বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ
না, তুরস্কে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। মূলত জনপ্রতিরোধের প্রচ-তায় সফল হয়নি সামরিক অভ্যুত্থান, ব্যর্থ হয়েছে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা। চারটি সামরিক অভুত্থানের সাফল্যের পর এই প্রথমবার অস্ত্রধারী সেনা নয়, জয়ী হয়েছে তুরস্কের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। সামরিক শাসন নয়, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। এর প্রথম কৃতিত্ব এরদোগানের, তারপরের সকল কৃতিত্ব তুরস্কের এরদোগান অনুসারী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের, এরদোগান সমর্থক সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের। নূ্যূনতম পক্ষে ৩শ’ জন মানুষের তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে তুরস্কে এখনো গণতন্ত্র বজায় রয়েছে, এরদোগান হয়ে উঠেছেন নায়ক থেকে মহানায়ক। ছিলেন জনগণের নেতা, এবার তিনি যেন হয়ে উঠেছেন তুরস্কের সুলতান। তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগ রয়েছে, ইসলামিক স্টেটকে দমনে তার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী নীতির অভিযোগও রয়েছে পাশ্চাত্যের। ন্যাটোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেও মিত্ররা তুরস্কের প্রতি সমর্থনে একাট্টা নয় বলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশাধিকার এখনো অধরা। রাশিয়ার সাথে ক্ষত এখনো নিরাময় হয়নি। দেশে কুর্দিদের সাথে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত। ইসরাইলের সাথে ছেঁড়া ফাটা সম্পর্ক প্রায় ঝালিয়ে নিয়েছেন। আবার এপ্রিলে ওআইসি সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের ডাক দিয়ে সবার মনোযোগ কেড়েছিলেন। এখন তুরস্ককে সাহসী নেতৃত্বের নতুন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে এক নতুন ইতিহাস রচনা করলেন রজব তাইয়েব এরদোগান।
অটোম্যান সুলতানদের বিশ্বের বিশাল ভূখন্ড বিজয় ও কয়েকশ’ বছর শাসনের সোনালি ইতিহাস যে কোনো তুর্কির জন্য গর্ব ও গৌরবজনক। কিন্তু আঠারো ও ঊনিশ শতকে একদিকে রাশিয়ার মোকাবেলায় ক্রমাগত অসাফল্য ও শক্তিক্ষয়ে দুর্বল হয়ে পড়া অটোম্যান সা¤্রাজ্য এরপর বলকান শক্তির অভ্যুদয় ও আগ্রাসন, অন্যদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কূট ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বিশ শতকের দি¦তীয় দশকের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। এক সময় পশ্চিমে হাঙ্গেরি ও উত্তরে ক্রিমিয়া থেকে দক্ষিণে আরব উপদ্বীপ পর্যন্ত প্রসারিত সা¤্রাজ্য শেষ পর্যন্ত সংকুচিত হয়ে বর্তমান তুরস্ক ভূখন্ডে এসে স্থিত হয়। অটোম্যান সা¤্রাজ্য ভেঙ্গে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র তৈরি করে, তারা সৃষ্টি করে সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, জর্দান প্রভৃতি নতুন রাষ্ট্র। এ ক্ষয়িষ্ণু প্রেক্ষাপটে সাহসী ও দক্ষ সেনানায়ক মুস্তাফা কামাল পাশার হাতে ১৯২৩ সালে জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছা তুর্কি খিলাফতের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে ওঠে। তিনি হন তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তুরস্ক হয় সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সব ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। মসজিদে নিষিদ্ধ হয় আযান। আরবিতে কুরআন পাঠ বেআইনি ঘোষিত হয়। নারীদের হিজাব নিষিদ্ধ এবং পোশাক হিসেবে চালু করা হয় মিনি স্কার্ট। বন্ধ করা হয় হাজার হাজার মসজিদ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে কোনো মুসলমানের মৃত্যু হলে তার জানাযা পড়ানো বা মসজিদগুলোতে নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে ইসলাম ধর্ম ও ঐতিহ্য প্রায় বিদায় নেয়, পাশ্চাত্য আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিকে পাথেয় করে তুরস্ক উঠে আসে আধুনিকতার মহাসড়কে।
