Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সদকাতুল ফিতর : হাসি ফুটুক অসহায় মানুষের

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

সদকাতুল ফিতর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। যা এক মাস রোজা শেষে ঈদুল ফিতরের সুবহে সাদিকের সময় গরিব-দুঃস্থ মানুষের আনন্দের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ খাদ্যপণ্য অথবা অর্থ প্রদান করার জন্য ইসলাম নির্ধারিত ব্যবস্থা। সামর্থবান, জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় সমাগ্রী ছাড়া শরিয়তকর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিকদের পক্ষ থেকে, অসহায়-গরিবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের খাদ্য, টাকা-পয়সা প্রদান করাই মূলত সদকায়ে ফিতর, যা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর ওয়াজিব। রোজা না রাখলে অথবা রাখতে না পারলেও তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব।
রোজা রাখতে গিয়ে অনেক ভুল-ত্রু টি হয়। সদকায়ে ফিতরের মাধ্যমে রোজার ত্রু টি-বিচ্যুতি পূরণ হয়। যেমনি নামাজের ত্রু টি-বিচুত্যি পূরণ হয় সাহু সিজদার মাধ্যমে। এ ছাড়া ধনী-গরিব উভয়ে যেন অন্তত ঈদের দিন উত্তম পোশাক ও উন্নত মানের খাবার খেয়ে যেতে পারে এজন্যেই এ ফিতরার ব্যবস্থা। ফিতরা দ্বারা সমাজের অসহায় শ্রেণীর সহায়তা করে ইসলামে সাম্যতার নজির স্থাপন করেছে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রোজাকে অনর্থক কথা ও অশালীন কথা হতে পবিত্র করার জন্যে এবং নিঃস্বদের মুখে খাদ্য দেওয়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬০৯)
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) ইরশাদ করেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সদকায়ে ফিতর আদায় করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার রোজা জমিন ও আসমানের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে।’ (কানযুল উম্মাল, হাদিস : ২৪১২৯)
ঈদগাহে যাওয়ার আগেই ফিতরা দিয়ে দেয়া : ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা মুস্তাহাব। তবে জাকাতের মতো সে সময়ের আগেও তা আদায় করা যায়। আবার কোনো কারণে সময় মতো আদায় করতে না পারলে পরেও আদায় করা যায়। অবশ্য পরে আদায় করলে ফজিলত কমে যাবে এবং সেটা সাধারণ দান বলে গণ্য হবে। কেউ আদায় না করে মারা গেলে তার পক্ষ থেকে তার উত্তরাধিকারী দিয়ে দিলেও আদায় হয়ে যাবে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, নারী, পুরুষ, ছোট-বড় সকলের ওপরে সদকায়ে ফিতর হিসেবে এক সা‘ (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খেজুর অথবা এক সা‘ যব ফরজ করেছেন। আর তা ঈদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বেই আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫০৩)
কারা ফিতরা দেবেন : যার ওপর কুরবানি ওয়াজিব, অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা তার সমপরিমাণ টাকা থাকে, কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকে তাহলে তার ওপর ঈদুল ফিতরের দিন সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। চাই তা ব্যবসার সম্পদ হোক বা না হোক, বৎসর অতিবাহিত হোক বা না হোক, পুরুষ হোক বা মহিলা হোক কোনো পার্থক্য নেই। (হেদায়া ১/১৯০)
যার ওপর সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। (ফাতহুল কাদির ২/২৮১)
সন্তানের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পিতার পক্ষ থেকে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে পিতা সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করে দিলে আদায় হয়ে যাবে। তেমনি স্বামী স্ত্রীর সদকায়ে ফিতর আদায় করলে তাও আদায় হয়ে যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার ৩/২৮৫)
ফিতরা কখন ওয়াজিব হয় : ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। অতএব সুবহে সাদিকের পর যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৯২)
