Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাজেটে চার খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ

সিপিডি’র ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০২০, ১২:০১ এএম

আগামী অর্থবছরের বাজেটে চারটি খাতকে প্রাধান্য দেওয়ার সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। একই সঙ্গে আগামী অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরের কর যেন আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত কিস্তিতে দেওয়া যায়, তা বিবেচনা করার কথাও বলেছে গবেষণা সংস্থাটি।

গতকাল শনিবার ‘কোভিড-১৯ বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাজেট ২০২০-২১’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন সংস্থার ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ ফেলো তৌফিক ইসলাম।

সংবাদ সম্মেলনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা স্বস্তি দিতে টার্নওভার কর অব্যাহতির সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকায় উন্নীত করা সুপারিশ করা হয়েছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের প্রস্তাব করে সিপিডি বলছে, কর হার না বাড়িয়ে কর ফাঁকি বন্ধে বেশি মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিতে হবে।

আগামী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে চারটি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে। খাতগুলো হলো- স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং কর্মসংস্থান। এ জন্য অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করবে, অর্থনৈতিক গতি তরান্বিত করবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এমন ব্যয় রেখে, অপ্রয়োজনয় ও অনুৎপাদনশীল ব্যয় কাটছাঁট করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।

সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) কমপক্ষে দুই শতাংশ করতে বলেছে বলা হয়েছে। সংস্থার পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেট প্রস্তাবনায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের মূসক নেটের বাইরে রাখার জন্য বার্ষিক টার্ণওভার ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি টাকা পর্যন্ত মূসক অব্যাহতি প্রদান করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সিপিডি বলছে, এটি করলে ছোট ব্যবসীরা কিছু সুবিধা পাবেন। এতে সরকারের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তাছাড়া করোনায় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা চাঙা রাখতে ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো উচিত। এটি এখন আড়াই লাখ টাকা আছে। বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা এবং পাশাপাশি করের হারও কমানোর প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। করপোরেট ট্যাক্স কমানোর বিষয়ে সাবধান হওয়ার পশামর্শ দিয়েছে সিপিডি। কারণ এ ট্যাক্স কমালে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে কোন ধরণের চাপ আসবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। এখন যে পরিমাণ সরকারি ব্যয় প্রয়োজন রয়েছে এটি বিবেচনায় নিলে করপোরেট কর না কমানোই ভালো বলে মনে করছে সিপিডি।

প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্য খাতের জন্য যে বরাদ্দ করা প্রয়োজন, সেটা আমরা করিনি। জনগণ ব্যয় করছেন তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। স্বাস্থ্য খাতে নিজের পকেট থেকে অর্থ খরচ করার দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার উপরে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ আমাদের সম্পূর্ণ বাজেটের সাড়ে ৫ শতাংশের মতো, ১০ হাজার কোটি টাকা। এটা বাড়াতে হবে। এটাকে আমাদের ২ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি কোন জায়গাতে এটা ব্যবহার হচ্ছে তাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি, মেডিকেল টেকনিশিয়ানে ২০১৩ সালের পর কোনো ধরনের নিয়োগ হয়নি। এখন সরকার জরুরি ভিত্তিতে বেশ কিছু নিয়োগে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে তো একটা দক্ষতার প্রয়োজন। এগুলো ধারাবাহিকভাবে না করল আমরা ফল পাবো না। সুতরাং এখানে শুধু টাকা বিষয় নয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রতিষেধক কর্মকান্ডগুলো ধারাবাহিকভাবে শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় জিডিপির ১.১২ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল। সেটাই পূরণ করতে পারেনি। এই ১.১২ শতাংশই কিন্তু কম, অন্যান্য দেশের তুলনায়। প্রতিবেশী ভারতের দুই শতাংশের উপরে। আমাদের নিজেদের লক্ষ্যমাত্রাটা পূরণ করতে পারিনি। সুতরাং যে লক্ষ্যমাত্রা আমাদের নীতিমালায় রয়েছে তা পূরণ করতে হবে। তবে শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, ব্যবস্থাপনাটাও বড় বিষয়। স্বাস্থ্য খাতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। সেটা ২ শতাংশ করা উচিত।

কর ফাঁকি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রত্যক্ষ কর সাধারণ মানুষের ওপরই বেশি পড়ে। এটা আদায় করা সহজ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বিভিন্ন ব্যয় করতে হয়, সেই ব্যয়ের ওপর ট্যাক্স আরোপ করলে তা আদায় করা সহজ। তবে আমরা আরও একটু কঠিনভাবে যাওয়ার জন্য বলেছি। কর ফাঁকি যেন খুবই শক্ত হাতে দমন করা হয়। জনগণের যে টাকা করের মাধ্যমে আসার কথা আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে সেটা আসে না। আমাদের ট্যাক্স-জিডিপির হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ১০ শতাংশের মতো। আমাদের যদি ১৮ শতাংশ ট্যাক্স-জিডিপি থাকতো তাহলে ঝুঁঁকি মোকাবিলার অনেক শক্তি থাকত।

