Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দীর্ঘদিন নেই বোর্ডসভা

স্থবির দেশের ব্যাংকিং খাত

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫১ পিএম

করোনাভাইরাসে টালমাটাল অর্থনীতি। অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এগিয়ে আসছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে নিজ গ্রাহকদের টেনে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করছে অনেক ব্যাংক। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কিছুটা ভিন্ন।

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। দীর্ঘদিন নেই বোর্ড সভা। চেয়ে থাকছেন বাংলাদেশ ব্যাংক কি সার্কুলার দিচ্ছে তার দিকে। আর টাকা দেওয়া-নেওয়ার দাফতরিক কাজ ছাড়া কোন কার্যক্রমই নেই ব্যাংকগুলোর। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণেই সময় কাটাচ্ছেন তারা। এতে দেশের অর্থনীতিতে এক ধরণের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিকে গতিশীল করার উদ্যোগতো নেই; এমনকি নিজ গ্রাহকদের স্বার্থে সরকারের দেওয়া প্রণোদনাও কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তারও কোন পরিকল্পনা নেই ব্যাংকগুলোর। অথচ বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল।

প্রযুক্তিতে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। জরুরি সভা-সম্মেলন করা হচ্ছে ভিডিও কনফারেন্সে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশের বিভিন্ন স্থানের কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভা করছেন, দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। জেনে নিচ্ছেন করোনা প্রতিরোধে সার্বিক প্রস্তুতি, দিচ্ছেন দিকনির্দেশনা। দেশের মানুষের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া পরিবারের কেনাকাটা চলছে অনলাইনেই। ছুটি থাকলেও সকল অফিসিয়াল কার্যক্রম চলছে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে।

ঝুঁকি নিয়ে দেশের ক্রান্তিকালে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, সেনাবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ও শুধু সার্কুলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে দিচ্ছেন না কোন দিক নির্দেশনা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোর ভূমিকায় অনেক ব্যবসায়ীও হতাশ ও ক্ষুদ্ধ। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী রোববার অর্থনীতির চালিকাশক্তি ব্যাংকখাত নিয়ে বসবেন বলে জানা গেছে। হয়তো তিনি ওই দিন ব্যাংকগুলোকে কোন দিক নির্দেশনা দিবেন।

জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের সিইও এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বোর্ড সভা করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ বৃহস্পতিবারই বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হবে। অন্যথায় আগামী রোববার সভা হবে। তিনি বলেন, পরিচালকদের বাসায় ইন্টারনেট লাইন বসানো হচ্ছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বোর্ডসভা হচ্ছে না। তবে সাধারণ কাজ বন্ধ নেই। এমনকি জরুরি কোন বিষয় হলে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপ করে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পরবর্তীতে মেমোর মাধ্যমে বোর্ডে পাস করা হবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী বর্তমানে কাজ চলছে। ভার্চুয়াল বোর্ড সভার বিষয়ে শামস-উল ইসলাম বলেন, ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাংকের আইটি বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে। দু’এক সপ্তাহের মধ্যে অনলাইন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বোর্ড সভা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ব্যাংকখাত। বর্তমান দুর্যোগে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখতে তেমন কর্মসূচি নেই। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ব্যাংকগুলোকেই করতে হবে। তাই তাদেরকে আরও পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। কিভাবে এগুলো বাস্তবায়ন করা হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে গ্রাহককে জানাতে হবে। শুধু টাকা দেওয়া-নেওয়ার কাজ করলেই হবে না। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই তাদেরকে আরও সচল হতে হবে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আগের মতোই প্রতি সপ্তাহেই বোর্ড সভা হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন তারা। এক্ষেত্রে প্রতিদিন সারাদেশের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সভারও উদাহরণ দেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের উদ্যোক্তা শ্রেণীর সামাজিক দর্শনের মধ্যে মানবসেবা করার মনোবৃত্তি খুবই কম। ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বড় করপোরেট ও ধনী শ্রেণী যেভাবে নভেল করোনাভাইরাস মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছে, সেভাবে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে না। অথচ ব্যাংক উদ্যোক্তারা বছর শেষে চাইবেন বড় মুনাফা। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্ত ছিল। এখন গ্রাহকদের ব্যবসা যেমন বন্ধ, ব্যাংকের ব্যবসাও বন্ধ। ফলে আগামীতে সঠিক পথে হাঁটতে না পারলে দেশের অনেক ব্যাংকেরই অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা আছে।