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ : সদকায়ে ফিতর খেজুর, যব, গম, আটা বা এগুলোর নগদ মূল্য টাকা-পয়সা দ্বারা আদায় করা যায়। খেজুর দ্বারা সদকায়ে ফিতর আদায় করতে চাইলে এক সা‘ তথা সাড়ে তিন সের ভালো মানের খেজুর বা তার মূল্য সদকা করতে হবে। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, নবী (সা.) এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর দিতাম এক সা (সাড়ে তিন কেজি প্রায়) খাদ্যবস্তু। তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর।’ (সহিহ বুখারি ১/২০৪)
আর গম বা আটা দ্বারা আদায় করতে চাইলে পোনে দুই সের অর্থাৎ ১ কেজি ৬৫০ গ্রাম ভালো মানের গম বা আটা বা তার মূল্য আদায় করতে হবে। (আদ্দুররুল মুখতার ১/৩৪৬) নবীজি (সা.) হজরত আমর ইবনে হাযমকে (রা.) অর্ধেক সা‘ গম দিয়ে ফিতরা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।’
কেমন দামের খাদ্যবস্তু দ্বারা ফিতরা আদায় করা হবে : হানাফি মাজহাবে অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাই উত্তম দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (সহিহ বুখারি ৩/১৮৮) তাই আমাদের সবার দায়িত্ব হলো নিজের সামর্থ অনুযায়ী বেশি মূল্যের পণ্য দ্বারা ফিতরা আদায় করে নিজে বেশি সওয়াব লাভ করা এবং গরিবদের বেশি সহযোগিতা করা।
নগদ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় : হানাফি মাজহাব মতে নগদ অর্থ দিয়ে সদকায়ে ফিতর আদায় করা যাবে। কেননা ফিতরা আদায়ের অন্যতম লক্ষ্য হলো দরিদ্র-অসহায় মানুষকে ঈদের আনন্দে শরিক করা। তাদের যেমন প্রয়োজন খাদ্যের, তেমনি প্রয়োজন কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য সামগ্রীর। তাই নগদ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করলে তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) সিরিয়ার দুই মুদ গম অর্থাৎ অর্ধ সা‘ গমকে মদিনার এক সা‘ খেজুরের সমান মূল্য নির্ধারণ করে সদকায়ে ফিতর আদায় করেছেন।’ এজন্য পণ্য দিয়ে ফিতরা দিতে হবে এ ধরনের সীমাবদ্ধতায় না গিয়ে বিষয়টি উন্মুক্ত রাখাই ভালো, যাতে সবার জন্যই তা সহজ হয়ে যায়। ইসলাম সহজকে পছন্দ করে যদি তাতে গোনাহ না হয়। রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯)
সদকায়ে ফিতরের টাকা দিয়ে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ : সদকায়ে ফিতরের টাকা দিয়ে মসজিদ- মাদরাসা, রাস্তা, হাসপাতাল নির্মাণসহ জনকল্যাণমূলক কাজ করা বৈধ হবে না; বরং উক্ত টাকা জাকাতের উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকেই মালিক বানিয়ে দিতে হবে।
একজনকে একাধিক সদকায়ে ফিতর দেওয়া : পরিবারের কয়েকজনের সদকা মিলিয়ে একজন গরিবকে দেয়া যেতে পারে। অথবা একজনের সদকা কয়েকজন গরিবকেও দেয়া যেতে পারে। তবে উত্তম হলো, একজন গরিবকে এই পরিমাণ ফিতরা দেয়া, যা দিয়ে সে তার ছোটখাটো প্রয়োজন পুরা করতে পারে কিংবা দু’তিন বেলা খেতে পারে। (রদ্দুল মুহতার ২/৩৬৪)
এতিম ছাত্রদেরকে ফিতরা দেওয়া : মাদরাসার গরিব-এতিম ছাত্রদেরকে ফিতরা দেওয়া অধিক উত্তম। কেননা এতে সদকায়ে ফিতর আদায়ের সাথে সাথে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াবও অর্জন হয়।
বাংলাদেশের মুসলমানগণ টাকা দিয়ে ফিতরা আদায় করতে চাইলে দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম মধ্য মানের চালের মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে। সংস্থাটি প্রতিবছর ফিতরার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। এ বছরও সরকার ফিতরার সর্বনিম্ন ৭০ টাকা এবং সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৮০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
তাই আসুন আমরা যথাযথভাবে সদকায়ে ফিতর আদায় করি। গরিব-দুখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মুখে নির্মল হাসি ফোটানোর চেষ্টা করি। আল্লাহ পাক তাওফিক দান করুন। আমিন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সদকাতুল-ফিতর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