তিনি বলেন, আমি এখন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছি। খোলার যখন প্রয়োজন না তখন খুলতে বাধ্য হচ্ছি। এর বড় কারণ আমার হাতে ওই ধরনের শক্তিমত্তা নেই। আর্থিক সক্ষমতা নেই, যে সক্ষমতা দিয়ে এগুলোকে আমি আরও কিছুদিন মোকাবিলা করতে পারি। অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্নভাবে গত ১০ বছরে ৫ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে পাচার হওয়া টাকা তার পাঁচগুণ। এই টাকার একটা অংশও যদি দেশে থাকতো, তাহলে অর্থনীতির একটা কাজে আসত এবং সরকার একটা ট্যাক্স পেত। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে- বড় সংখ্যার প্রবাসীরা ফেরত আসতে পারেন। তাদের কীভাবে আমরা এখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব, এ বিষয় আমাদের একটা চিন্তাভাবনা থাকা উচিত।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে সারাবিশ্বের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেখানে সাপ্লাই চেন, চাহিদার ওপর চাপ পড়েছে। যার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। দেশের ভেতরেও অর্থনীতির অনেক খাত বিচ্ছিন্ন ও বন্ধ রয়েছে। যার কারণে অর্থনীতির ওপর আরেকটা চাপ পড়েছে। এমন অবস্থায় আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশ কখনোই এ ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়েনি। সেজন্য এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা। সুতরাং এবারের বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে অনেক ধরনের চাপ, সমস্যা, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হতে হবে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা সম্পর্কে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই প্রণোদনার ৮০ শতাংশ টাকা ব্যাংকগুলোকে জোগান দিতে হবে। ব্যাংক খাত এমনিতেই দুর্বল। এখানে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বেশি। অনেক প্রভাবশালী ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি আছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো-ব্যাংকগুলো প্রণোদনার টাকা দিতে কীভাবে প্রতিষ্ঠান বাছাই করবে। কেননা অতীতের মতো এবারও সুযোগ সন্ধানীরা এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারেন। ফাহমিদা খাতুন বলেন, অনলাইন জরিপে ৯৩ শতাংশ বর্তমান প্রেক্ষাপটে শপিংমল না খোলার এবং ৯৬ শতাংশ শপিংমলে না যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। জীবন ও জীবিকা দুটোই প্রয়োজন আছে। তবে জীবন যদি না থাকে, সেই জীবিকা দিয়ে কী প্রয়োজন। সুতরাং এজন্য সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের অপ্রয়োজনীয় খরচ যেমন কমানো উচিত, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগে বিরত থাকতে হবে। যেমন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ, করপোরেশনগুলোর সম্পদ কেনায় বিনিয়োগ ইত্যাদি। বাজেটে প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান।



 

Show all comments
  • Munna Munna ১০ মে, ২০২০, ১২:৫৯ এএম says : 0
    এই মহামারিতে ব্যাবসায়ী এবং নেতারা সরকারী টাকা মারার সুযোগের অপেক্ষায় আছে
    Total Reply(0) Reply
  • Liton Roy ১০ মে, ২০২০, ১:০০ এএম says : 0
    সরকার নিজের মতো করে বাজেট পাস করছেন কিন্তুু সেই টাকা তো আমার পরিবার পাইনি। তাহলে চোর দের জন্য পাস করেছেন টাকা গুলো।
    Total Reply(0) Reply
  • Aksho Kuri Zanata ১০ মে, ২০২০, ১:০৩ এএম says : 0
    তাহলে কালো টাকার কি হবে
    Total Reply(0) Reply
  • এন আই মাহমুদ ১০ মে, ২০২০, ১:০৩ এএম says : 0
    1) স্টার্টাপ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উপর থেকে ট্যাক্স ও সিস্টেম কস্ট প্রত্যাহার করে মুক্ত বাণিজ্য প্রমোট করলেই বরং অর্থনীতি নিজ থেকে একটু উন্নত হতে পারে। ট্যাক্সের উপর সরকারের এত বেশী নির্ভরতাই উন্নয়নের বড় বাধা। কারণ ট্যাক্স ব্যয়ের ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছতা ও জবাব দিহিতা নেই। 2) ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মচারীদের বেতন নিয়ে টালবাহানা বন্ধ করতে আইনী পদক্ষেপ প্রয়োজন। 3) ট্রেড লাইসেন্স ফি, নতুন বিজনেস এ মিনিমাম আয়কর ইত্যাদি সিস্টেম কস্ট কমাতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাজেট

১৩ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