Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঠিকাদাররা চরম দুর্দিনে

করোনার আঘাতে থমকে গেছে উন্নয়ন কর্মকান্ড বিশেষ প্রণোদনা ও বকেয়া বিল পরিশোধের দাবি

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১২ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আঘাতে থমকে গেছে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড। এ মহামারীতে দেশে চলমান ছোট-বড় প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চরম আর্থিক সঙ্কট ও দুর্দিনে পড়েছেন দেশের ঠিকাদার ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি সাধারণ ছুটির কারণে অফিস বন্ধ এবং কাজ চলমান না থাকায় তারা কোন বিল উত্তোলন করতে পারছেন না। তাই তাদের উপর নির্ভরশীল লাখো পরিবারের অভাব-অনটনে দিন কাটছে।

ঠিকাদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনাভাইরাসের কারণে শুধু পদ্মা সেতু ছাড়া আর সব বড় বড় প্রকল্পের কাজ এখন বন্ধ। শ্রমিক সঙ্কটে মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অন্যান্য প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, রেলওয়েসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের ছোট বড় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে। জেলা পর্যায়ে এলজিইডি কিছু কাজ শুরু হলেও ঠিকাদাররা তাদের বিল পাচ্ছেন না। এ জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না।

অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের অনেক বড় বড় প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় আছে অনেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। তারা ভাবছে অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া সব প্রকল্পের কাজ কি আগের মতোই চলবে নাকি কিছু কিছু প্রকল্প অর্থের অপ্রতুলতার কারণে থেমে যাবে। ইতিমধ্যে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অর্থ কাটছাঁট করে তা মানুষের জন্য ব্যয় করা হবে। যাতে মহামারীর কারণে মানুষের খাবারের অভাব না হয়। যদি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ কাটছাঁট করা হয় তাহলে অনেক প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সেই বর্ধিত ব্যয় কিভাবে সমন্বয় করা হবে এসব বিষয়ও ঠিকাদাররা চিন্তিত। তারা বলছেন সরকার গার্মেন্টস সেক্টরসহ অন্যান্য খাতে প্রনোদনা দিচ্ছে। কিন্তু হাজার হাজার কোটি টাকার এই বিশাল নির্মাণ খাতের দিকে কোন নজর নেই। এ খাতকে সচল রাখতে সরকারের কাছে তারা বিশেষ প্রনোদনার দাবি করেন।

এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশিদ খান বলেন, করোনা সঙ্কটে সারাদেশেই এলজিইডির উন্নয়ন ও মেরামত কাজ চলছে। সামাজিক-শারিরিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে এসব কাজ করা হচ্ছে। যে সব কাজ চলছে সেগুলোর ঠিকাদারদেরকেও সমুদয় পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে। ঠিকাদারদের বিল বা পাওনা নিয়ে কোন সমস্যা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকদেরকে সেভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে যাতে কারো টাকা আটকে না থাকে। আমার জানা মতে, এলজিইডিতে ঠিকাদারদের বিল নিয়ে কোনো সমস্যা বা ঝামেলা নেই।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করেন এমন একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানায় তাদের অনেক প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে করোনার কারণে সব কাজ বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্প সাইটে যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী অরক্ষিত পড়ে আছে। চুরি, লোপাটের শঙ্কাও রয়েছে। রোদে-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। নির্মাণ সমাগ্রীসহ অন্যান্য বিষয় মিলিয়ে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া কাজ বন্ধ থাকায় তারা বিল পাচ্ছেন না। অনেকে ব্যাংক থেকে লোন করে প্রকল্পের কাজ করছেন। এখন সেই লোনের ইন্টারেস্ট দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে তাদের দিন কাটছে।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদার মো. রাসেল বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের সব কাজ বন্ধ। অফিস বন্ধ থাকায় বিল তুলতে পারছি না। সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা দুর্বিষহ। না পারছি চলতে, না পারছি কাউকে বলতে। কয়েকটি কাজের প্রায় কোটি টাকার বিল বকেয়া। এদিকে ব্যাংকের লোনের তাগাদা, শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন, নিজেদের সংসার চলানো সব মিলিয়ে আমরা চরম দুর্দিনের মধ্যে পড়েছি। সরকার বিভিন্ন সেক্টরে প্রনোদনা দিচ্ছে। আমাদের প্রনোদনা না দিলে বকেয়া বিলগুলো পরিশোধের ব্যবস্থা করলেও কিছুটা রক্ষা পাই।

আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চরম আর্থিক সঙ্কট ও দুর্দিনে পড়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঠিকাদারগণ এবং তাদের শ্রমিক-কর্মচারীরা। তারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মহীন। তাদের উপর নির্ভরশীল লাখো পরিবারে অভাব-অনটন, হাহাকার। কাজকর্ম বন্ধের সাথেই অর্থের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সঙ্কটে ঠিকাদাররা। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চয়তায় দিন পার করছেন। নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহকারীদের অবস্থাও নাজুক। তাদের সাথে জড়িত হাজার হাজার লোক বেকার।

করোনা মহাদুর্যোগের ধাক্কায় বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে চলমান প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, কর্ণফুলী গ্যাস, সড়ক ও জনপথ, বিদ্যুৎ বিভাগ, এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, রেলওয়ে, জেলা ও উপজেলা পরিষদসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের ছোট বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন থমকে গেছে। তাছাড়া অধিকাংশ অফিস বন্ধ।

