Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেঁড়িবাধে চিংড়ী চাষীদের অবৈধ পাইপে ভাঁসছে কয়রার মানুষ

কয়রা (খুলনা) জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১০ জুন, ২০২০, ৮:০৫ পিএম

খুলনার কয়রায় পাউবোর বেড়িবাঁধে অবৈধভাবে পাইপ বসিয়ে লবণ পানি উত্তোলন অব্যাহত থাকায় বার বার নদী ভাঙ্গনে প্লাবিত হতে হচ্ছে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষের।বার বার হুমকির মুখে পড়েছ বেড়িবাঁধ। যেকেনো সামান্য দুর্যোগ ও ঝড়ে মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে ওই এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা খরচ করে বেঁড়িবাধ ৬ মাস না যেতেই আবার ভাঙ্গন দেখা দেয়। বেঁড়িবাধে ভাঙ্গন হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কে থাকতে হয় এলাকাবাসিকে সব সময়।

বিগত ২০১৮ সালে বছরের শুরুতেই অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে বাঁধে বসানো অবৈধ পাইপ অপসারণের কাজে নেমেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ জন্য চিংড়ি চাষিদের সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তাতে সাড়া না দেওয়ায় সর্বশেষ তালিকা তৈরি করে অবৈধ পাইপ অপসারণের জন্য এসব চিংড়ি চাষিদের নামে নোটিশ জারী করা হয়।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বা পাউবোর মহাপরিচালকের দাপ্তরিক আদেশ মোতাবেক সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী সাক্ষরিত এ নোটিশ দেওয়া হলেও কেউ সে নির্দেশ অনুসরণ করেনি। বরং পাউবোর নির্দেশ উপেক্ষা করে প্রতিনিয়তই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তলদেশ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে নদী থেকে পানি উত্তোলনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা । ফলে নতুন করে কয়রা উপজেলা আবার প্লাবিত হওয়ার এটা একটায় প্রধান কারণ। এতে পাউবোর কর্তারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের কয়রাবাসী।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১৩/১৪-১ ও ১৩/১৪-২ নম্বর পোল্ডারে কয়রা উপজেলায় নির্মিত পবনা ক্লোজার, লোকা,দশহালিয়া , মদিনাবাদ, মঠবাড়ি, শিকারী বাড়ি ক্লোজার, নয়ানি স্লুইসগেট সংলগ্ন, কাটকাটা, গাজীপাড়া, কাটমারচর কয়রা সদরের অনেক জায়গা গোবরা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা , জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালি এলাকার চিংড়ি চাষিরা বহাল তবিয়তে বাঁধ কেটে অথবা ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে এখনও নদীর পানি উত্তোলন করে চলছে।

অভিযোগ রয়েছে, এ সব এলাকায় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ঘের মালিকদের বিরুদ্ধে না যেয়ে দায়িত্বরত পাউবোর কর্মকর্তারা ঘের মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। যে কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তবে পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে বসানো এসব পাইপ দিয়ে নিয়মিত নদীর পানি সরবরাহের কারণে বাঁধের ওই সব স্থান দিয়ে ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।

তারা বলেন, সিডর ও আইলা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কয়রা উপজেলায় যেসব স্থানে ভেঙে প্লাবিত হয়েছিল, সেসব স্থানে বাঁধ ছিদ্র করে চিংড়ি চাষিরা পাইপ বসিয়েছিল। এসব বাঁধ মেরামত করতে একদিকে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এবং জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতিসহ তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কয়রা উপজেলা সদরের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কপোতাক্ষ নদসংলগ্ন ২০০ একর জমির গোবরা বিল ও কয়রা সদরের অদুরে ১৫০ একর জমির মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন প্রায় দুই দশক ধরে নদী থেকে নোনা পানি টেনে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। গোবরা বিল ও মদিনাবাদ পাশ ঘেঁষে কপোতাক্ষ নদটি এঁকেবেঁকে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আগে নদের পানি নদ বরাবর বাঁধ থেকে অনেক দূর দিয়ে প্রবাহিত হতো। এখন নদের পানি বাঁধের ওপর আছড়ে পড়ে।কারণ বাঁধের ভেতর নদের জমি ভেঙে নদে মিশে গেছে।

