দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পবিত্র কুরানে ইরশাদ হচ্ছে, নিশ্চয় আমি তা (কোরআন) অবর্তীণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্পর্কে আপনি কি জানেন? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সুরা কদর ১-৩) সূরা ক্বদরের ঐতিহাসিক শানে নুযুল: প্রখ্যাত মুফাসিসর ইমাম ইবনে জারীর রহ.এর রেওয়ায়েতে আছে যে, বনী ইসরাঈলের এক ইবাদতকারী ব্যক্তি সারা রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন এবং সারা দিন যুদ্ধে লিপ্ত থাকতেন। এভাবে তিনি এক হাজার মাস কাটিয়ে দেন। সাহাবায়ে কেরাম একথা শুনে বিস্মিত হয়ে বললেন, আমরাতো তার মত পারবোনা, কারন আমরা এতোদিন নাও বাচতে পারি। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা এ সূরা অবতীর্ণ করেনে। আল্লাহ তায়ালা সূরা ক্বদর অবতীর্ণ করে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। এ ঘটনা থেকে আরও প্রতিয়মান হয় যে, শবে ক্বদর উম্মতে মোহাম্মদীরই একটি বৈশিষ্ট্য। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)। বিখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা ইবনে আবি হাতেম রহ. বলেন, পবিত্র রমযান মাসের এক অনন্য শ্রেষ্ঠত্ব হল লাইলাতুল ক্বদর। মহানবী সা. একবার এই রাতকে খোঁজার জন্য একমাস ই’তিকাফ করেন। একবার রাসূল সা. বনী ইসরাইলের চারজন সাধকের কথা বললেন যে, তারা সুদীর্ঘ আশি বছর ধরে এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করেছেন যে, ঐ সময় চোখের পলক মারার মত সময়ও তারা আল্লাহর নাফরমানী করেননি। তারা হলেন আইয়ুব, যাকারিয়া, হিযকিল ইবনে আজুয ও ইউশা ইবনে নূন আ.। কথাগুলো শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চার্যান্বিত হলেন। ফলে নবী সা. এর নিকট হযরত জিবরাঈল আ. এলেন এবং বললেন, আপনার উম্মত সেই সাধকের আশি বছরের ইবাদতের কথা শুনে বিস্ময় হচ্ছে। তাই আল্লাহ তায়ালা এর চেয়েও উত্তম ইবাদত আপনার উম্মতের জন্য নাজিল করেছেন, তা হল সূরা ক্বদর। যাতে বলা হয়েছে যে লাইলাতুল ক্বদরে ইবাদত এক হাজার মাস তথা তিরাশি বছর চার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম। এ সুসংবাদ শুনে রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরাম খুব খুশি হন। কুরআন হাদিসে এ রাতের যেসব বিশেষ গুণ পাওয়া যায় তা হল, এই রাতে কুরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়, এ রাতে আল্লাহপাক বিশেষ নির্দেশে অগণিত ফেরেশতা ও জিবরাঈল আ: অবতরণ করেন এবং ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত এ রাতের প্রত্যেক বিষয় শান্তিময় হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, আকাশের যত তাঁরা তার চেয়েও বেশী রহহমতের ফেরেশতা এ রাতে অবতরণ করেন। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, রাসূল সা. রমযানের শেষ দশকে অন্য সময়ের তুলনায় অধিকতর ইবাদত করতেন। তিনি কেবল একা নন বরং পরিবারবর্গকেও ইবাদতে শামিল করতেন। যেমন, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসতো তখন তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং পরিবারবর্গকেও জাগাতেন। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করত সওয়াব প্রাপ্তির আশায় ক্বদরের রজনীতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে তার পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” (মেশকাত শরীফ) শবে ক্বদরে পড়ার দোয়া: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা›ফু আন্নি। অর্থ: হে আল্লাহ, নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।
