দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
উত্তর : রমজান মাস আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নিয়ামত। এই মাসে আল্লাহর পাকের রহমত বরকতের বন্যা বয়ে চলে। তবে আমরা এ বরকতময় মাসের মূল্যায়ন করতে জানিনা। কেননা আমাদের পুরা চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা পার্থিব বস্তুবাদের জন্য। এ বরকতময় মাসের মর্যাদা তারাই করেন যাদের ফিকির থাকে আখেরাতের প্রতি। রাসূলের এ হাদিসটি আমাদের সবারই জানা। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রজব মাস উপস্থিত হলে রাসূল (সা.) এই দোয়া পড়তেন। ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ: হে আল্লাহ! রজব মাস ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন; রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমদ ১/২৫৯; বাইহাকি, শুআবুল ঈমান ৩/৩৭৫; তাবরানী, আল-মু‘জামুল আওসাত, হাদিস ৩৯৩৯)।
চিন্তা করে দেখুন রমজানুল মুবারক আগমনের দুই মাস পূর্বেই রমজানের অপেক্ষা এবং এর প্রতি আগ্রহ হতো। এর জন্য দোয়া করা হতো। এ কাজ ঐ ব্যক্তিই করতে পারেন যার অন্তরে রমজানুল মুবারকের সঠিক কদর এবং মূল্যায়ন জাগরুক থাকে।
রমজান শব্দের অর্থ : রমজান আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো জালিয়ে দেয়া। রমজানকে রমজান বলা হয়, কারণ ইসলামের যুগে যখন সর্বপ্রথম এ মাস আসলো তখন অত্যন্ত তীব্র গরম ছিল। যা কেমন যেন সব জালিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু কতিপয় আলেম বলেছেন রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা খাস রহমতের দ্বারা রোজাদার বান্দার গোনাহগুলো জালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেন এবং ক্ষমা করে দেন। এজন্য এ মাসকে রমজান বলা হয়।’-(শরহে আবু দাউদ লিল আইনি ৫/২৭৩)।
রমজান রহমতের বিশেষ মাস : আল্লাহ তায়ালা এ বরকতময় মাস এইজন্য দিয়েছেন যে, এগার মাস মানুষ দুনিয়াবি ধান্দায় নিমজ্জিত থাকে। যার কারণে অন্তরে গাফলত এবং অলসতা বাসা বাঁধে। রুহানিয়াত এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে ত্রু টি পরিলক্ষিত হতে থাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই রমজান মাসে মানুষ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে এই ত্রু টি দূর করতে পারে। অন্তরের গাফলতি এবং জং খতম করতে পারে। যাতে আল্লাহ পাকের নৈকট্য অর্জন করে জিন্দেগির এক নতুন পর্ব শুরু করা যায়। কোনো একটি মেশিন যেমন কিছুদিন ব্যবহারের পর একে ক্লিনিং বা সার্ভিসিং করতে হয়। ঠিক এভাবে মানুষের পরিচ্ছন্নতা এবং সার্ভিসিংয়ের জন্য এ বরকতময় মাস করুণার আধার আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারণ করা হয়েছে।
রোজার উদ্দেশ্য : রোজার মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য এবং আলোচ্যবিষয় এটাই যে, এর মাধ্যমে মানুষের পশুত্বকে আল্লাহ অন্তর থেকে বের করে দেবেন। আল্লাহর দেয়া বিধি-বিধানের পাবন্দির ওপর উঠিয়ে একনিষ্ঠ করে নিবেন। আরো কাছে নিবেন। আল্লাহর বিধানের মোকাবেলায় নফসের গোলামি এবং পেট কুপ্রবৃত্তির চাহিদাকে দাবানোর অভ্যাস করাবেন। আর এটা অব্যশ্য নবুওয়ত এবং শরিয়তের বিশেষ উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত। এজন্য পূর্ববর্তী সকল শরিয়তেও রোজার বিধান ছিল। যদিও রোজার সময় এবং বিস্তারিত বিধি-বিধানে ঐ সকল জাতির বিশেষ অবস্থা এবং প্রয়োজনের দিক লক্ষ করে কিছুটা তফাৎ ছিল। কুরআনুল কারিমে এই উম্মতকে রোজার আদেশ করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতিও; যাতে করে তোমরা পরহেজগার হতে পারো।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)। এ আয়াত থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আল্লাহ বলেছেন-যারা রোজা রাখবে তারা মুত্তাকি হতে পারবে, তাকওয়াবান হতে পারবে।
