মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
মাহবুব পলাশ
আমাদের দেশের অন্যতম অর্থকরি ফসল ‘চা’ শুধু চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদন করেই সম্ভব দেশের চায়ের ঘাটতি মেটানো। পাশাপাশি রপ্তানি উদ্যোগ নিয়েও ফিরিয়ে আনতে পারি সেই পুরো সেরা চা উৎপাদনের ঐতিহ্য। মাটি ও প্রাকৃতিক উপযোগিতায় মিরসরাই উপজেলার বনভূমির ১০ হাজার একর জমিই উৎকৃষ্টমানের চা চাষের জন্য উপযোগী। প্রয়োজন শুধু চা বোর্ডের ঘোষণা ও উদ্যোক্তাদের আহ্বানের উদ্যোগ। আরো সম্ভাবনার বিষয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় চা বোর্ডও বলছে, আগ্রহীগণ উদ্যোগ নিলেই চা বোর্ড সকল প্রকার সাহায্যে এগিয়ে আসবে।
একসময় চা রপ্তানি করে আমাদের দেশ অর্জন করেছে অনেক সুখ্যাতি। দেশের অভ্যন্তরেই চায়ের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য এখন সেই রপ্তানির মাত্রা কমিয়ে উল্টো আমদানি করতে হচ্ছে চা। আর চা বাগানের কথা উঠলেই এক সময় শুধু সিলেটের কথাই আসতো। কিন্তু এখন চা এর সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের সম্পৃক্ততা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সিলেটের পর ফটিকছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান এলাকায় চা উৎপাদনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মিরসরাই উপজেলার পার্শ্ববর্তী রামগড় ও ফটিকছড়িতে ও চায়ের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি মিরসরাই উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে চা চাষের অনুকূল উজ্জ্বল সম্ভাবনা সত্ত্বেও এখানে শুধুমাত্র উদ্যোগের অভাবেই শুরু হচ্ছে না চা চাষ।
চা চাষ একদিকে দেশের অর্থনীতির জন্য সহায়ক অপরদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বিকল্পহীন শিল্প। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় মিরসরাই উপজেলার পার্শ্ববর্তী রামগড় চা বাগানটি স্থাপিত হয় ১৯১৫ সালে। পরবর্তীতে এর আশপাশেই পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠে নেপচুন, দাঁতমারা, আঁধারমানিকসহ অনেক চা বাগান। উক্ত চা বাগান বিভিন্ন আয়তনের রামগড় চা বাগানের আয়তন ১৩৭৬ একর, দাঁতমারা চা বাগানের আয়তন ৬০০ একর, আঁধারমানিক চা বাগানের আয়তন ১৫০ একর। সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা মালিক এসব চা বাগানের। চট্টগ্রাম চা বোর্ডের নির্ধারিত নীতিমালার অধীনে সবাই এসব চা বাগান পরিচালনা করছেন।
বারইয়াহাট-খাগড়াছড়ি সড়কের রামগড়ে অবস্থিত মনোরম চা বাগান এলাকায় এলে যে কোন সৌন্দর্য পিপাসুই সেখানে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে সারি সারি চা বাগানের মনোরম দৃশ্য অপলক তাকিয়ে একটু দেখে নেন। গন্তব্যের টানে আবার ছুটলে ও কিছুক্ষণের জন্য মনোমুগ্ধকর সারি সারি সবুজের ঢেউ খেলানো এই স্থানটির প্রেমে পড়ে যান অনেকেই।
আর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেল রুট থেকেই সারি সারি সুউচ্চ পাহাড় দেখে সকলেই মুগ্ধ হন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বনভূমি বিলীন হতে হতে এখন বর্ষা মৌসুমে এখানে আংশিক সবুজ দেখা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে ন্যাড়া পাহাড়গুলোকে ধূসর খাঁ খাঁ মনে হয়। যেন দিনে দিনে মরুভূমির রূপ লাভ করছে। কিন্তু চা বাগান গড়ে উঠলে এই জোনের বনভূমি যেন ফিরে পাবে নতুন প্রাণ। পাশাপাশি রক্ষা হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সবুজের অংলকরণ।
সম্প্রতি সরেজমিন পরিদর্শনকালে রামগড় চা বাগানের সিনিয়র ম্যানেজার অতীশ সেন গুপ্তর কাছে তার বাগানের উৎপাদন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেডরোলো এর মালিকানায় ১৩৭৬ এর তার বাগানে বছরে উৎপাদন হয় প্রায় ৬ লাখ কেজি চা। কয়েকশ শ্রমিক কাজ করে তার বাগানে। তিনি বলেন চা বাগান সৃজনের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ধৈর্য ও একাগ্রতা। লাগার ৪-৬ বছর কোন আয়ের চিন্তা না করে শুধু বিনিয়োগ করে যেতে হয়। চারা থেকে গাছ চা ফলনে উপযোগী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাও এক প্রকার বিনিয়োগ।
