Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আল্লাহর নৈকট্য লাভের অনন্য উপায় : ইতিকাফ

ড. মুহাঃ আবু ইয়াছিন | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

ইতেকাফ আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যাতম মাধ্যম। আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার সহজ উপায়। কারণ, মানুষ যখন জগত-সংসার এর কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আল্লাহর ঘরে ইবাদতের নিমিত্তে আত্মনিয়োগ করবে, তখন করুনাময় সৃষ্টিকর্তা তার থেকে দূরে থাকতে পারেননা। তিনি তো ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বান্দা আমার দিকে একহাত অগ্রসর হলে আমি তার দিকে দুইহাত অগ্রসর হই। আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলে আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। শুধু তাই নয় তিনি আরো বলেছেন, যদি বান্দা তোমরা আমার স্বরণ করো, তাহলে আমি তোমাদের স্বরণ করবো । (সুরা বাকারা ০২: ১৫২) । 

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, কেউ যখন আল্লাহর ঘর মসজিদে অবস্থান নেয় তখন আল্লাহ তায়ালা এত বেশি আনন্দিত হন যেমন বিদেশ থেকে কেউ বাড়িতে এলে আপনজনরা আনন্দিত হয়ে থাকে।’ (তারগিব-তারহিব : ৩২২)।
আর বান্দা আল্লাহর স্বরণের জন্য তথা নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একান্ত ভাবে আল্লাহর ইবাদাত ও ধ্যানের মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধু অর্জনের জন্যে রমজানের শেষ দশকে মসজিদে অবস্থান নিয়ে যে কর্ম সম্পাদন করে তার নাম ইতিকাফ।
ইতিকাফ আরাবি শব্দ এটি আকাফুন মুলধাতু থেকে আসছে। যার অর্থ কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা, কোন জিনিষকে আকড়ে থাকা বা রাখা অথবা কোন জিনিষ থেকে বিরত থাকা চাই তা ভাল হোক অথবা মন্দ হোক। যেমন- পবিত্র কুরআনে এসেছে- ‘আমি ইব্রাহিম আর ইসমাইলকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যেন তোমরা আমার (কাবা) ঘরকে পবিত্র করো তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী এবং রুকু সিজদাকারীদের জন্য।’(সুরা বাকারা ০২:১২৫)। এছাড়া সুরা আরাফ ৭:১৩৮, সুরা সুরা আম্বিয়া ২১ : ৬২ আয়াতে ইতিকাফ শব্দটি এসেছে।
শরিয়াতের পরিভাষায় জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে পুরুষের অথবা মহিলার জাগতিক স্বীয় ঘরের নামাযের যায়গায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। (কাওয়ায়িদুল ফিকহ, পৃ-১৮৪)।
যিনি ইতিকাফ করেন তাকে মুতাকিফ বলা হয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় তাদের সাথে (তোমাদের স্ত্রীদের ) সাথে সঙ্গম করোনা। (সুরা বাকারা ০২:১২৭)।
ইতেকাফ সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্য হতে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হল: নবি করিম (সা) রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন। (বুখারি-২০২৫)
হযরত আয়িশা (রাঃ)থেকে বর্নিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন, তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর স্ত্রীগণও সে দিন গুলোতে ইতেকাফ করেছেন। (বুখারি-২০২৬)
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে শেষ দশ দিন ইতেকাফ করতেন । কিন্তু এক বছর তিনি ইতিকাফ করলেননা । তাই পরবর্তী বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করলেন। (আবুদাউদ- ২৪৬৩)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করতেন । তবে যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করেছিলেন। (রিয়াদুস সালেহীন-৩৭৮)
ইতিকাফ তিন ধরনের যথা- ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ও মুস্তাহাব। ওয়াজিব ইতিকাফ, যেমন মানতের ইতিকাফ । যদি কেও রমজানের ইতিকাফের মানত করেন তাহলে তার এ মানত সহীহ হবে। মানত করার পর যদি সে রমজানের রোজা রাখে, ইতিকাফ না করে , তবে তার উপর অন্যমাসে রোজাসহ লাগাতার ইতিকাফের কাযা করা ওয়াজিব। পরবর্তী রমজানে ঐ ইতিকাফের কাযা করলে তা আদায় হবেনা।
সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ইতিকাফ হল, রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ কেফায়া, অর্থাৎ বড় শহর বা গ্রামের প্রত্যেকটা মহল্লা এবং ছোট গ্রামের পুর্ণ বসতিতে কেও কেও ইতিকাফ করলে সকলেই দায়িত্ব মুক্ত হবে। আর কেও না করলে সুন্নাত তরকের জন্যে সকলেই দায়ী হবে।
