্ধনকারীর অধিকার রয়েছে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করার। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মামলা রেকর্ড করার। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণও রয়েছে এ বিষয়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটি প্রতিপালিত হয় না। পুলিশ প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাবের কারণে মামলা রেকর্ডকারী পুলিশ কর্মকর্তা মামলাকারীকে সেই প্রশ্ন করেন না। প্রাথমিক অনুসন্ধান ছাড়াই দায়ের হচ্ছে মামলা।
মিথ্যা ও দুর্বল প্রেক্ষাপটে দায়ের করা এসব মামলার পেছনেই ছুটতে হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনকে। পুলিশি হয়রানি ও গ্রেফতারের ভয়ে ঘরে থাকতে পারেন না আসামি। জামিনের জন্য আসামিকে রাতদিন পড়ে থাকতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। গুরত্বপূর্ণ সব মামলা রেখে বিচারককে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে মিথ্যা, ভুয়া এবং গুরুত্বহীন ব্যক্তিগত মামলার আসামির জামিন শুনানি নিয়ে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, দেশের আদালতে এখন ৩৭ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। ক্রমবর্ধিষ্ণু এ সংখ্যার লাগাম টেনে ধরা না গেলে ২০২২ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ লাখে। মামলাকে উপজীব্য করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই বিশেষ পেশাদার জনগোষ্ঠির জন্য এ সংখ্যা হয়তো পোয়াবারো।
ভুক্তভোগীরা ঘটি-বাটি-ভিটি বিক্রি করে মামলার অর্থের যোগান দেন, যারা মামলার বিচার ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছেন কিংবা সরকার যে মানুষকে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার শপথ নিয়েছে তাদের জন্য এটি দুশ্চিন্তারই কারণ! পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারাদেশে নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের হয় এক রাখ ২৮ হাজার ১১৭টি। কিন্তু পুলিশি তদন্তে মামলাগুলোর ৯০ শতাংশই ভুয়া প্রমাণিত হয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নারী নির্যাতন মামলার ৮০ শতাংশই মিথ্যা মামলা। সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, যৌতুক নিয়ে যেসব মামলা হয়, তার ৯০ শতাংশই মিথ্যা। অথচ বিশে^র বিভিন্ন দেশে সহজে এ ধরণের মামলা হয় না। যদি মামলা দায়ের হয়ই তাহলে সেগুলোর সাজার হার শতভাগ। অথচ আমাদের দেশে ৮০ ভাগ মামলায় আসামি খালাস পায়। মূল কারণ হচ্ছে, মামলাগুলো অধিকাংশই মিথ্যা।
শুধু নারী নির্যাতন দমন আইনে দায়েরকৃত মামলাই নয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অনেক মামলা পরবর্তীতে ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হয়। বিদ্যমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন, পরিস্থিতি সামাল দিতে জনমত প্রশমনে, পরিস্থিতি বুঝে কখনো বিভিন্ন রকম উদ্দেশ্য হাসিলে প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ের করে মামলা। এ তালিকায় রয়েছে থানা পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানও।
দুদক ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রায় আড়াইশ’ মামলা দায়ের করে। যা পরে উচ্চ আদালতে ‘মিথ্যা’ এবং ‘উদ্দেশ্যমূলক’ হিসেবে বাতিল হয়ে যায়। পাটকল শ্রমিক নিরাপরাধ জাহালমের বিরুদ্ধে গত বছর ৩৬টি ভুয়া চার্জশিট দাখিল করে দুদক। পরে তা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় এবং জাহালমকে খালাস দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। অথচ এই ভুয়া চার্জশিটের ভিত্তিতে জাহালমকে আড়াই বছর কারাভোগ করতে হয়। আদালতের বিচারককে দিনের পর দিন শুনানি গ্রহণ করতে হয় মামলাগুলোর ওপর।
এনবিআর দায়েরকৃত বহু মামলাই উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় প্রচলিত আইনে দায়েরকৃত ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় অন্তত ১০ হাজারের বেশি মামলা প্রত্যাহার করে নেয় পরবর্তী সরকার। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। যা ‘গায়েবি মামলা’ হিসেবে পরিচিত। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৭ লাখেরও বেশি। এসব মামলায় লাখ লাখ আসামি আদালতে এখনো হাজিরা দিচ্ছেন। আদালত তাদের জামিন শুনানিতে ব্যস্ত থাকছেন তারিখের পর তারিখ। ব্যক্তিগত পর্যায়ের রেষারেষি, ভিন্ন মতের প্রতি অশ্রদ্ধা, অসহিষ্ণুতার কারণে গত দুই বছরে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ এ মামলা দায়েরের সংখ্যা বেড়েছে অনেক।
জনস্বার্থে, আদালত অবমাননা, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত হানার মামলাও দায়ের হচ্ছে অহরহ। এসব মামলা আইনজীবী এবং আদালত সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আয়-রোজগার বৃদ্ধি করলেও প্রয়োজনীয় মামলায় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের ওঠছে নাভিশ্বাস। দৃষ্টি আকর্ষণ, সরকারের সুনজরে পড়া, চাঞ্চল্য সৃষ্টি, পরিচিতি লাভ, বিখ্যাত হওয়া, আলোচনায় আসা, সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার লোভ থেকেও অনেক মামলা হয়। অথচ এসব মামলায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সুদূর পরাহত। কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই এসব মামলা নিয়ে আদালতকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন।
অপরাধের শাস্তি কিংবা সমস্যার প্রতিকার নয় ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করতেই দায়ের হয় মামলা। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে। তাই কাউকে মামলা থেকে নিবৃত রাখার অধিকার কারও নেই। এ ‘অধিকার’র দায়িত্বহীন প্রয়োগের মাধ্যমে হরণ করা হচ্ছে অন্যের অধিকার। নামমাত্র খরছে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে দায়ের করছে মামলা। একটি ঘটনায় আসামি করা হচ্ছে একাধিক মানুষকে। ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে পরিবার, পাড়া, মহল্লা এমনকি গ্রামের পর গ্রাম। মামলা দিয়ে গ্রামকে ‘পুরুষ শূন্য’ করে দেয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে।
মামলা জট প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ‘ব্লাস্ট’র এর উপ-পরিচালক (্আইন) অ্যাডভোকেট বরকত আলী বলেন, মামলা থেকে বিরত রাখতে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যে ব্লাস্ট বহু ঘটনার নিষ্পত্তি করেছে সালিশের মাধ্যমে। বছরে গড়ে ৪ হাজার ঘটনার নিষ্পত্তি করছি সালিশ করে। এগুলো মামলায় পরিণত হলে আদালতের ওপর চাপ বাড়ত। সরকার মামলার চাপ কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি চালু করলেও অধিকাংশ আইনজীবী এ পদ্ধতি কার্যকরে আগ্রহী নন।
তাদের ধারণা, এডিআর কার্যকর হলে মামলার সংখ্যা হ্রাস পাবে। পেশায় ধস নামবে। এ ধারণা সঠিক নয়। মামলার চাপ কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি চালু হলেও সুফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদের মতে, দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা আদালতে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধেও একই ধারায় পাল্টা মামলা করা যায়। ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন আদালত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।