এদিকে একইভাবে মিরসরাই উপজেলার করেরহাট থেকে ওয়াহেদপুর পর্যন্ত ৩০ হাজার একর বনভূমির মধ্যে কিছু কিছু অংশ রিজার্ভ ফরেস্ট রেখে বাকি অংশকে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আয়তনের চা বাগান সৃজন প্রাকৃতিকভাবেই উপযোগী। এই প্রতিবেদক নিজে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে এই অঞ্চলের চেয়ে অনেকে উঁচু নিচু পাহাড়ে ও ভালোমানের চা উৎপাদন করতে সরেজমিন দেখেছে। এই বিষয়ে রামগড় চা বাগানের ব্যবস্থাপক অতীশ সেন গুপ্ত বলেন, অধিক উঁচু নিচু পাহাড় চা চাষের জন্য ভালো, শুধুমাত্র চা সংগ্রহের ক্ষেত্রে দক্ষ শ্রমিকই যথেষ্ট। আবার এই জোনে চাইলে ঢালু এলাকা বর্জনও সম্ভব। কারণ করেরহাট থেকে শুরু করেই বিস্তীর্ণ রাশি রাশি পাহাড় বিভিন্ন মানের আয়তনে বিস্তীর্ণ ফাঁকাই পড়ে আছে। সম্প্রতি কোথাও কোথাও কেউ কেউ কিছুটা সামাজিক বনায়নে এলেও অনেকেই পিছু হটছে নানা প্রতিকূলতায়। কিন্তু চায়ের ক্ষেত্রে নেই কোন প্রতিকূলতা।
মিরসরাই উপজেলা অঞ্চলের চা চাষের সম্ভাব্যতা বিষয়ে সিলেটের চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকা বিজ্ঞানী শেফালী ব্যানার্জির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মিরসরাই অঞ্চল চা চাষের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। আর চট্টগ্রাম চা বোর্ডে এসব অঞ্চলে চা চাষ বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তাবনাও দেয়া আছে।
আর চট্টগ্রাম বিভাগীয় চা বোর্ডের উপ-পরিচালক পরিকল্পনা মনির আহমেদের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিরসরাই সীতাকুন্ডের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে অবাধে চা চাষের উপযোগী। এখানকার মাটি ও পরিবেশ সকলভাবেই অনুকূলে। তবে বিভিন্ন পর্যায়ের বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তা এগিয়ে এলে আমরা অবশিষ্ট সকল সহযোগিতা দিব। শুধু তাই নয় উদ্যোক্তাগণের জন্য ব্যাংক লোন পাইয়ে দেয়াসহ বন অধিদপ্তসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নিয়মনীতিতে ও সহযোগিতা করবো।
এই বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিয়া আহমেদ সুমনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অঞ্চলে চা চাষ হলে অবশ্যই দেশের জন্য তা সুফল বয়ে আনবে। চা বোর্ড সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আমরা সকল পর্যায়ের সহযোগিতা প্রদান করবো।
আবার এই বিষয়ে মিরসরাই উপজেলার করেরহাটস্থ চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মোহাম্মদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার উদ্যোগ নিলে আমরা সম্ভাব্য জরিপ কার্যক্রমেও সহায়তা করতে পারি। বাকিটুকু চা গবেষণা বিভাগ ও চা বোর্ডের উদ্যোগের বিষয়।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের ১৬২টি বাগানের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে ২০১৫ সালে ৬৭ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে৷ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে এখন প্রতি বছর আনুমানিক ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি হয়৷ কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কুয়েত, ওমান, সুদান, সুইজারল্যান্ডসহ অনেকগুলো দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের চা।
গত দশ বছরে পৃথিবীতে চায়ের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই চাহিদার সাথে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর প্রায় ৫২ ভাগ চায়ের চাহিদা পূরণ করছে।
চা উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে না পারলে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের চা বিদেশে রপ্তানি করা খুব কঠিন হবে।
প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায়, সমগ্র বাংলাদেশে চা আবাদের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা দুটি নতুন ক্লোন বিটি-১৯ ও বিটি-২০ চা শিল্পের জন্য অবমুক্ত করা হবে এই চা চাষের উৎপাদন এই মিরসরাইয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে ও সম্ভব। এছাড়া চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিদেশ থেকে চায়ের আমদানি যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। আর মিরসরাই উপজেলার হাজার হাজার হেক্টর পাহাড়ি এলাকার মধ্যে করেরহাট, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর, মিরসরাই, খৈয়াছরা, ওয়াহেদপুর এলাকার পাহাড়ে বিভিন্ন আয়তনের চা বাগানের উদ্যোগ নেয়া সবুজ আগামীর জন্য ও সময়ের দাবী। সরকার অনেকভাবে চেষ্টা করে এই এলাকায় বনাঞ্চল রক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু চায়ের ক্ষেত্রে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে সফল হবেই নিশ্চিত।
ষ লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।