Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

ময়মনসিংহ খাদ্য বিভাগে হরিলুট, অদক্ষতায় বদলী ডিসি ফুড

অফিসে বসে মদ্যপান ও ধানক্রয়ে অনিয়ম তদন্তে কালক্ষেপন-ফের সক্রিয় কালো তালিকাভুক্তরা, উপেক্ষিত ডিসির নির্দেশ

মো: শামসুল আলম খান, বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০২০, ৫:১৬ পিএম

করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশে দূর্যোগ পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলেও হরিলুট চলছে ময়মনসিংহ জেলার খাদ্য বিভাগের সর্বত্র। একের পর এক অনিয়ম দূর্নীতির ঘটনা ফাঁস হবার পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহন করলেও নেপথ্যের কারিগররা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে খাদ্য অধিদপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় দফায় দফায় জেলা খাদ্য বিভাগে দূর্নীতির লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করলেও মিলছে না প্রতিকার।
অভিযোগ উঠেছে, খাদ্য বিভাগের এসব অনিয়ম দূর্নীতির নেপথ্যে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে রহস্যজনক উদাসিন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: জাহাঙ্গীর আলম। উল্টো বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নামমাত্র তদন্তের বেড়াজাল থেকে নিরাপদ প্রস্থানে যেতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন বলেও দাবি একাধিক সূত্রের। এসব কারণেই গত ১৪মে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো: জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুরে বদলী করা হয়েছে।
এদিকে, গত ১৮মে ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় চলতি বছরে অভ্যান্তরিন খাদ্য শষ্য সংগ্রহ অভিযানে নিন্মমানের চাল সরবরাহের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে জেলা প্রশাসনের ভেতরে বাইরে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ জেলা প্রশাসক অভিযুক্ত মিলগুলোর বরাদ্ধ বাতিল করে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাহাঙ্গীর আলম জেলা প্রাশসকের এ আদেশ বাস্তবায়ন না করেই বদলী আদেশে দ্বায়িত্ব হস্থান্তর করে চলে গেছেন। অভিযোগ উঠেছে, মূলত অভিযুক্ত ওই সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই তিনি ডিসির নির্দেশ উপেক্ষা করেছেন।
খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছরে সদর এলাকায় প্রায় ১৩ শত মিট্রিক টন চাল সরকারী ভাবে ক্রয়ের বরাদ্ধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল একাই সরবরাহ করছেন হাজী এগ্রো রাইস মিল ও হাজী অটোর মালিক হাজী মোঃ এরশাদ আলী। খাদ্য বিভাগে তিনি চিহ্নিত দূর্নীতিবাজ। এর আগে তাঁর নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট নামে-বেনামে মিল দেখিয়ে খাদ্য বিভাগের হাজার হাজার টন ধান-চাল লুটপাট করা সহ নানান অনিয়ম দূর্নীতির অভিযোগে সদর এলাকার ২২টি মিল কালো তালিকাভুক্ত করে সরকার। কিন্তু কিছুদিন পর রহস্যজনক ভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে মুছলেকা দিয়ে ফের বরাদ্ধ ভাগিয়ে নেন কালো তালিকাভুক্তরা।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, নিন্মমানের চাল সরবরাহের বিষয়টি তদন্থ করে ব্যবস্থা নিতে জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহ জেলায় সরকারী চাল হরিলুটের ঘটনা অহরহ। এসব ঘটনায় জেলায় প্রায় হাফ ডজন মামলা হলে ৯ জন ডিলার বরখাস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে মুক্তাগাছা উপজেলায় ৩ জন, ত্রিশালে ২, গৌরীপুরে ২,নান্দাইলে ১ ও সদরে ১ জন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসব হরিলুটের ঘটনায় প্রত্যক্ষ মদদদাতা সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করেনি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। সম্প্রতি ফাঁস হওয়ায় চাল হরিলুটের ঘটনায় গৌরীপুরে টানা সাড়ে চার বছর যাবত খাদ্য বান্ধব প্রকল্পে শত শত উপকারভোগীদের চাল আত্মস্বাতের নজির মিলেছে ২নং গৌরীপুর ও ৩নং অচিন্তপুর ইউনিয়নে। একই অভিযোগ রয়েছে ৪ নং মাওহা ও ৯ নং ভাংনামারী ইউনিয়নসহ উপজেলার সব ক’টি ইউনিয়নে।
অভিযোগ উঠেছে, জেলায় খাদ্য বান্ধব কর্মসূচীর আওতায় মোট উপকারভোগী রয়েছেন প্রায় ২ লাখ ৯৮ হাজার। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক কার্ডের চাল বিতরনের নামে গত সাড়ে চার বছর যাবত সংশ্লিষ্ট খাদ্য কর্মকর্তাদের যোগসাজসে আত্মস্বাত হচ্ছে। সরেজমিনে তদন্ত করলে সত্যতা মিলবে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি।