আল্লাহ তায়ালা শবে ক্বদরের সুনির্দিষ্ট তারিখটি গোপন রেখেছেন অনেকগুলো হেকমতের কারণে। তন্মধ্যে একটি হল যাতে আল্লাহ প্রেমিক বান্দাগণ সর্বদা এর অনুসন্ধানে থাকে এবং প্রতি রজনীতেই অধিক ইবাদতের মাধ্যমে অসংখ্য নেকি অর্জন করতে পারে।
শবে ক্বদরে আমল: এ রাতে অধিক নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, দুরূদ শরীফ, তাসবিহ পাঠ ইত্যাদি যে কোন ইবাদত করা যায়। নফল নামাজ কোন কোন সূরা দিয়ে পড়তে হবে, মোট কত রাকাত পড়তে হবে এর কোন সুনির্দিষ্টতা নেই। যত রাকাত ইচ্ছা, যে সূরা দিয়ে ইচ্ছা পড়া যায়। পূর্ণ রাত জেগে ইবাদত সম্ভব না হলে যতটুকু সম্ভব ইবাদত করা উচিত। তবে ইশা ও ফজরের নামাজ অবশ্যই জামাতের সাথে আদায় করা উচিত। এতেও পুরো রাত জেগে নফল ইবাদত করার সওয়াব পাওয়া যায়।
রাসূল সা. ইরশাদ করেন, এমনভাবে ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহকে দেখছো। এমনটি না পারলেও অন্তত মনে করবে যেন আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। আমি আল্লাহ তায়ালার দরবারে দাঁড়িয়েছি শুরু থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত পুরা দইু রাকাত নামাজে যদি আমার এই মনোভাব থাকে অবশ্যই তিনি আমার নামাজ কবুল করবেন। বছরের প্রতি রাত আমরা ঘুমাচ্ছি। অন্তত কয়েকটি রাত, শবে মেরাজ, শবে বরাত, শবে কদর এবং দুই ঈদের রাত জাগ্রত থেকে এবাদত করে যদি আল্লাহর দরবারে কাটিয়ে দিই, তাহলে আমাদের লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি হবেনা। কাজেই পুরা রাত আমরা ইবাদত করার চেষ্টা করব। এরপর সুন্দরভাবে শুদ্ধ করে কোরআন তেলওয়াত করার চেষ্টা করব। কুরানে যখন জান্নাতের কথা আসবে, জান্নাত শব্দ আসবে তখন আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরিয়াদ করব, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জান্নাতের অধিকারী করে দাও। আর যখন জাহান্নাম শব্দ আসবে তখনও আল্লাহর কাছে বলব, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দাও। এভাবে কোরআন কারীম তেলাওয়াত করব। এরপর বেশি করে আল্লাহর নবীর উপর দুরুদ শরীফ পাঠ করব। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি একবার আল্লাহর নবীর উপর দুরুদ পাঠ করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার উপর দশটি রহমত নাজিল করবেন, (মুসলিম শরীফ)। যে দোয়ার শুরুতে আল্লাহর নবীর উপর দুরুদ পড়া হয়না আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তা কবুল করেন না। এজন্য দোয়ার শুরুতেও দুরুদ পাঠ করতে হয় এবং শেষেও দুরুদ পাঠ করতে হয়। সংক্ষিপ্ত ও সহজ দুরুদ হচ্ছে, ‘সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বা ‘আসসালাতু ওয়াসসালামু আলা সায়্যিদিল মুরসালীন’ এমন ছোট বড় দুরুদ শরীফ বেশি করে পড়া পড়ব। শবে ক্বদরে বেশী বেশী ইস্তেগফার বা তাওবা করাও উত্তম আমল। তথা খুব ছোট ও লজ্জিত হয়ে আল্লাহকে বলতে হবে, হে আল্লাহ! আমি অনেক গোনাহ করেছি, আজ ক্ষমা চাই এবং আগামীতে এমন গোনাহগুলো আর না করার সংকল্প করছি। এটাকে বলা হয় ইস্তেগফার বা তাওবা। কারণ শবে ক্বদর হল তাওবার রাত, গোনাহ মাফ চাওয়ার রাত। এ জন্য দুরুদ এবং ইস্তেগফার বেশি বেশি আদায় করব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।