পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
করোনাভাইরাস মানবসমাজ ও মানবসভ্যতাকে এক অভ‚তপূর্ব বিপর্যয়ের মুখোমুখী এনে দাঁড় করিয়েছে। এই প্রাণঘাতী ভাইরাস এত দ্রুত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে যে, অতীতে আর কোনো ভাইরাসের এমন আগ্রাসীরূপ দেখা যায়নি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে এর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। দ্রুত তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ১১ মার্চ একে মহমারী ঘোষণা করে। বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে করোনা এখন বিশ্বজুড়েই মহা আতঙ্কের নাম। এ পর্যন্ত ২১০টি দেশে এর বিস্তৃতি ঘটেছে। সর্বশেষ গতকাল রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ২৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৭ জন। মৃত্যুবরণ করেছে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৪১ জন।
তবে বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক দল গবেষকের দাবি, বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ২৩ লাখ বলা হলেও এ সংখ্যাটি কম করে হলেও ১১ কোটি ৫০ লাখ। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। লক্ষ্য করার বিষয়, এর প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার পরও সংক্রমণ ঘূর্ণিবেগে বাড়ছে। দেখা গেছে, ১৩ দিনের ব্যবধানে সংক্রমিতদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডবিøউএইচও বিশ্বের সব দেশকেই চীনের মতো মৃত্যুর গণনা সংশোধনের আহবান জানিয়েছে। সংস্থার প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘চলমান মহামারির মধ্যে এটা একটা চ্যালেঞ্জের বিষয়- আক্রান্ত ও মৃতের হিসাব নথিভুক্ত করা। আমি অনুমান করছি যে অনেক দেশই একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। আমাদের আবার নতুন করে হিসাবের খাতা খুলতে হবে এবং দেখতে হবে, আমরা সঠিক গণণা করেছি কিনা?
করোণাসংক্রমণ রোধে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি ইতিবাচক সুফল দেয়ায় গোটাবিশ্বই এক প্রকার লকডাউনে আছে, মানুষ আছে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার নির্দেশও কড়াকড়িভাবে সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে গৃহবন্দি। সব কিছু বন্ধ। কলকারখানাসহ সকল উৎপাদন ব্যবস্থা স্থবির, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত, পরিবহন ইত্যাদি প্রায় সর্বাংশে অচল। মানুষের কর্মপ্রবাহ ও সভ্যতার অগ্রগতি এভাবে আর কখনো থমকে যায়নি। মার্কিন প্রতিবাদী ও প্রবীণ বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি করোনার ভয়বহতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পরবর্তীতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, আমরা মানবসভ্যতার সবচেয়ে বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছি। তার মতে, পৃথিবী দুটি ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। এর একটি হলো পারমাণবিক যুুদ্ধ এবং অপরটি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। তার ভাষায়, ভবিষ্যতে করোনা থেকে পৃথিবী মুক্ত হতে পারলেও এ দুটি আশঙ্কা থেকেই যাবে। নোয়াম চমস্কি প্রসঙ্গক্রমে করোনার একটি ইতিবাচক দিকও উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, এর ভালো দিক হলো, মানুষ এটা ভাবতে বাধ্য হবে যে, আমরা আসলে বসবাসের জন্য কী ধরনের পৃথিবী চাই।
ইতোমধ্যেই এ ভাবনা শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা, সরকারপ্রধান, সরকারি পদাধিকারী, বিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিদ, সমাজনেতা, মনোবিদদের মধ্যে অন্তত এই উপলব্ধি জাগ্রত হয়েছে যে, করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারীর বিপর্যয় রুখতে একসঙ্গে কাজ করার বিকল্প নেই। রাষ্ট্র পরিচাকলকদের পর্যায় থেকে পারস্পারিক সহযোগিতার কথা বলা হচ্ছে, নানা প্রতিশ্রæতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হচ্ছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর বাস্তবায়নও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। অন্যদিকে বিজ্ঞানী, গবেষক, চিকিৎসাবিদরা করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য নিরলস ও আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যেও তথ্যের আদান-প্রদান ও সহযোগিতামূলক মনোভাব প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। গবেষণার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অকাতরে দান করছেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিলিয়নেয়ার বিল গেটস প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ‘ভ্যাকসিনটি দ্রুত আবিষ্কারে যত অর্থই লাগবে তা আমি দেব। বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর থেকেও দ্রুত আমি চেকে সাইন করে যাব। আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব তাই করবো’।
