Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনা পরিস্থিতিতেও অর্থ ছাড়ে গড়িমসি

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অন্যান্য সময়ের মতোই নানা শর্তের বেড়াজাল

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০২০, ১২:০২ এএম

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক পুরনো বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দুরদর্শী নানা সিদ্ধান্তের পরও কোনোভাবেই পিছু ছাড়ছে না এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আর এ কারণে থমকে পড়ছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন। বছর শেষ হলেও অর্থ ছাড় না হওয়ায় পরবর্তীতে অর্থ ফেরত যাওয়ারও বহু নজির রয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়াদের শেষ সময়ে অর্থ ছাড় হলেও তা পুরোপুরি ব্যবহারও সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তখন বাধ্য হয়ে ৯/৬ করে টাকা খরচ করে বিপাকে পড়ে। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয় নানা ধরনের শর্ত আরোপ করে দেয়ায় শেষ সময়ে টাকা পেলেও তা আর উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। ততোদিনে উন্নয়ন কাজের গতি অনেকটা মন্থর হয়ে যায়। এমনকি বর্তমান করোনা মহামারী পরিস্থিতির মতো একটি জরুরি ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে বের হতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেই পূর্ব প্রস্তুতি এবং চীনের ভয়াবহতা দেখে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা চেয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যা ছিল পরিস্থিতির বিবেচনায় খুবই অপ্রতুল। অথচ এই মহামারীর জটিল সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় সে বরাদ্দ থেকে মাত্র ৫০ কোটি টাকা ছাড় করে। তাও আবার বিলম্ব করে। আবার এই টাকা খরচেও আবার নানা শর্তজুড়ে দেয়া হয়। যাতে স্বাভাবিকভাবে খরচ করতে না পারে। এদিকে সূত্র জানিয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বর্তমান মহামারীর সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কাছে ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল ক্রয় বাবদ অর্থ চেয়ে আবেদন করলেও অর্থ বিভাগ সেটা কমিয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন করে দেয়। অথচ বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই চাল ক্রয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যা প্রধানমন্ত্রীরও একটি অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশনা।

করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সমালোচনা করে আসছে। নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যার্থতা অনেকটাই দৃশ্যমান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের ব্যার্থতার দায় এড়াতে পারে না। কিন্তু নানান ব্যর্থতা থাকার পরেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায়ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অর্থের অভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেও সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের ২০টি উপজেলায় ২০টি অত্যধুনিক হাসপাতালের ভবন নির্মাণ দীর্ঘদিন আগে শেষ করা হলেও অর্থের অভাবে সেই হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার-নার্স প্রদান এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রসামগ্রী কিছুই ক্রয় করা হয়নি। যে কারণে হাসপাতালগুলো চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় অত্যাধুনিক এই ভবনগুলো নষ্ট হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ রকম অনেক প্রকল্প প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে অনেকটা স্থবির আছে।

বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিচ্ছেন বর্তমানর করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আগামী বাজেট থেকেই প্রতিবছর সরকারের স্বাস্থ্যখাতে সর্বোচ্চ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনেকটাই আমালাদের উপর নির্ভরশীল। এখনও কাজগুলো সেই গতানুগতিকই চলছে। এমনকি বর্তমান করোনা মোকাবেলার জরুরি পরিস্থিতিতেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কোনোভাবেই কমানো যায়নি। যা অবাক করেছে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অর্থমন্ত্রণালয়ের উচিত জনহিতকর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়ন। অর্থ বিভাগের দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘোরপ্যাঁচ, দীর্ঘসূত্রীতা দূর করে সহজীকরণে পদক্ষেপ নেওয়াটা এখন জরুরিভাবে দরকার। এবং সময়ের দাবি। যাতে সহজে অর্থ ছাড় হয়।

করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয়কেই বরাদ্দ দেয়া অর্থ শর্ত ও নিয়ম-কানুন শিথিল করে দ্রুত সেই অর্থ ছাড় করার প্রয়োজন অর্থ মন্ত্রণালয়ের। দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচ প্রদর্শন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ধরণের অনাবশ্যক ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনের জটিল দীর্ঘসূত্রীতায় ফেলে কর্তৃত্ব প্রর্দশন।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর যেখানে দেশ কিভাবে আরো সামনে এগোবে, কিভাবে দেশের মানুষের কল্যাণ হবে তা নিয়ে আমরা ভাববো। অথচ এদেশের ট্রাজেডি হলো আমলাতন্ত্রের লাল ফিতের ‘দৌরাত্ম্যে’ এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় আমাদের স্বাভাবিক কাজে প্রচন্ড প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, একটি হাসপাতালে হিসাব অনুযায়ী ১০০ জন আউট সোর্সিং জনবলের বাজেট দিলে অর্থ বিভাগ কেটে ৪০/৫০ জন করে দেয়। যা হাসপাতালের স্বাভাবিক কাজকে বাধাগ্রস্ত করে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এ কর্মকর্তা বলেন, এখনও প্রত্যেকটি কাজকে তারা বাধাগ্রস্ত করছে। একই সঙ্গে এটা এক ধরণের ক্ষমতার অপব্যবহারও। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের জালে এমনভাবে আটকায় যে এ থেকে বের হতে পারে না অন্য মন্ত্রণালয়গুলো। আর এ কারণে অর্থ ছাড়ের আগেই বছর শেষ হয়ে যায়। পরে সেই অর্থ ফেরত যায় দাতা সংস্থা বা সরকারের কোষাগারে। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক উন্নয়ন।