কামাল পাশা তুরস্কে গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র হাত ধরাধরি করে পথ চলার এক পর্যায়ে প্রথম হোঁচট খায় ১৯৬০ সালের ২৭ মে। আধুনিক তুরস্কে প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এরপর ১৯৭১-এর ১২ মার্চ, ১৯৮০’র ১২ সেপ্টেম্বর এবং সর্বশেষ ১৯৯৭’র ২৮ ফেব্রুয়ারি অভিনব সামরিক অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা লাভ করে কামাল পাশার দেশ। তারপর আবার গণতন্ত্র ফিরে আসে দেশটিতে।
বিশ্বের নজর কেড়ে নেওয়া ক্যারিশমাটিক নেতা এরদোগানের তুরস্কের রাজনীতিতে আবির্ভাব অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো। তার সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, ১৯৫৪ সালে তার জন্ম ইস্তাম্বুলের কাছে কাসিমপাশায় এক সাধারণ পরিবারে। তার পিতা ছিলেন তুর্কি কোস্টগার্ডের সদস্য। পরে তার পরিবার পিতার কর্মস্থল রাইজে চলে যায়। ১৩ বছর বয়সে তারা ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন। তিনি তখন জীবিকার জন্য রাস্তায় রাস্তায় লেমোনেড ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করতেন। তিনি মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসা প্রশাসনে ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময়ই রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৮০ সালের অভ্যুত্থানের পর তিনি নাজমুদ্দিন এরবাকানের ইসলামিস্ট ওয়েলফেয়ার পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে তিনি দলের ইস্তাম্বুল মহানগরী শাখার সভাপতি হন। ১৯৯১ সালে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হলেও তাকে যোগদিতে দেয়া হয়নি, ১৯৯৪ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি ও আরো কয়েকজন মিলে ইসলামপন্থী জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০২ সালের নির্বাচনে তার দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়। পরে নির্বাচন বাতিল হয় ও ২০০৩ সালে ফের নির্বাচন হলে তার দল আবারো জয়ী হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে জয়ী হন।
গত ১৫ জুলাইর রাতটি তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রথম সার্বিক ব্যর্থতাকে ধারণ করে ইতিহাসের পাতায় জায়গা নিয়েছে। রাত ৯টার দিকে প্রথমে রাজধানী আঙ্কারা ও পরে দেশের প্রধান মহানগরী ইস্তাম্বুলে সেনা ও বিমান বাহিনীর একটি অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশন, ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দর, বসফরাস প্রণালীর উপর নির্মিত দু’টি সেতু, রাজধানী আঙ্কারায় সংসদ ভবন এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা দখল করে নেয়। এরদোগান তখন মারমারিসে ছুটি কাটাচ্ছিলন। টেলিভিশনে অভ্যুত্থানের ঘোষণা দেখার পর তিনি দ্রুত কিছু সিদ্ধান্ত নেন। নিজের মোবাইল ফোন থেকে একটি টিভি কেন্দ্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করে তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আপনারা যে যেভাবে আছেন রাস্তায় বেরিয়ে আসুন। ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হবে। দেশের জনগণ যাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছিল, তিনিই দায়িত্বে আছেন। আমরা যতক্ষণ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে দাঁড়াব, ততক্ষণ তারা সফল হতে পারবে না।’ তার এ আহবান ছিল মূলত দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে। এরদোগানের সৌভাগ্য যে জীবনের সর্বাপেক্ষা সংকটময় মুহূর্তে তার দলের মানুষ তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে অগুণতি মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, রচনা করে প্রতিরোধের দেয়াল। ইস্তাম্বুলে চলন্ত ট্যাংকের সামনে এক ব্যক্তি জীবন বাজি রেখে শুয়ে পড়েন। বাধ্য হয়ে থেমে যায় ট্যাংক। দু’এক স্থানে সৈন্যরা গুলি ছোঁড়ে। আর কোনো কোনো স্থানে জনতা সৈন্যদের উপর হামলা চালায়। তুরস্কের ইতিহাসে এই প্রথম সৈন্যরা নিরস্ত্র জনতার হাতে প্রাণ হারিয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এরদোগান অনুগত অংশ তৎপর হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডাররা প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানান। এদিকে ইস্তাম্বুলে মোতায়েন ফার্স্ট আর্মির কমান্ডারের পরামর্শে এরদোগান তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিমানে করে মারমারিস থেকে ইস্তা¤ু^লে চলে আসেন। নিজে জনতার সাথে সংযুক্ত হন। দলীয় কর্মীসহ জনতার প্রতিরোধের প্রাবল্য এবং অনুগত সেনা-পুলিশের পাল্টা পদক্ষেপে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। শনিবার সকালেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। ততক্ষণে প্রাণ গেছে ১০৪ জন সৈন্যও জনতাসহ ২৯০ জনের। অত্যন্ত প্রশংসনীয় ব্যাপার হচ্ছে তুরস্কের বিরোধী দলগুলো সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছে।
