দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
আরবি হিজরি সনের অষ্টম মাস হলো শাবান। যার পরবর্তী মাসটিই রহমত বরকত মাগফিরাত ও নাজাতের বারতা নিয়ে প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফিরে আসে। পবিত্র রমজান মাস মুসলিম উম্মাহর চাওয়া ও পাওয়ার মাস। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের বার্তা নিয়ে রমজান আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। কয়েক দিন পরই আমরা ‘আহলান সাহলান’ বলে বরণ করে নেব মাহে রমজানকে। পবিত্র সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ব্যাকুল হয়ে উঠবে বিশ্বের সকল মুসলমান।
আকাশে রজবের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নবী করিম (সা.) রমজান পর্যন্ত আয়ু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। সাহাবিদেরকেও দোয়া করতে বলতেন। বেশি বেশি এ দোয়া পাঠ করতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবান, ওয়া বাল্লিগনা রমাজান।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি রজব এবং শাবান মাসে আমাদের ওপর বরকত নাজিল কর এবং রমজান পর্যন্ত আমাদের হায়াত দীর্ঘায়িত করে দাও।
সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কাছে এ মাসটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পার্থিব লোভ-লালসামুক্ত থাকা, ত্যাগ-সহিষ্ণুতার সাধনা করা এবং মানবিক মূল্যবোধে তৈরি হওয়ার প্রশিক্ষণে এ মাসের গুরুত্ব অপরিসীম।
রমজানের নতুন চাঁদ দেখে দোয়া পড়ুন। হজরত তালহা বিন ওবাইদুল্লাহ্ হতে বর্ণিত, হজরত নবী করিম (সা.) যখন নতুন চাঁদ দেখতেন,
‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল্ আম্নে ওয়াল ঈমান, ওয়াস্ সালামতে ওয়াল ইসলাম, রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহ্’
অর্থ: হে আল্লাহ্! তুমি এই চাঁদকে উদিত কর আমাদের প্রতি নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলাম সহকারে। (হে চাঁদ!) আমার প্রভু ও তোমার প্রভু (এক) আল্লাহ্।(মিশকাত)
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিৎ রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণে মনোযোগী হওয়া। রমজানের প্রস্তুতিকল্পে এ বিষয়গুলো মনে রাখা দরকার-
আমরা তিন ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি। ১. ব্যক্তিগত ২.পারিবারিক ৩.সামাজিক।
ব্যক্তিগত প্রস্তুতি :
মানসিক প্রস্তুতি
অনেকেই হিজরি সন বা চান্দ্রমাসের খবর রাখে না। ফলে হঠাৎ যখন শোনে, অমুক দিন থেকে রমজান আরম্ভ হবে- তখন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। রমজানের গুরুত্ব-মাহাত্ম্য যথাযথভাবে অনুধাবন করে না বা করতে পারে না। ফলে সঠিকভাবে রোজা-পালন করতে পারে না। আর রোজা যদিও রাখে- তার জন্য এটি একটি ভারী আমল হিসেবে দেখা দেয়। যেকারণে রোজা তার জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। অথচ চাঁদের হিসেব রেখে এখন থেকেই নিজের মন-মননে রোজাপালন ও এ মাসের প্রভূত কল্যাণ লুফে নেওয়ার মানসিকতা গ্রহণ করলে, পরিপূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধার সঙ্গে রোজাগুলো পালন করতে পারবে- ইনশাআল্লাহ।
অভ্যাসগত প্রস্তুতি
এখন থেকেই নফল ইবাদত ও জিকির-আজকারের অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। যে কোনো জিনিস হঠাৎই খুব বেশি করে ফেলা যায় নাপূর্ব থেকে অভ্যাস থাকলেই যে কোনো কাজ অধিক পরিমাণে করা যায়। এখন থেকে অভ্যাস গড়ে তুললে রমজানে ইবাদত-বন্দেগি বেশি বেশি করা যাবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং এখন থেকেই বেশি বেশি ইবাদতের অভ্যাস গড়ে নেওয়া দরকার।