কুরআনে তাকওয়া অনুযায়ী চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তারা তাকওয়া অর্জন করো।’ (সূরা আহজাব, আয়াত : ৭০)।
আল্লাহ পাক আরও বলেন, ‘যারা ঈমান আনলো এবং তাকওয়া লাভ করলো, তারা আল্লাহর বন্ধু; তাদের কোনো ভয় নেই, দুশ্চিন্তাও নেই।’ (সূরা ইউনুস, আয়াত : ৬২)।
একথা নিশ্চিত যে, মানুষের মন মানুষকে গোনাহ, নাফরমানি এবং পাশবিক চাহিদার মধ্যে তখনই বেশি লিপ্ত করে যখন সে তৃপ্ত থাকে। পক্ষান্তরে ক্ষুধার্ত থাকলে পাপকাজ করার উদ্যমতায় ভাটা পড়ে। অতঃপর পাপকাজ করার অত চিন্তা করে না। রোজার উদ্দেশ্যও নফসকে ক্ষুধার্ত রেখে জৈবিক চাহিদাকে কার্যত পরিণত করতে বাঁধা দেয়া। যাতে গোনাহে করার জযবা শিথিল হয়ে আসে। এর নামই হলো তাকওয়া।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, প্রত্যেক জিনিসের যাকাত আছে, আর শরীরের যাকাত হলো রোজা।’-(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৭৪৫)। অর্থাৎ জাকাত আদায় করলে যেভাবে ধন-সম্পদ পবিত্র হয়। ঠিক তেমনি রোজা পালন করলে শরীর পবিত্র হয়।
তারাবির নামাজ : রমজানে দিনের বেলায় রোজার পাশাপাশি রাতের বেলায় রয়েছে বিশেষ ইবাদতের ব্যাপক এবং ইজতেমায়ি নেযাম। যার কারণে এই বরকতময় মাসের নূরানিয়াত এবং প্রভাব আরও অনেক গুণ বেড়ে যায়। হাদিস শরিফে তারাবিহ নামাজের অনেক সওয়াবের কথা এসেছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে ও সওয়াব লাভের প্রত্যাশায় রোজা রাখে তার পূর্বের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস ৭৬০)।
আত্মশুদ্ধি অর্জন : রোজা পালন করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন হয়। রোজাদার নিজের ভুল-ত্রটি শুধরানোর আপ্রান চেষ্টা চালান। এতে করে তার ভেতরে ভবিষ্যতেও পাপকাজ থেকে বেঁচে থাকার উৎসাহ আগ্রহ তৈরি হয়। এ মর্মে বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, ‘যে লোক ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে তার পূববর্তী ও পরবর্তী সব গোনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ ((সহিহ বুখারি, হাদিস ৩৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস ৭৬০)।
রোজা ঢালস্বরূপ: হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা হলো (গোনাহ ও জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষার) ঢাল। রোজা মানুষকে গোনাহ থেকে বাচিয়ে রাখে। (সহিহ বুখারি, হাদিস ১৯০৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১১৫১)।
রাসূলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার আছে যাদের রোজা উপবাস ছাড়া আর কিছুই হয় না।’ অর্থাৎ যারা রোজা রেখেও মানুষের গিবত-শেকায়েত, মিথ্যাসহ অনেক রকম পাপাচারে নিমজ্জিত থাকে তাদের উপবাস ছাড়া কিছুই অর্জন হয় না। রোজার যে মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া তাও অর্জন হয় না।
উত্তর দিচ্ছেন : মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।