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দকৃত এ অর্থ ব্যয়ের শর্তগুলো হচ্ছে- অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস-২০০৮ অনুসরণসহ যাবতীয় সরকারি আর্থিক বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করতে হবে। এ অর্থ প্রস্তাবিত খাত (করোনাভাইরাস বা ‘কোভিড-১৯’) ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না।
বরাদ্দকৃত অর্থ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের সংশ্লিষ্ট খাতে সমন্বয় করতে হবে। এ খাতে অর্থ অন্য খাতে পুনঃউপযোজন বা স্থানান্তর করা যাবে না। অব্যয়িত অর্থ (যদি থাকে) এ বছরের ৩০ জুনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। এছাড়া অর্থ ব্যয়ের ১০ দিনের মধ্যে কোন কোন খাতে কত ব্যয় হয়েছে তার বিস্তারিত অর্থ বিভাগকে জানাতে হবে।

এর আগে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এই প্রশংসনীয় সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা তখন বিরোধীতা করেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশ সত্তে¡ও বাস্তবায়নে অনীহা ছিল তাদের। অর্থমন্ত্রী কঠোর অবস্থানে থাকায় পরে বাধ্য হয় এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য হয়। অথচ এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রবাসীরা উপকৃত হয়েছেন এবং পরবর্তীতে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ অনেকটা বেড়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল, থাকবে। বিষয়গুলো রাজনীতিবিদরা দেখবেন। মন্ত্রীতো রাজনীতিবীদ। তিনি বিষয়গুলো দেখবেন। তবে আর্থিক শৃঙ্খলারও একটা বিষয় আছে। না হলে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাই তারা হয়তো দেখেশুনে বাস্তবায়ন করছে। একই সঙ্গে অভিভাবক শক্ত না থাকলে অপব্যবহারও হতে পারে বলে উল্লেখ করেন প্রফেসর আবু আহমেদ।



 

Show all comments
  • কে এম শাকীর ৭ মে, ২০২০, ১২:৫৯ এএম says : 0
    ইনকিলাবকে ধন্যবাদ। বর্তমানে প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ে রিপোর্ট করায়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেভাবেই হোক কাটাতে হবে নতুবা দেশের উন্নয়ন গতি থমকে যাবে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ৭ মে, ২০২০, ১:০০ এএম says : 0
    দেখা যাচ্ছে যে- এমনও হতে পারে করোনার জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থ ছাড় করতে করতে করোনা চলে গেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • মশিউর ইসলাম ৭ মে, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
    করোনা মোকাবেলার জন্য যেসব অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আমি তা দ্রুত বিকল্প উপায়ে ছাড় করার জন্য অনুরোধ করবো।
    Total Reply(0) Reply
  • কায়সার মুহম্মদ ফাহাদ ৭ মে, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
    মাননীয় অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ- বিসয়টিতে আরেকটি নজর দিন। আশা করি আপনার নেতৃত্বে এর একটা সুরাহা হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • চাদের আলো ৭ মে, ২০২০, ১:০২ এএম says : 0
    এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতির পেছনে বড় বাধা।
    Total Reply(0) Reply
  • শওকত আকবর ৭ মে, ২০২০, ৮:৪২ এএম says : 0
    আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা আমাদের দেশের একটা জাতিয় সমাস্যা।ইহা অনেক আগে থেকেই ছিল আজও আছে মনে হয় ভবিস্বাতে ও থাকবে।এখন এ দুঃসময় যাতে অতি দ্রুত ছাড় পাওয়া যায়,তার প্রতি নজর দেওয়া হোক।এ রিপোর্টটি করার জন্য ইনকিলাব কে ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • James Bimal Gomes ৭ মে, ২০২০, ৯:২৫ এএম says : 0
    এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়
    Total Reply(0) Reply
  • আবেদ খান ৭ মে, ২০২০, ৯:২৬ এএম says : 0
    স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর যেখানে দেশ কিভাবে আরো সামনে এগোবে, কিভাবে দেশের মানুষের কল্যাণ হবে তা নিয়ে আমরা ভাববো। অথচ এদেশের ট্রাজেডি হলো আমলাতন্ত্রের লাল ফিতের ‘দৌরাত্ম্যে’ এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