শারীরিক প্রস্তুতি
অনেকেই গ্যাস্ট্রিক বা এ জাতীয় অন্য কোনো অসুখের দোহাই দিয়ে রোজা পালন থেকে বিরত থাকতে চায়। এটা ঠিক না। এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা আগেভাগেই সেরে নেওয়া দরকার। শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ সুস্থতা অর্জনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
১. বড় ধরনের কোনো সফর থাকলে তা রোজার আগেই সেরে ফেলতে হবে। যাতে রোজা রেখে কষ্ট করতে না হয়।
২.যে বাজারগুলো আগেই করা ফেলা সম্ভব (যেমন শুকনো বাজার), তা রোজার আগেই করে ফেলতে হবে। তাহলে রমজানে আপনার সময় বাঁচবে।
৩. কোরআন তিলাওয়াতের জন্য একটি সময় নির্ধারণ করতে হবে। এই সময়ে আপনি কোরআন তিলাওয়াত করুন। কোরআন পড়তে না জানলে শিখুন।
৪. তাফসির পড়ুন। বাজারে এখন অনেক বাংলা তাফসির পাওয়া যায় (যেমন: মায়ারেফুল কোরআন, ফি জিলালিল কোরআন, তাফহিমুল কোরআন।) পছন্দমতো একটি তাফসির গ্রন্থ কিনুন এবং সময়মতো নিয়মিত অধ্যয়ন করুন। তা ছাড়া, বাংলা হাদিস ও ইসলামি সাহিত্য বেশি বেশি পড়ুন।
৫. সময় সুযোগ থাকলে রমজানের শেষ দশ দিন ইতিকাফে বসতে পারেন।
৬. বেশি বেশি ইবাদত করুন। রোজার মাসে একটি ফরজ ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান এবং একটি নফল একটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব। তাই মহান আল্লাহর এ স্পেশাল অফার গ্রহণে আমাদের উৎসাহী হওয়া একান্ত জরুরি।
৭. রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় বিশেষ পরিকল্পনা নিন। কোনো বদ অভ্যাস থাকলে তা ছাড়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ যাতে বে-রোজাদার না থাকে তার জন্য রমজানের পূর্বেই তাদের সতর্ক করুন।
আপনার পয়সায় আপনার ঘরে দিনের বেলায় পবিত্র রমজানে শিশু ও অক্ষম বৃদ্ধ ছাড়া অন্যের অন্নসংস্থানের সব পথ বন্ধ করে দিন।
পারিবারিক প্রস্তুতি :
১. পারিবারিক মিটিংয়ের মাধ্যমে রমজানের মাহাত্ম্য, ফাজায়েল ও করণীয় কী, সেটা আলোচনার মাধ্যমে পরিবারের সবাইকে প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করা।
২. পরিবারের ছোট-বড় সবাইকে নিজ নিজ প্রস্তুতি বলা ও তাদেরও প্রস্তুতি গ্রহণে সাহায্য করা।
৩. পরিবারের সবাই মিলে কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া, একে অপরকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
সামাজিক প্রস্তুতি :
১. নিজ প্রতিবেশীদের খোঁজ নেওয়া, তাদের সঙ্গে রমজানের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা করে তাদেরও সহায়তা করা।
২. স্থানীয় মসজিদগুলোতে রমজানকেন্দ্রিক কী আয়োজন ও পরিকল্পনা রয়েছে, তা জানা এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসা। মসজিদে কারা ইতিকাফে বসবেন, তা জেনে নেওয়া, প্রয়োজনীয় সহায়তায় এগিয়ে আসা!
৩. রমজানের পূর্বেই হালকার মাধ্যমে রমজানবিষয়ক আলোচনা করা। নারী ও পুরুষরা যার যার অঙ্গনে বা পরিসরে করতে পারেন, সুযোগ থাকলে পর্দার পরিবেশ তৈরি করে যৌথভাবেও করা যায়।
৪. সকলে মিলে সমাজের অবহেলিত, অনাহারী মানুষগুলোর জন্য সেহ্রি ও ইফতারের ব্যবস্থা বা উদ্যোগ গ্র হকরা। ৫.একে অপরকে উৎসাহিত করা।
আসুন, আসন্ন মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে বরণ করি এবং এ সময়টাকে কাজে লাগাই। আত্মাহংকার ছেড়ে আত্মশুদ্ধির পথ গ্রহণ করি। এবং নফল ইবাদত বন্দেগি করে নিজেদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।