দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
বছরান্তে দীর্ঘ এগার মাস পর ঘুরে আসে মাহে রমাযান। মহান প্রভু তাঁর পরম প্রিয় বান্দাকে কলুষমুক্ত করার জন্য ১২ তম মাহিনা রমাযান মাস দান করেছেন। সেই মোবারক মাহিনা বছর ঘুরে এবারও উপস্থিত। মাহে রমাযান ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাস, আত্মসংযমের মাস, অন্ন ক্ষুধা ও যৌন ক্ষুধা নিবৃত্তির মাস, ক্ষমা প্রাপ্তির মাস, জাহান্নামের কঠিন আযাব হতে পরিত্রাণের মাস, সর্বোপরি কুরআন নাযিলের মাস। ইরশাদ হয়েছে- ‘মাহে রমাযান এমন এক মহিমান্বিত মাস যে মাসে কুরআন নযিল করা হয়েছে মানব জাতির হিদায়াতের আধার স্বরূপ।’
হিজরী সনের ১১তম মাস শা’বানের সমাপ্তির সাথে সাথে যখনই রমাযানের বাঁকা চাঁদ ঊর্ধ্বাকাশে উদিত হয় ঠিক তখন হতেই মুসলমানদের হৃদয় মাঝে এক নতুন স্পন্দনের সঞ্চালন হয়। একমাত্র নিতান্ত দুর্ভাগা ছাড়া সকলেই কৃত পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে কেবল মাগফিরাতের আশায় যাত্রা শুরু করে প্রথম রমযান হতেই। সত্যিই একজন মুসলমানের অনূভূতি এমনটিই হওয়া বাঞ্ছনীয়। বড় সৌভাগ্যশালী ইনসান তাঁরা-যাঁরা বাস্তবিকই এই মোবারক মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন এবং আগত-অনাগত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য রেখে গেছেন এক সুন্দরতম উসওয়া বা আদর্শ। তাঁরা ছিলেন রুজু ইলাল্লাহ্ বাস্তব প্রতিচ্ছবি। এই রুজু ইলাল্লাহ বা আল্লাহমূখিতা একজন বনী আদমকে সৌন্দর্যের উচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে সক্ষম। সকল পঙ্কিলতার দ্বার রুদ্ধ করে দিয়ে হায়াতে যিন্দেগীকে করে তুলবে মহিমান্বিত। সাহাবী হযরত কা’ব ইবনে উজরাহ রা. হতে বর্নিত, তিনি বলেন, একদা প্রিয়নবী সা. আমাদেরকে মিম্বরের নিকট উপস্থিত হতে বললেন। আমরা উপস্থিত হলাম। এরপর হুজুর সা. প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন- আমীন, দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন- আমীন এবং তৃতীয় সিঁড়িতে কদম মুবারক রেখেও বললেন- আমীন।
হযরত কা’ব রা. বলেন, হুজুর সা. মিম্বর হতে অবতরণের পর আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আজ আপনি মিম্বরে আরোহণকালে এমন বাক্য উচ্চারণ করলেন, যা ইতোপূর্বে কখনও শুনিনি। নবীজী সা. বললেন, মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলে জিবরাঈল আ. উপস্থিত হয়ে দু’আ করলেন, যে ব্যক্তি রমাযান মাস প্রাপ্ত হল অথচ ক্ষমাপ্রাপ্ত হল না (আপন গুনাহ মাফ করিয়ে নিল না) সে ধ্বংস হোক। আমি এতে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেছি-আমীন। এরপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলে দু’আ করলেন, ধ্বংস হোক সে যার সম্মুখে আপনার নাম নেয়া হল অথচ সে আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করল না। আমি বললাম-আমীন। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলে দু’আ করলেন, যে ব্যক্তি বৃদ্ধ মাতা-পিতার জীবদ্দশায় তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারল না সে ধ্বংস হোক। আমি এতেও একাত্মতা ঘোষণা করে বললাম- আমীন।
বলা বাহুল্য, উপরোক্ত হাদীস দ্বারা একথা সহজেই অনুমেয় যে, প্রতিটি মুমিনের উচিত সিয়াম সাধনার এই মাসে একমাত্র খোদামুখিতা অর্জনের লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক প্রোগ্রাম বানানো। যেমনটি দেখিয়ে গেছেন বুযুর্গ মনীষীগণ। পবিত্র মাহে রমাযানে একমাত্র রুজু ইলাল্লাহকে দৈনন্দিন কর্ম ব্যস্ততার রুটিন বানানোর অসংখ্য ঘটনা আকাবির বুযুর্গদের জীবনীতে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ কুরআন নাযিলের এই মাসে বেশিরভাগ সময় তাঁরা নিজেকে ব্যপৃত রেখেছিলেন কুরআনে কারীম তিলাওয়াতের মধ্যে। বক্ষমান নিবন্ধে আমরা কয়েকজন বুযুর্গ মনীষীর সাধনার পদ্ধতি ও অবস্থার কিঞ্চিৎ জানতে প্রয়াসী হব ইনশাআল্লাহ।
হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.