তুরস্ক জুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার অভিযান চলার কথা জানা গেছে। অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের অভিযাগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কমপক্ষে ৬০০০ মানুষকে। এর মধ্যে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগানের শীর্ষ সামরিক সহকারী কর্নেল আলী ইয়াজিসি। তাকে জেলে রাখা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর শীর্ষ স্থানীয় দু’জন কর্মকর্তা। রয়েছেন ১০৩ জন জেনারেল ও অ্যাডমিরালসহ ২৮৩৯ জন সেনা কর্মকর্তা। অভ্যুত্থানকারীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দেশটির শীর্ষ বিচারিক প্রতিষ্ঠান এইচএসওয়াইকে শনিবার বরখাস্ত করেছে ২৭৪৫ জন বিচারককে। ৭৫০ জন বিচারককে আটক করা হয়েছে। বরখাস্ত করা হয়েছে ৮ হাজার পুলিশকে। সর্বশেষ খবরে গত ২০ জুলাই জানা যায়, অভ্যুত্থানের সাথে সংশ্লিষ্টতার জন্য ১৫ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাকে বরখাস্ত এবং দেড় হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ডিনকে বাধ্যতামমূলক অবসর দেয়া হয়েছে। এর থেকে মনে হচ্ছে যে অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা ছিল যথেষ্ট। এরদোগান কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, অভ্যুত্থানকারীদের চড়া মূল্য দিতে হবে। অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তুরস্কের হিজমেত আন্দোলনের নেতা ফতেউল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেছেন। আর বলা হচ্ছে, দুই ব্যক্তি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে নাটের গুরু হিসেবে কাজ করছেন। এদের একজন হচ্ছেন জেনারেল একিন ওজতুর্ক। তিনি ইসরাইলে তুর্কি সামরিক এটাশে ছিলেন। তুর্কি বিমান বাহিনীর কমান্ডার থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালের আগস্টে অবসর নেন তিনি। কিন্তু তিনি এখনও সুপ্রিম মিলিটারি কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছেন লেফট্যানেন্ট জেনারেল মেতিন লিয়েদিল। তিনি স্থলবাহিনীর কমব্যাট ও সাপোর্ট ট্রেনিং কমান্ডার হিসেবে কর্মরত। তবে যুক্তরাজ্যের একটি থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের ফাদি হাকুরা মনে করেন, এরা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের ব্যর্থতা এটাও প্রমাণ করে যে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে আর সমাজের বেশিরভাগ অংশের কোনো সমর্থন নেই। তবে কোনো কোনো সূত্রে যে কোনো সময় আবার অভ্যুত্থান ঘটার আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, আর সে কারণে জনতাকে আরো কয়েকদিন রাজপথে সারাদিনের পরিবর্তে বিকেল থেকে ভোর পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এবারের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান তুরস্কের সামনে অনেক প্রশ্ন জড়ো করেছে। ইতোমধ্যে দীর্ঘকালের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের দু’একজন নেতা এ অভ্যুত্থানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিত ছিল বলে মন্তব্য করার পর দেশটির তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এর বিরুদ্ধে কড়া বিবৃতি প্রদান করেন। ব্যর্থ অভ্যুত্থানকারীদের বিচারে মৃত্যুদ- দেয়ার ব্যাপারে তুরস্ক সরকার চিন্তা করছে। উল্লেখ্য, ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে মৃত্যুদ-ের বিধান নেই। এর সদস্যপদ লাভের জন্য তুরস্ক বহু বছর আগেই মৃত্যুদ- বাতিল করে। এখন মৃত্যুদ- পুনঃপ্রবর্তন করার জন্য সংবিধান সংশোধন করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ২০ জুলাই বৈঠকে বসার কথা তুর্কি মন্ত্রিসভার। ইতোমধ্যে ইইউ জানিয়ে দিয়েছে যে মৃত্যুদ- ফিরিয়ে আনা হলে ইইউ’র সদস্যপদ লাভের কথা তুরস্ককে ভুলে