সূত্র জানায়, গৌরীপুরে খাদ্য বান্ধবের আত্মস্বাতকৃত চাল গুদামে রেখেই নতুন ক্রয় অভিযানে সমন্বয় চেষ্টায় জটিলতার কারণে জেলা খাদ্য বিভাগ চলতি অর্থ বছরে এখনো ধান ও চাল ক্রয় অভিযান শুরু করতে পারেনি।
এবিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো: মিজানুর রহমান বলেন, গৌরীপুর উপজেলায় না জানিয়ে চাল ক্রয় অভিযান শুরু করেছিল। আপাদত তা স্থগিত আছে। তিনি জানান, শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সব উপজেলার গুদাম গুলো খালি আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে দ্রুত ক্রয় অভিযান শুরু হবে।
সূত্র জানায়, তারাকান্দা খাদ্য গুদামে বসে খাদ্য কর্তকর্তাদের মদ্যপানের একটি ভিডিও বিগত ২ থেকে ৩ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তদন্ত কমিটি গঠন করে খাদ্য অধিদপ্তর। কিন্তু নামমাত্র তদন্ত শেষে সম্প্রতি প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটির প্রধান ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা এএইচএম কামরুজ্জামান। প্রতিবেদনে তিনি দাবি করেন, ‘মদ্যপানের দৃশ্যটি খাদ্য গুদামের নয়। এই মর্মে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান প্রত্যায়ন দিয়ে জানিয়েছেন খাদ্য গুদামের এএসআই নূর আলম, সাইফুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেনের সাথে মদ্যপানের দৃশ্যটি সত্য। তবে তা চেয়ারম্যানের নিজস্ব বাসভবনের ঘটনা।’
তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার দাবি, তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে অফিসে বসে মদ্যপানের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য খাদ্য গুদামে সুবিধা প্রদানের আশ্বাসে ওই চেয়ারম্যানের কাছ থেকে একটি প্রত্যায়ন নেয়া হয়েছে, মূলত বিষয়টি হালকা করার জন্য।
অভিযোগ রয়েছে, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় খাদ্য অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে এক কর্মকর্তার বদলী হলেও একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও এখনো বহাল তবিয়তে আছেন উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা এএইচএম কামরুজ্জামান।
একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে মুক্তাগাছার উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা শফি আবজালুল আলমের বিরুদ্ধে। তাঁর প্রত্যক্ষ মদদেই চলছে খাদ্য বান্ধবের চাল হরিলুট। বিগত সময়ে এ উপজেলায় একাধিকবার সরকারী চাল পুলিশের হাতে আটক হলেও খাদ্য কর্মকর্তা শফি আবজালুলের ক্যারিশায় ও কালক্ষেপনে তা ধামাচাপা হয়ে যায়। স্থানীয় একাধিক মিলারের অভিযোগ, চলতি বছরের ধান ও চাল ক্রয় অভিযান এখনো শুরু না হলেও ইতিমধ্যে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা গুটি কয়েক ক্ষমতাসীন দলীয় নেতার যোগসাজসে ফড়িয়া সিন্ডিকেট গঠন করেছেন। ফলে অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও এ উপজেলার ক্রয় অভিযানে অনিয়মের শিকার হতে পারেন প্রান্তিক কৃষকরা।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো: সারোয়ার মাহমুদ বলেন, মদ্যপানের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোন অবস্থাতেই খাদ্য বিভাগে কোন ধরনের অনিয়ন সহ্য করা হবে না।
একই ভাবে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ফুলপুর উপজেলায় কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে অনিয়ম-দূর্নীতি এবং ক্রয় অভিযানের লাষ্ট সমন্বয়ে ৫শত মেট্রিক টন বোরো ধান ফড়িয়াদের কাছ থেকে বিল করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয় তৎকালীন গুদাম কর্তকর্তা শাহ মাজাহারুল ইসলাম কামাল। এ ঘটনায় বর্তমানে পঞ্চম ধামে তদন্ত চলমান আছে বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান নেত্রকোনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন।
এ ঘটনার মূল অভিযোগকারী ফুলপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক আহবায়ক মো: জহিরুল ইসলাম দাবি করেন, অভিযুক্ত কর্মকর্তা পদে বহাল থাকার কারণে তদন্ত কার্যক্রম বার বার প্রভাবিত হচ্ছে। আর এ কারণেই তদন্ত কার্যক্রমে কালক্ষেপন হচ্ছে। এতে দূর্নীতিবাজদের পার পেয়ে যাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এসব বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রনালয়ের সচিব ড.নাজমানারা খানুম বলেন, সব ধরনের অনিয়মের ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ধৈর্য্য রাখুন, করোনার কারনে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ময়মনসিংহের একাধিক উপজেলায় অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। এতে অনেকেই অংশীদার আছেন। এক দিনে সব করা যাবে না, ইনশাল্লাহ সবদিক থেকেই পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