বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
ভ্যালু এডিশন বা মূল্য সংযোজন নামক যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, সেটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে বিএনপির প্রথম সরকারের আমলে (১৯৯১-৯৬)। এখন পরিচিত শব্দটা হলো ভ্যালু এডেড ট্যাক্স তথা ভ্যাট বা বাংলায় মূল্য সংযোজন কর তথা মুসক। আমি অবসরে গিয়েছি তাও ২০ বছরের অধিক হয়ে গেল; অবসর জীবনের শুরুর দিকের কথা। ভ্যাট সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞান নেওয়া প্রয়োজন হয়েছিল; ওই সুবাদে, তখনকার আমলের এনবিআর-এর সদর দফতরে গিয়েছিলাম, পরিচিতদের সঙ্গে গল্প করে জানার জন্য। তখনকার চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হান্নান, শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমাকে আধা ঘণ্টা বুঝিয়েছিলেন এবং তারপর আরেকজন কনিষ্ঠ অফিসারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে আমাকে তার হাওলা করে দিয়েছিলেন। তবে আজকে এই কলামের প্রারম্ভে আমি অর্থনীতির ভ্যাট প্রসঙ্গে বলবো না, কিন্তু অর্থনীতির বাইরে ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনেও যে প্রক্রিয়াটি প্রযোজ্য, সে সম্বন্ধে দু’চারটি লাইন লিখবো।
সাড়ে একুশ বছরের তরুণ সেকেন্ড লেফটেনেন্ট ইবরাহিম যখন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, তখন সে দেশ নিয়ে কতটুকু গভীর চিন্তা করতো কতটুকু বিশদ চিন্তা করতো, অথবা করার সুযোগ তার সামনে ছিল, সেটি একটি প্রশ্ন। দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর, জানুয়ারি ১৯৭২-কে যদি উদাহরণস্বরূপ একটি বেঞ্চমার্ক বা ল্যান্ডমার্ক-ইয়ার মনে করি, তাহলে সাড়ে বাইশ বছর বয়সের লেফটেনেন্ট ইবরাহিম-এর ভেতর নিশ্চিতভাবেই অস্বাভাবিক রকমের এবং অস্বাভাবিক গতিতে মূল্য সংযোজন হয়েছিল বিগত নয়-দশ মাসে। কারণ, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ যেখানে প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রতি মিনিটেই হাতের বন্দুক এবং বন্দুকের ভেতরের গুলিটাই ছিল নিকটতম সহচর; সেই যুদ্ধ তাকে একটি ভিন্ন জীবনের স্বাদ দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ আরেকটি বেঞ্চমার্ক বা ল্যান্ডমার্ক-ইয়ার নেই। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে লন্ডন থেকে যখন ফেরত এসেছিলাম, সরকারি বৃত্তিতে স্ব-পরিবারে তেরো মাস লেখাপড়ার পর, তখন আরও কিছু মূল্য ভিন্নভাবে সংযোজিত হয়েছিল। ১৯৮৭-৮৯ সালে পার্বত্য জেলা রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িতে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম, আক্ষরিক অর্থেই আগুনের মতো উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এবং একজন সৈনিক হয়েও, দেশের স্বার্থে এলাকায় শান্তি আনয়নের নিমিত্তে, যুগপৎ রাজনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমন্বিতভাবে কাজ করেছিলাম সরকার এবং শান্তি বাহিনীর মধ্যে সমঝোতা আনার জন্য। আমার অভ্যন্তরে মূল্য সংযোজনের আরেকটি অনবদ্য অধ্যায় ছিল সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বছরগুলো। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ যখন সৌদি আরবে সামরিক কন্টিনজেন্ট পাঠায় বা ১৯৯১ সালে যখন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন আমি সেনা সদরে একটি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে ছিলাম; মূল্য সংযোজনে সেটি আরেকটি অধ্যায়। অবসর জীবনে ১৯৯৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত, লেখালেখি, সভা-সমিতি-সেমিনারে দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণ, টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ, ইলেকশন মনিটরিং ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে আরেক প্রকারের মূল্য সংযোজন হয়েছে। ২০০৭ এর ডিসেম্বর থেকে আমি একজন তালিকাভুক্ত রাজনৈতিক কর্মী; ২০১২ এপ্রিলের ১৮ তারিখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের একটি শরীক দলের (কল্যাণ পার্টি) চেয়ারম্যান। মূল্য সংযোজনের এটি সর্বশেষ অধ্যায়।