নফল ইতিকাফের জন্যে রোজা রাখা শর্ত নয়। কিন্তু মানতের ইতিকাফের জন্যে রোজা রাখা শর্ত। নফল ইতিকাফের জন্য নির্দিষ্ট কোন মেয়াদ নেই। অল্পসময়ের জন্য নফল ইতিকাফ করা যায়। মসজিদে ইতিকাফের নিয়তের সাথে অবস্থান করাই উত্তম। ইতিকাফকারী রমযানের ২০ তারিখ আসরের পর সুর্যাস্তের পুর্বে শেষ দশকের ইতিকাকাফের নিয়ত করে মসজিদে প্রবেশ করবে। তার পর ২৯ বা ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় শাওয়ালের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করবে। চাঁদ প্রমানিত হলে ইতিকাফ শেষ হয়ে যাবে।
ইতিকাফের সহিহ হওয়ার শর্ত হলঃ মুসলমান হওয়া, জ্ঞানবান হওয়া, যানাবাত থেকে পবিত্র হওয়া অর্থাৎ হায়েজ অথব নেফাস থেকে পবিত্র হওয়া । স্ত্রীর জন্যে স্বামির অনুমতি নিয়ে ইতিকাফ করা যায়িয। অনুমতি দেয়ার পরে স্বামী তাকে ইতিকাফ থেকে বিরত রাখতে পারবেনা।
ইতিকাফ যে কারণে ভংগ হয়ঃ ইতিকাফকারী মানবীয় ও শরিয়াত সম্মত প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে যদি মসজিদের বাহিরে বের হয় তাহলে তার ইতিকাফ ফাসেদ হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছা করে বের হোক বা ভূল ক্রমে বের হোক । অনুরুপ ভাবে মহিলা তার ঘরের নির্ধারিত স্থান থেকে বের হবে না। জুমার নামাজ আদায় বা পেসাব পায়খানা ইত্যাদি ওজরের কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া যায়িয। ঐসব প্রয়োজন পুর্ণ হওয়ার পরেও যদি অলপ সময় মসজিদের বাহিরে অবস্থান করে , দাঁড়িয়ে কথা বলে হাসি তামাসা করে তাহলে তার সুন্নত ইতিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।( হেদায়া ১)
ইতিকাফের আদবঃ ইতিকাফ অবস্থায় অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা। সর্বোত্তম মসজিদ ইতিকাফের জন্য নির্বাচন করা। যেমনঃ মাসজিদুল হারাম,মদিনার মসজিদ বা জামে মসজিদ। ক্রুআন হাদিস পাঠ করা, দ্বিনি ইলম শিক্ষা দেয়া ও শিক্ষা করা, বেশি বেশি যিকির করা, ইসলামি সাহিত্য তথা সিরাতুন নবি বা নবিদের জিবনী পাঠ করা, শরিয়াতের বিধান সংক্রান্ত বই পুস্তক পাঠ করা ও রচনা করা। যে কথায় পাপ পণ্য কিছুই নেই সেই কথা প্রয়োজন ছাড়া না বলা। কারণ তাতে কোন পণ্য অর্জন হচ্ছেনা। (শামী-২)
ইতিকাফের উপকারিতা ও ফজিলাতঃ ইতিকাফে থাকা অবস্থায় বাহিরের সকল গুনাহ থকে মুক্ত থাকা যায়। ইতিকাফরত অবস্থায় বান্দা যেন আল্লাহর ঘরে তার সামনে সার্বক্ষণিক উপস্থিত। যে কারণে আল্লাহর কাছে তার প্রিয় বান্দা ও সম্মানী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়, এবং আল্লাহ তার প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, ক্ষমা ও রহমতের নজর দিয়ে থাকেন। ইতিকাফকারীর অবস্থানের সময়, খানা পিনা, নিদ্রা, বৈধ প্রয়োজন (পেশাব-পায়খানা) সবই ইবাদতের মধ্যে গণ্য হয়। (বাদায়েঃ ২)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইতেকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে গোনাহ পরিত্যাগকারী। সমবসয় কোন পূণ্যের কাজে অংশগ্রহনকারীর মতো সে সওয়াব পাচ্ছে।(শুয়াবুল ঈমান, হাদিস নং -৩৬৭৮)
হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‹যে ব্যক্তি রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করবেন তিনি দুটি ওমরাহ ও দুটি হজ আদায় করার সওয়াব পাবে।› (শুয়াবুল ঈমান , হাদিস নং : ৩৬৮১, বুখারি)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতথ রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান, হাদিস: ৩৯৬৫) ।
সুতরাং ইতিকাফ নবি করিম (সাঃ)এর একটি সুন্নত কাজ। ফরজ ইবাদত ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেসব ইবাদত করা হয় তার মধ্যে ইতিকাফ একটি অন্যতম ইবাদত। উপরোক্ত বিষসমুহ খেয়াল রেখে যিনি ইতিকাফ নামক ইবাদাত সম্পাদন করতে সক্ষম হবেন ইনশাল্লাহ তিনি আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে অগ্রগামী হবেন। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে ইতিকাফের মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের তাওফিক দান করেন। আমিন



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