এদিকে সবকিছু বন্ধ থাকায় পৃথিবী তার আসল চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে। প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ মনোহর ও চিত্তহারী রূপে আবিভর্‚ত হচ্ছে ক্রমশঃ। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য, নিরাময় ও শান্তিময় করে তোলার তাকিদ অনুভ‚ত হচ্ছে বিভিন্ন মহলে ও পর্যায়ে। করোনার কারণে জীবনের মূল্যমান যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে কাক্সিক্ষত পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনীয়তাও উজ্জীবিত হয়েছে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব চীনে হলেও দেশটি ইতোমধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হয়েছে। তার মতো দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং জাপানও সফলতা দেখিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন প্রভৃতি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ রীতিমত নাজেহাল অবস্থায় পতিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও করোনার হটস্পট ছিল ইউরোপ। এখন যুক্তরাষ্ট্র তার স্থান নিয়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৯ এবং মৃতের সংখ্যা ৪০ হাজার পেরোতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর আক্রান্তের সংখ্যা স্পেনে বেশি হলেও মৃতের সংখ্যা ইতালিতে বেশি।
বৈশ্বিক এই মহামারীর কবল থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মোটেই মুক্ত নয়। ঘনবসতিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা ভয়ঙ্কররূপে আবিভর্‚ত হতে পারে, এমন আভাস বিভিন্ন সংস্থার তরফে আগেই দেয়া হয়। এখন আমরা দেখছি, বাংলাদেশ ও ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে করোনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার ৪৫৬। আর মৃতের সংখ্যা শ’ পেরুতে চলেছে। সংক্রমণে শীর্ষ ৬ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সংক্রমণ ধারায় মিল রয়েছে। তবে ১ হাজার আক্রান্ত পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি। এই সঙ্গে করোনা উপসর্গে মৃতের সংখ্যা দেড়শ’-দু’শ’র কম হবে না। বাংলাদেশের এ চিত্র যেকোনো বিবেচনায় অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের জেলা-উপজেলা একের পর এক লকডাউন করা হচ্ছে। স্বেচ্ছা লকডাউনও হচ্ছে নানান এলাকায়। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নির্দেশও কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে অনেক ক্ষেত্রে সে চেষ্টা ব্যর্থও হচ্ছে। কর্মহীন, অসহায় ও দরিদ্র মানুষ এবং শ্রমিকদের একাংশকে সামলানো যাচ্ছে না। মানুষকে ঘরে আটকে রাখা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নির্দেশ কঠোরভাবে বলবৎ করা এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও জরুরি। এইসঙ্গে পরীক্ষাসক্ষমতা বৃদ্ধি ও শনাক্তকরণ এবং সংক্রমিতদের জন্য দ্রæত চিকিৎসা আবশ্যক। এসব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সামর্থ্য এখনো আসেনি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই। করোনা প্রতিরোধক পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাবলী আমরা যত ভালোভাবে কার্যকর করতে পারবো, পরীক্ষা, শনাক্তকরণ বেশি বেশি করতে পারবো ততই করোনা মোকাবেলা আমাদের জন্য সহজ হবে।
এই ভয়ঙ্কর বৈশ্বিক মহামারী থেকে আমরা যেমন নিজেদের মুক্ত রাখতে পারিনি, তেমনি এর বহুমুখী ও বিবিধি প্রতিক্রিয়া থেকেও মুক্ত হওয়া বা থাকাও আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা সবাই একমত যে, করোনাকারণে সবচেয়ে বড় সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্ব অর্থনীতির যে ধূসর চেহারা এর মধ্যেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, তাতে বুঝা যায়, আগামীতে এক অভাবিত অর্থনৈতিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। আইএমএফ জানিয়েছে, এই অর্থবছরে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সঙ্কুচিত হতে পারে, যা ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর সবচেয়ে বেশি সঙ্কোচনের হার। সংস্থাটির তরফে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে, মন্দা