স্থানীয় আলামিন, মামুন, খোকন,আমিরুল জানান, চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধ যথেচ্ছভাবে কাটা ও ছিদ্র করায় বাঁধের ক্ষতি হয়েছে। লবণ পানি তোলার ফলে জমির উর্বরতা কমে আসছে। যে কারণে জমিতে ধানের আবাদ অনেক কম হচ্ছে।
সরাসরি বাঁধ কাটে পানি তোলা , যেখানে-সেখানে ছিদ্র করে পাইপ বসানো হয়। এতে বাঁধের নদপারের জমি ভেঙে নদে বিলীন হয়েছে ও হচ্ছে । এখন বাঁধ ভাঙছে। বর্ষাকাল মানে আতঙ্ক। বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত।সব সময় আতঙ্কে থাকে এলাকাবাসী।এছাড়া লবণ পানির ঢেউ লেগে কাঁচাপাকা রাস্তাঘাট প্রতিনিয়ত ধসে পড়ছে। বিশেষ করে এলাকার গাছপালাসহ সবুজ বৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব কারণে চিংড়ি চাষ বন্ধে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন দপ্তরে কয়েকবার লিখিত আবেদন করেছেন বলে জানান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৩-১৪/২ ও ১৩- ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কেটে কিংবা ছিদ্র করে ৩০০টি অধিক স্থানে পাইপ ও নাইন্টি বসানো হয়েছে। মুলত আম্পানে বেঁড়িবাধ ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়ার প্রধান কারণ এটি।বেঁড়িবাঁধ থাকে সময় ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ১৩-১৪/২নং পোল্ডারে বানিয়াখালি এলাকার ১১৭ জন, ১৩-১৪/১ নম্বর পোল্ডারে আংটিহারা এলাকায় ৭৮ জন এবং ১৩-১৪/২নং পোল্ডারে আংটিহারা, গোলখালি, মহারাজপুর, কয়রা, বাগালি ও মহেশ্বরীপুর এলাকায় ১১৯ জন অবৈধভাবে বাঁধ কেটে পাইপ বসানো চিংড়ি চাষির নামে নোটিশ পাঠায় পাউবো কর্তৃপক্ষ। অথচ পাউবোর নির্দেশ উপেক্ষা করে সূচতুর ঘের মালিকরা বাঁধ কেটে চিংড়ি চাষ অব্যাহত রেখেছে।

গোবরা গ্রামের মেসবাহ উদ্দিন বলেন, বিলে তাঁর ১০ বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে নোনা পানির চিংড়ি চাষ করছেন; কিন্তু আর তা চান না। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চিংড়ির তেমন ফলন নেই। দামও ভালো পাওয়া যায় না। বাঁধ ভাঙে,চিংড়ি ঘের বাঁধের জন্য আতঙ্ক । এসব কারণে আর নোনা পানি টেনে তুলতে চাই না।’ তিনি হতাশার সুরে বলেন, ‘কিন্তু আমরা না চাইলে কি হবে, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা অনেকেই বাঁধ কেটে বার বার ই লোনা পানি তোলেন। আলামিন বলেন, আমরা এলাকাবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভিন্ন দপ্তরে লবণের আগ্রাসন ও বেঁড়িবাঁধের আতঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে লিখিত অভিযোগ করেছি কিন্তু কাজ হয়নি। জনপ্রতিনিধি ও তাদের স্বজনদের মৎস ঘের থাকায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন আমরা উপজেলা চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কারণ তিনি, তার স্বজন ও তার লোকজন নদীর পানি তুলে ও চিংড়ি চাষ করেন।তার ফলে নদীর বেঁড়িবাধ ভাঙছেই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