সূত্র মতে, নিজ গ্রাহকদের সুরক্ষা দিতে ৮৩০ কোটি ডলার রিজার্ভ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন জায়ান্ট জেপি মরগান চেজ। ৩৩০ কোটি ডলারের রিজার্ভ গঠনের ঘোষণা দিয়েছে ওয়েলস ফার্গো। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় এ দুটি ব্যাংকই নভেল করোনাভাইরাসে বিধ্বস্ত গ্রাহকদের টেনে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। স্থবির অর্থনীতিতে খেলাপি ঋণের অভিঘাত সামলানোর প্রস্তুতিও নিচ্ছে ব্যাংক দুটি। একই ধরনের প্রস্তুতির কথা জানাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোও।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি একেবারেই উল্টো। সীমিত আকারে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। নগদ অর্থ জমা-উত্তোলনের মতো সেবা দিতেই নাকাল পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ আর জনগণের কাছে সরকারি সেবা পৌঁছে দিতেই লেজেগোবরে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। বিদ্যমান অচলাবস্থা ও করোনাপরবর্তী পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহীতাদের টেনে তোলার চিন্তাও দেখা যাচ্ছে না ব্যাংকারদের মধ্যে।

এখন পর্যন্ত ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি দেশের কোনো ব্যাংক থেকে। পরিস্থিতি নিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা (বোর্ড মিটিং) হয়েছে-এমন তথ্যও শোনা যায়নি। তবে অনেক বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে ব্যাংকখাতকে দ্রুত গতিশীল করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয়কে এক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ারও তাগিদ দেন তারা। অন্যথায় দেশের আর্থিকখাত চরম দুরাবস্থার মধ্যে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলেও বর্তামন স্থবিরতা থেকে নিজস্ব কোনো চিন্তা-ভাবনা উঠে আসেনি। বেশির ভাগ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরাই বলেছেন, দুর্যোগ চলছে। এর মধ্যেতো কিছু করা সম্ভব নয়। তবে বোর্ড সভার বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন বলে জানিয়েছেন অনেকে। যদিও কিছু বেসরকারি ব্যাংক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের করণীয় ঠিক করছে। তবে এক্ষেত্রে পিছিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত¡ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদ কিংবা শীর্ষ নির্বাহীদের মনোভাবের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবীদ ড. জাহিদ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে অর্থনীতির চাকা একবারেই বন্ধ। ঋণের চাহিদা ও নতুন ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই ঠিক। কিন্তু সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার সবই বাস্তবায়ন করবে ব্যাংকগুলো। যা এই দুর্যোগের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অনেক কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি পরিকল্পনা করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে কিনা তা দেখতে হবে। আবেদনগুলো সঠিকভাবে যাচাই-বাঁছাই করতে হবে। কারা প্রণোদনা পাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। যা পরবর্তী বোর্ড সভায় পাস করতে হবে। এগুলো শুধু লেনদেনের কাজ নয়; ব্যাংকগুলোর এসব কাজ বাস্তবায়নে আরও পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির দরকার। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোকে আরও সচল হতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।

উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। করোনার সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে আপাতত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। জরুরি সেবা ছাড়া বন্ধ রয়েছে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই ব্যাংকগুলোকে অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং বর্তমান স্থবিরতা দূর করতে দ্রুতই বোর্ড সভাসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