হাদিয়ে যামান হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর মাহে মোবারক- রমাযানের আমল ও কর্মসূচীর বর্ণনায় হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ. লিখেন- হাজী সাহেব বলেন, তোমাদের শিক্ষার উদ্দেশে বলছি যে, এই অনুপযুক্ত আলিম যৌবনকালে বহু রাত্রি বিনিদ্র অবস্থায় কাটিয়ে দিয়েছে। বিশেষতঃ রমাযান মাসে। মাহে রমাযানে মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত দু’জন হাফেয থেকে সোয়া পারা পরিমাণ শুনতাম। ইশার পর অন্য দু’জন শোনাতেন, এরপর অর্ধরাত্রি পর্যন্ত পালাক্রমে একজন করে শোনাতে থাকতেন। তারপর তাহাজ্জুদের নামাযে দু’জন হাফেয সাহেব শোনাতেন। মোটকথা রমাযানের পুরো রজনীই আমার এভাবে কেটে যেত।
কুতবুল আলম মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.
হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. লিখেন যে, হযরত গাঙ্গুহী রহ. এর রিয়াযত ও মুজাহাদার অবস্থা ছিল অবর্ণনীয়। তিনি যখন ৭০ বয়সোর্ধ্ব অশীতিপর বৃদ্ধ তখনও ইবাদত-বন্দেগীর আধিক্যের পরিমাণ ছিল এরূপ যে, সারা দিন সিয়াম সাধনার পর মাগরিব বাদ ছয়-এর স্থলে বিশ রাকাত আওয়াবিনের নামায আদায় করতেন এবং আনুমানিক দুই পারা তিলাওয়াত করতেন। আবার রুকু সাজদা করতেন খুব দীর্ঘ। নামায শেষ করে ঘরে যাতায়াত এবং খাবার-দাবারের ফাঁকে আরো কয়েক পারা পড়ে নিতেন। তারপর ইশা ও তারাবীহ্র নামাযে এক থেকে সোয়া ঘন্টা ব্যায় করতেন। তারাবীহ শেষে রাত্রিতে দুইটা/ আড়াইটার সময় জাগ্রত হতেন। খাদেমগণের ভাষ্য অনুযায়ী কখনো রাত একটার সময়ই উঠে যেতেন এবং আড়াই থেকে তিন ঘন্টা ব্যাপী তাজাজ্জুদের নামাযে মশগুল থাকতেন। ফজরের পর ৮টা ৩০ মি. পর্যন্ত ওজীফা ও মোরাকাবাতে কাটাতেন। পরে ইশরাকের নামায আদায় করে চিঠিপত্রের উত্তর দেয়া এবং ফতোয়া লিখার কাজে মশগুল হতেন। অতঃপর চাশতের নামায শেষ করে একটু ক্বায়লুলা করতেন এবং জোহরের নামায আদায় করতেন। জোহরের পর হুযরা খানা একটানা আসর পর্যন্ত একেবারে বন্ধ থাকত। এ সময় তিনি কুরআন তিলাওয়াতে আত্মনিয়োগ করতেন। মোটকথা রমাযানে গাঙ্গুহী রহ. এর প্রত্যেক ইবাদতই তুলনামূলকভাবে বেড়ে যেত। কুরআনের তিলাওয়াত এত বেশি হত যে, প্রতিদিনের রুটিন ছিল নামাযের বাইরে অন্তত আধা খতম করা।
কাসেমুল উলূম ওয়াল খায়রাত হযরত ক্বাসেম নানুতবী রহ.
শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া সহেব কান্দলভী রহ. ‘আকাবির কা রমাযান’ গ্রন্থে লিখেন, মাহে রমাযানে কাসেমুল উলূম হযরত নানুতবী রহ. -এর কর্মসূচী সম্বন্ধে বিস্তারিত কোন তথ্য আমার জানা নেই এবং জেনে নেয়ার মত কোন মাধ্যমও আমি খুঁজে পাইনি। তবে সুুপ্রসিদ্ধ তথ্যটি অনেকেই জানেন যে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের সফল ভীত রচনাকারী হযরত কাসেম নানুতবী রহ. ১২৭৭ হিজরী সনে হিজাজ সফরকালে রমাযান মাসে পূর্ণ কুরআন হিফয করেন। প্রতিদিন এক পারা মুখস্থ করতেন এবং তারাবীহ্র নামাযে তা শোনাতেন। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।