ব্যক্তির যেমন মূল্য সংযোজন হয়, জাতি বা জনগোষ্ঠীরও মূল্য সংযোজন হয়। হওয়াটা স্বাভাবিক; যদি না হয় তাহলে বলতে হবে এটি একটি দুর্ভাগ্য। ১৯৭২ থেকে ৭৫ একটি সময়কাল। বাংলাদেশ সরকারের ছত্রছায়ায়, জাতীয় রক্ষী বাহিনী (জেআরবি) নামক একটি আধা-সামরিক বাহিনী, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি উন্নয়নের নামে জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালায়। অপরদিকে ’৭২-এর অক্টোবরের পরে, ’৭৫-এর নভেম্বর পর্যন্ত নতুন জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল ‘জাসদ’ রাজধানীতে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামে, রাজপথ রক্তাক্ত করে। জাসদ আ’লীগ পন্থী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণগণের মগজ ধোলাই করে তাদেরকে রাজপথে সক্রিয় করেছিল। তরুণদের মাথায় একটি ‘তাবিজ’ বা একটি ‘ক্যাপসুল’ দিয়েছিল। ওই তাবিজ বা ক্যাপসুলের নাম ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। সরকারি অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় জাসদ তা-ব চালিয়েছিল, নাকি জাসদের তা-বের প্রতিক্রিয়ায় সরকার অত্যাচার চালিয়েছিল, তার বিশ্লেষণ এই স্বল্প পরিসরের কলামে সম্ভব নয়। কিন্তু জাতির চিন্তা-চেতনা-বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭৫-এর আগস্টে একবার এবং ১৯৮১ সালের মে মাসে আরেকবার, দেশের প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের হাতে। ’৭৫ বা ’৮১ উভয় ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর ওই ক্ষুদ্র অংশগুলোর নেতৃত্বের চিন্তা-চেতনার অভিজ্ঞতা এবং সেগুলোকে কাউন্টার করার অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চতম পর্যায়ের নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে এবং সক্রিয় ভূমিকায় সামরিক শাসন জারি হয়। এই সামরিক শাসনকে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে অপসারণ করতে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে যেমন পরবর্তী আট-নয় বছর ধ্যান ধারণা করতে হয়েছে, জনগণকেও পরবর্তী সাত-আট বছর রাজপথে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এগুলো জাতির অভিজ্ঞতার ঝুলিতে মূল্য সংযোজন করে। ১৯৯১ সাল থেকে নিরাপদ সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অস্থিতিশীলতার শুরু ১৯৯৪ এর মাঝামাঝি থেকে, যখন সরকারের বাইরে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে। কিঞ্চিত দেরিতে হলেও, তৎকালীন বিএনপি সরকার দাবি মেনে নেয়, স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়, জনগণের প্রতি জবাবদিহিতার পরিচয় দেয়, রাজনৈতিক সাহসের পরিচয় দেয়। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা আছে জেনেও, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয় বিএনপি। কিন্তু ১৯৯৪-৯৫ এর অস্থিতিশীল সময়টাতে প্রথম, বা প্রথমবার না হলেও গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রথমবার, রাজনীতিতে বা সমাজে সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেই যে শুরু হলো, বছরের পর বছর, এই সরকার ওই সরকার, সব সরকারের আমলে, সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে থাকলো। বিএনপি সরকার ২০০৪-০৫ সালে লক্ষণীয়ভাবে চেষ্টা করেছিল এই সহিংসতাকে নির্মূল করতে; কিন্তু নির্মূল হয়নি, সাময়িকভাবে দমন হয়েছিল। বিএনপি সরকার সহিংসতার জন্য সন্ত্রাসীদেরকে দায়ী করেছিল; বিরোধী দলকে নয়। বাংলাদেশের বর্তমান শাসনকারী সরকার সহিংসতা বা সন্ত্রাস দমনে চেষ্টা করছেন না, এই কথা সরকারের চরম শত্রুও বলবে