প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, সব ধরনের উন্নয়ন কাজ বন্ধ। কারণ কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। এতে করে সংশ্লিষ্টরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তাও অনিশ্চিত। ঠিকাদার আব্দুল কাদের বলেন, দুর্যোগ পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে। অনেক ঠিকাদার বিল পাচ্ছেন না। শ্রমিকের মজুরি আর সরবরাহকারীর বকেয়া পরিশোধ করা যাচ্ছে না। প্রকল্প সাইটে যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী অরক্ষিত পড়ে আছে। চুরি, লোপাটের শঙ্কাও রয়েছে। রোদে-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সামগ্রী। যথাসময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়েও সংশয় রয়েছে।

যশোর ব্যুরো জানায়, করোনাভাইরাসে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। দিন এনে দিন খাওয়া হাজার হাজার শ্রমিক রয়েছেন বেকার। কোন কাজকর্ম হচ্ছে না। এই চিত্র যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের।

এলজিইডি, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশলসহ সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারি কাজ করোনায় বন্ধ রয়েছে। যশোরের বিশিষ্ট ঠিকাদার শওকত আলী বললেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোন ধরণের ঠিকাদারি কাজকর্ম করা অসম্ভব ব্যাপার। ব্যক্তিক দুরত্ব বজায় রেখে নির্মাণ করা হয় কঠিন। তাই কাজ বন্ধ রয়েছে। কাজ বন্ধ থাকায় শ্রমিক কর্মচারিরা হয়ে পড়েছেন বেকার। ছোটখাটো ঠিকাদারদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা। সারাবছর কাজ করে সাধারণত জুনের ১৫তারিখের মধ্যে বিল দাখিল করতে হয়। বিল পেয়ে বাকি বকেয়া পরিশোধ করা হয়। এবার সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক ক্ষতি করলো বিরাট এই করোনা

শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তরের প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার মোবাসের বাবু বললেন, বিল আটকা রয়েছে, সাইডের কাজকর্ম বন্ধ, ঘরবন্দি হয়ে আছি হাতগুটিয়ে, আমাদের শ্রমিক কর্মচারিরাও দারুণ সমস্যায় রয়েছে।



 

Show all comments
  • Chandni Mala ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৬ এএম says : 0
    পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যা শেষ নাহওয়া পর্যন্ত এই রোগ চলবেই । এই রোগ এসেছে অমানুষকে মানুষ বানাতে । এখন কেউ আর দলবদ্ধ হয়ে কারো ওপর আক্রমণ করতে পারবে না ।
    Total Reply(0) Reply
  • Azizul Islam ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বা আইন পরিপন্থী চলা পছন্দ করে,, সরকার যখন বলছে ঘরে থাকুন,, লকডাউন তা অমান্য করে বাহির হইছে,, আজ সসরকার লকডাউন শিথিল করছে,,মানুষঘরে থাকার কথা ভাবছেন
    Total Reply(0) Reply
  • Ziared Rahman ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৭ এএম says : 0
    আমাদের দেশে লকডাউন থাকলেও যদি লাখো মানুষ আক্রান্ত হয় সেই পরিক্ষা হবে ৫ হাজার আর লকডাউন শিথিল করলেও লাখো মানুষ আক্রান্ত হলে পরিক্ষা হবে ৫হাজার। লকডাউন দরকার নেই সবাই সাবধান থাকবেন তাই হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Dara P Sn ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৮ এএম says : 0
    গরীবের এাণ সঠিক ভাবে দেন লকডাউন কঠোর করেন এই করবো সেই করবো দয়াকরে ওটা বন্ধ করেন। আজ সকাল থেখে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংক্রামন হয়েছে দেখেন একদিনে কোথায় যায় লকডাউন ছাড়া!!! হবে। পুলিশ প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিতে পাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Abu Hossain Siddik Rana ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৮ এএম says : 0
    ক্রমাগত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে, এই অবস্থা থেকে একমাত্র বাঁচার ও মারার মালিক আল্লাহ পাকের হাতে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sahrior Kamal ১১ মে, ২০২০, ১২:৪৯ এএম says : 0
    আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ভালই জানেন। আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দিন আনে দিন খায় এই মানুষের সংখ্যাই বেশি ,তাদের তো জমাচালান নেই যে বসেবসে ছয়মাস চলতে পারবে।তাই তাদের দুটোদিকেই কঠিন সমস্যা ঘরে বসে থাকলে পরিবারনিয়ে নাখেয়ে মরতে হবে আবার বাইরে বেরুলে করোনা আক্রান্তে মরতে হবে তাই ঐ ভাল কিছু পেটে দিয়ে মরে যাওয়া তুলনামূলকভাবে শ্রেয়।মানুষ চায়না ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে তারা বাহিরে বেরুবেই সুতরাং সরকারের কিছু করার নেই। সরকার দেশের মানুষের জন্য কম করেনি।আমি বা আপনি সরকারের যায়গায় থাকলে কী করতে পারতাম? এই বাংলাদেশের মানুষ অধিকাংশ অসচেতন তাই নিজের গরু কোনযায়গা থেকে জবাই করবে সেটা তার নিজের বিষয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