যেতে হবে। উল্লেখ্য, তুরস্ক বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও, বহু শর্ত মেনে নিয়েও এখন পর্যন্ত ইইউ’র সদস্যপদ লাভ করতে পারেনি। অদূর ভবিষ্যতেও পারবে কিনা সন্দেহ। ইইউভুক্ত সদস্যদেশগুলো তুরস্ককে ইইউ’র সদস্য পদ দেয়ার ব্যাপারে কখনো একমত হতে পারেনি। পারবে বলেও মনে হয় না। এদিকে এরদোগানের কর্তৃত্ববাদী শাসন দেশের মধ্যে বা বাইরে তার অবস্থানকে ভালো করেনি। একদিকে আইএস অন্যদিকে কুর্দি বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হামলা তুরস্কের জনজীবনকে ক্রমেই ঝুঁকির সম্মুখীন করছে। এরদোগান এ সন্ত্রাসের ভয়ংকর থাবা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে তার ইসলাম ঘেঁষা নীতি অনেকেরই পছন্দ নয়।
এককালের রাজনৈতিক সহযোগী ফেতুল্লাহ গুলেনকে এরদোগানের জন্য বড় হুমকি বলে মনে করেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক। তুরস্কে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জেমস জেফরির মতে, এরদোগানের পর ফেতুল্লাহ গুলেনই সম্ভবত তুরস্কের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি একজন ইসলামী ধর্মপ্রচারক। তার নেতৃত্বাধীন হিজমেত আন্দোলনের হয়তো লাখ লাখ অনুসারী আছে। এ আন্দোলনের সম্পদের পরিমাণ হতে পারে কয়েক শ’ কোটি ডলার। প্রায় ১৫০টি দেশে তার নেটওয়ার্কের উচ্চমান সম্পন্ন স্কুল রয়েছে। গুলেনের হিজমেত আন্দোলনের ব্যাপারে বৈশ্বিক গণমাধ্যমেও বেশ অদ্ভুত বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন একে আখ্যা দিয়েছে ‘গোপনীয়তাপ্রিয়’ (সিক্রেটিভ), দ্য ইকোনমিস্টের মতে ‘আবছায়া’ (শ্যাডোয়ি), লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের কথায় ‘অস্বচ্ছ’ (ওপাক), উইকিলিকস ক্যাবলের ভাষায় ‘গোপনচারী’ (ইনসিডিয়াস)।
ওয়াশিংটনের কাছে অনেকদিন ধরেই গুলেনকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন এরদোগান। কিন্তু ওবামা প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি। অভ্যুত্থান ঘটনার পর শনিবারও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ দাবি জানিয়েছেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। তিনি কড়া ভাষায় বলেন, ‘যে রাষ্ট্রই ফেতুল্লাহ গুলেনকে সুরক্ষা দেবে, তাকে তুরস্কের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ভাবা হবে।’ এরদোগান ইতোমধ্যে ফতেউল্লাহ গুলেনকে তুরস্কে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র তাতে সাড়া দেয়নি। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, অভ্যুত্থানের সাথে গুলেনের জড়িত থাকার ব্যাপারে তুরস্ক যদি বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ দেয় তাহলে তা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
বর্তমানে এরদোগানের জন্য ইতিবাচক দিক হচ্ছে, সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টা তিনি যেভাবে মোকাবেলা করেছেন তা তাকে শুধু তুরস্কেরই নয়, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সাহসী নেতার ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাকে করেছে আগের চেয়েও শক্তিশালী। অন্যদিকে তুরস্কের ঘটনা বিশ্বব্যাপী অবৈধ পথে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য এক কঠোর বার্তাও বটে যে, মানুষ সামরিক শাসন নয়, গণতন্ত্র চায়। গণতন্ত্রও অনেক ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী শাসকের হাতের মুঠোয় বন্দী হয়ে পড়ে, জনগণের বিরাট অংশের জন্য দুঃসহ ভোগান্তি, নির্যাতন, নিপীড়ন বয়ে আনে। তারপরও গণতন্ত্রই কাক্সিক্ষত, উর্দি পরিহিতদের সামরিক শাসন নয়। যাহোক, তুরস্কে এখন দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়া চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যেন ন্যায় বিচার হয় এবং বিরোধী দলের নেতাদের উপর দমনের অজুহাত না হয় সে বিষয়ে এরদোগানকে সতর্ক থাকতে হবে। অনুমান করা হয় যে অভ্যুত্থান সফল হলে অনেক দেশ ও মিডিয়াই তাকে কাগজের পাতা থেকে মুছে ফেলত। কেউ কেউ মনে করেন তাকে মিসরের মুরসির ভাগ্য বরণ করতে হতো। তার ভাগ্য ও প্রচেষ্টা তাকে অন্তত এবারের মতো রক্ষা করেছে। সে বিষয়টি স্মরণে রাখা তার জন্য কল্যাণকর হবে বলে শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।