না। সরকারের শত্রু এবং মিত্র একবাক্যে বলবেন যে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সরকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু, তাদের চেষ্টায় বা চেষ্টা-প্রক্রিয়ায় মৌলিক ভ্রান্তি আছে বলে আমি মনে করি। সরকার সবকিছুর জন্যই বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনের বিরোধী অংশকে বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করাকে একটি স্থায়ী অভ্যাসে রূপ দিয়েছে। এখন থেকে কুড়ি-বাইশদিন আগে, ঈদের আগে আগে, গুলশানের হলি আর্টিজেন রেস্টুরেন্ট-এর হামলা, বিএনপি-জামায়াতের প্রতি দোষারোপের যে ভ্রান্ত অভ্যাস সরকারের একচেটিয়া ছিল, সেই ভ্রান্ত অভ্যাসকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছে। ওই সুযোগটি এসেছে বলেই, বা অপর ভাষায় ভ্রান্তিটি সংশোধনের সুযোগ এসেছে বলেই, ‘জাতীয়-ঐক্য’ নামক শব্দগুচ্ছ বা ঐ ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এখন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে ঝংকৃত হচ্ছে। ধাপে ধাপে বিভিন্ন বছরের ঘটনাবলীর মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতি বা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী এবং তাদের নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনীতিবিদগণের যে মূল্য সংযোজন হয়েছে, সে মূল্য সংযোজনের কারণে আমি আশা করি এবার বড় রকমের কোনো ভুল বড় কোনো দল করবে না। কিন্তু আমি মনে করি, সরকার ভুল করেই ফেলছেন অথবা করার দ্বারপ্রান্তে এসে গেছেন।
জাতীয় ঐক্য বলতে আপাতত আমরা বুঝছি, চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ, চিন্তাশীল রাজনীতিবিদগণ, চিন্তাশীল পেশাজীবীগণ, জনগণের নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাগণ, ধর্মীয় অঙ্গনের চিন্তাশীল নেতাগণ, দেশ শাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অতীত এবং বর্তমানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ সকলের মধ্যে একটি মোটামুটি সমঝোতা বা ঐক্য। সামাজিক নেতৃবৃন্দ প্রতিনিধিত্ব করবেন ষোলো কোটি বাংলাদেশির চার কোটি পরিবারের পরিবার-প্রধানগণকে। চিন্তার ঐক্য দীর্ঘমেয়াদী সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া, কিন্তু লক্ষ্যবস্তু স্থির-করণে, ঐক্য বা ঐক্যমত্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া নয়। অতএব লক্ষ্যবস্তু স্থির-করণেই ঐক্য বা ঐক্যমত্য প্রথমে আনতে হবে। তারপর আনতে হবে, সেই লক্ষ্যবস্তু অর্জনের প্রক্রিয়ায়। কেন জাতীয় ঐক্য? বা জাতীয় ঐক্যের উদ্দেশ্য কী? এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে সমস্যা বা সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে সংকট বা সমস্যার নাম হচ্ছে চরমপন্থা বা উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদের প্রসার। ইংরেজি পরিভাষায়, এক্সট্রিমিজম বা মিলিটেন্সি বা টেরোরিজমের প্রসার। এই সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদ বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের সমাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুকে একটি ঝাঁকুনি দিচ্ছে। এই ঝাঁকুনি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি, সমাজ ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক কর্মকা-, লেখাপড়া ইত্যাদি সব সেক্টরেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা প্রচ-ভাবে ধাক্কা খাচ্ছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সুযোগ প্রসারিত হচ্ছে; যদিও ঐরূপ হস্তক্ষেপগুলো অ-স্বাগতম বা আন-ওয়েলকাম। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত, শঙ্কিত। এর ফলে, মানুষের কর্মস্পৃহা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। অতএব, এই সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদ বা মিলিটেন্সি বা টেরোরিজমকে অবশ্যই রুখে দিতে হবে। রুখে দিতে হলে, দমন করতে হলে, নির্মূল করতে হলে কর্মসূচী প্রয়োজন এবং কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য কর্মী বাহিনী প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ গত রবিবার (১৭ জুলাই ২০১৬) সন্ধ্যা থেকে বলা শুরু করেছেন যে, ‘জাতীয় ঐক্য হয়েই গিয়েছে’। অপরদিকে গত ২ জুলাই তারিখ থেকে, সরেজমিনে বাংলাদেশের রাজনীতির বিরোধী দলীয় নেত্রী তথা ২০ দলীয় জোট নেত্রী তথা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আহ্বান জানাচ্ছেন, ‘জাতীয় ঐক্য স্থাপনের জন্য’। বেগম জিয়ার আহ্বানের মধ্যে সমগ্র জাতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান আছে, জাতির সকল অংশের প্রতি উদাত্ত আহ্বান আছে এবং সম্ভাব্য কর্মীগণের প্রতিও উদাত্ত আহ্বান আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আহ্ববানে, তথা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারের আহ্বানে, বাংলাদেশের জাতীয় অঙ্গনের অর্ধেককে বিয়োগ করা আছে বা অ-স্বাগতম (ইংরেজি পরিভাষায় আন-ওয়েলকাম) করা আছে। আশা করি, এই কলামের সম্মানিত পাঠক, সরকারের এবং বিরোধী অঙ্গনের আহ্ববানের মধ্যে মৌলিক তফাৎ বুঝতে পেরেছেন। সরকারের জন্য রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে, পৃথিবীকে একটি জিনিস দেখানো এবং একটি জিনিস বোঝানো। দেখানোর জিনিসটি হচ্ছে এই যে, সমগ্র জাতি আমার পেছনে আছে। আর বোঝানোর জিনিসটি হচ্ছে এই যে, বর্তমান সরকারই সন্ত্রাস দমনের জন্য উপযুক্ত ও যথেষ্ঠ, অতএব সকলেই এই সরকারকেই যথাপ্রযোজ্য সহযোগিতা বা মান্য করা উচিত। সমগ্র জাতি অবশ্যই চায় সন্ত্রাস দমিত হোক, তাহলে যুক্তি প্রয়োগ করে বলাই যায়, জাতি এই সরকারের সঙ্গে আছে। কিন্তু সরকার কি জাতির সঙ্গে আছে? সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দল বা কর্মী, সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবী মহল, সরকার সমর্থক পেশাজীবী মহলের বাইরে তাদের আহ্বানকে বিস্তৃত করছেন না। বা সরকার জাতিকে একত্রিত করণের প্রক্রিয়ায়, অন্য কাউকে অংশীদার করছেন না। জঙ্গীবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদের আক্রমণ যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে, সে সমস্যাটি শুধু আওয়ামী লীগের জন্য মাথাব্যাথ নয়, শুধু বিএনপি বা ২০ দলের জন্যও নয়, বা শুধু মাদরাসাগুলোর শিক্ষকম-লীর জন্যও নয় বা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকম-লীর জন্যও নয়। এই সমস্যাটি সকলের সামনে দাঁড়িয়েছে দানবরূপে। অতএব, এটির প্রতিকারে যদি সকলকে সম্পৃক্ত করা না হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে দমন প্রক্রিয়ায় বা মোকাবিলা প্রক্রিয়ায় ফাঁক থেকে যাবেই।
জাতির সামনে এটি একটি মহা চ্যালেঞ্জ, কেমন করে সরকার পন্থীগণ এবং বিরোধী পন্থীগণ মোটামুটিভাবে এক কাতারে দাঁড়াবেন। কেন দাঁড়াবেন? সন্ত্রাস দমনে কর্মসূচী প্রণয়ন ও সে কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য। এইরূপ একটি চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে বহুমুখী মেধাসম্পন্ন, সাহসী, বহুমুখী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। গত আট-দশ-বিশ বছরে, ধারাবাহিক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে, শিক্ষিত সমাজের মন-মগজে রাজনীতি-বিদ্বেষী বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত আট-দশ বছরের কর্মকা- বিশেষ করে রাজনীতিতে থেকে জনগণকে মাইনাস করে দেওয়ার প্রক্রিয়া, ওই শিক্ষিত সমাজকে আরও বেশি রাজনীতি-বিদ্বেষী করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের এই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশ ও পরিস্থিতির সময়, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নেতৃত্ব দিতে হবে, সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতে হবে, উৎসাহদাতার দায়িত্ব পালন করতে হবে, অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে হবে। হ্যাঁ, অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া ওই পথে হাঁটছেন এবং ওই প্রক্রিয়ায় আছেন। সব রাজনৈতিক দল বা সব রাজনৈতিক দলের নেতাগণ ওই প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিতে পারলেও, সক্রিয় ভূমিকা সমানভাবে রাখতে পারবেন না; না পারাই স্বাভাবিক; কারণ মূল্য সংযোজন কার কতটুকু হয়েছে সেটার উপরই নির্ভর করবে প্রত্যেকের নিজস্ব কন্ট্রিবিউশন বা অবদান। পেশাজীবী নেতাগণের জন্যও এই কথা সত্য। তারা প্রক্রিয়ায় আছেন; তাদেরকে অব্যাহতভাবে রাখাটাই হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। তাদের থেকে কন্ট্রিবিউশন আদায় করে নেওয়াটাই হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাগণের জন্য চ্যালেঞ্জ। অধ্যাপকগণ, মসজিদের ইমামগণ, স্কুলের হেডমাস্টারগণ সকলেই পেশাজীবী সম্প্রদায়ে পড়েন। পীর মাশায়েখগণ বা পীর-আউলিয়াগণ বা সুফীবাদ অনুশীলনকারী জ্ঞানী ব্যক্তিগণ, সচরাচর পেশাজীবী হিসেবে গণ্য হন না। তাঁরা আরও বেশি সম্মানিত এবং তাঁদের জনসম্পৃক্ততা ব্যাপক। এই কলামে আলোচনার জন্য আমি ধর্মীয় অঙ্গনের নেতৃত্ব বলেই তাঁদেরকে চিহ্নিত করছি। এই ধর্মীয় অঙ্গনের নেতৃত্বের মধ্যেও, খুঁটিনাটি বিষয়ে চিন্তা-চেতনায় পার্থক্য আছে; থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক ধর্মীয় অঙ্গনের সার্বিক নেতৃত্ব একবাক্যে, উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধর্মীয় অঙ্গনের নেতৃত্ব এই প্রক্রিয়ায় তাঁদের অবদান রাখা শুরু করেছেন। আমার মতে এবং ধর্মীয় অঙ্গনের নেতাগণের সর্বসম্মত মতে, উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা লালন-পালন করছে, তারা দ্বীন-ইসলামের কিছু বিধানাবলীকে, দ্বীন ইসলামের কিছু নির্দেশাবলীকে অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করছে। অতএব, এই উগ্রবাদ বা সন্ত্রাসবাদ দমনে বা নির্মূলে, অন্যতম অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে ধর্মীয় অঙ্গনের নেতৃত্বকে। অপর ভাষায়, রাজনৈতিক অঙ্গনের নেতাগণকে, সুনিশ্চিতভাবেই এমন প্রক্রিয়া করতে হবে যেন ধর্মীয় অঙ্গনের নেতাগণ সম্পৃক্ত থাকেন। ধর্মীয় অঙ্গনের নেতাগণকে রাজনৈতিক মতাদর্শ দিয়ে প্রভাবিত করা যাবে না; প্রভাবিত করা উচিতও হবে না। কিন্তু ধর্মীয় অঙ্গনের নেতাগণের কাছ থেকে জ্ঞানের প্রভাব আহরণ করতে হবে।
এই কলামটি এখন শেষ করছি। আমি বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদের উত্থানের পেছনে, সাম্প্রতিক ও নিকট অতীতের উপাত্ত বা কারণগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করিনি। সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদ উত্থানের পেছনে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভুল বা অনিচ্ছাকৃত অবদানগুলো সম্বন্ধেও আলোচনা করিনি। বর্তমান সরকারের গত আট বছরের শাসন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতাগুলো (যার ফলে সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদ প্রসারিত হয়ে থাকতে পারে), সে সম্বন্ধেও আলোচনা করিনি। আলোচনা না করার পেছনে অন্যতম কারণ, স্থান অভাব এবং পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটানোর ইচ্ছা। এই কলামে আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল পাঠকের মনে এবং সম্মানিত পাঠকদের নেতাদের মনে, একটি ধারণাকে শক্তিশালী করা। সেই ধারণাটি হচ্ছে, বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে, সকলেই সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। কেউ কাউকে বাদ দিতে চেষ্টা করলে ফলাফলও সীমিত হবে।
য় লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
সমংসরনৎধযরস@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।