আসলে শুরু হয়ে গেছে। তার মতে, করোনা বিশ্বকে একটা ভিন্ন মাত্রার সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশেষেজ্ঞদের মতে, এই সঙ্কট এমন একটা বিপর্যয়কর মন্দা উপহার দিতে যাচ্ছে, যা বিশ্ব কখনো দেখেনি। আইএমএফ’র প্রধান অর্থনীতিবিদ গীতা গোপিনাথ বলেছেন, চলমান সঙ্কটে আগামী দু’বছর বৈশ্বিক জিডিপি কমে যেতে পারে ৯ লাখ কোটি ডলার। করোনাউদ্ভূত মহামন্দার পর উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় শ্রেণির দেশই আর্থিক দুরবস্থায় পতিত হবে। এ দুরবস্থা থেকে উঠে এসে করোনাপূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়া উন্নয়নশীল দেশগুলো তো পরের কথা, উন্নত দেশগুলোর পক্ষেও সম্ভব হবে না।
মহামন্দায় কৃষি-শিল্পসহ সকল ক্ষেত্রেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। শিল্পপণ্যের উৎপাদন কমবে। শিল্পকারখানা ঢালাওভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যাতে বেকারত্ব ও কর্মহীনতা বাড়বে। বাণিজ্য প্রবাহ হ্রাস পাবে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে ধস সৃষ্টি হবে। মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। দারিদ্র্য বিস্তৃত হবে। রফতানি আয় ও রেমিটেন্স কমবে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার তরফে যা আভাস দেয়া হয়েছে, তাতে কোটি কোটি মানুষ বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং দরিদ্রদের মুখে খাদ্য তুলে দিতে না পারলে অন্তত তিন কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করবে।
বিশ্ব অর্থনীতির আশংকিত সঙ্কট থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিও, বলা বাহুল্য, মুক্ত থাকতে পারবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি প্রধান স্তম্ভের একটি হল গার্মেন্টপণ্য রফতানি থেকে অর্জিত আয় এবং অপরটি হল, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিটেন্স। এই দুটি ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। বাংলাদেশি গার্মেন্টপণ্য রফতানি হয় মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে। করোনায় সবচেয়ে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো। ইতোমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রফতানি অর্ডার বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে, ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করায়। করোনাকারণে গার্মেন্ট কারখানাগুলো চালু ও রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা এখনো বলা যাচ্ছে না। এখন কারখানা বন্ধ। শ্রমিকরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা নির্দেশ অমান্য করে বেতনভাতার জন্য রাস্তায় বিক্ষোভ করছে। মালিকরা কারখানা লে-অফ করার চিন্তা-ভাবনা করছে।
ওদিকে প্রবাসী আয়েও ধস অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন দেশের চাকরিদাতারা আগে থেকেই বিদেশিকর্মী রাখা ও আমদানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করছিল। করোনাকারণে এই মনোভাব আরো জোরদার হয়েছে। ফলে আগামীতে বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান তো পরের কথা, বিপুল সংখ্যক কর্মীর চাকরি হারানোর আশঙ্কাই প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায়, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির আশা কীভাবে করা যায়? অর্থনীতির অন্যান্য দিকের অবস্থাও তথৈবচ। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। বিভিন্ন সূচকের অবনমন আগেই উদ্বেগের কারণ ছিল, এখন তা উদ্বেগকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। বস্তুত, গত ১০-১১ বছরের অর্জন করোনাকারণে রীতিমত মুছে যেতে বসেছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, খাদ্যাভাব ইত্যাদি আবার ফিরে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশ্বের দেশগুলো ৬ মাস আগেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা কল্পনা করতে পারেনি। এখন মহামারী করোনার অপ্রতিরোধ্য তান্ডবে তারা বেদিশা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মহামন্দার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশই করোনা মোকাবেলায় সম্ভাব্য সব কিছুই করছে। একইসঙ্গে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচিও গ্রহণ করছে। এ জন্য দেশগুলো বিলিয়ন কে বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন কে ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫৪০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। অন্যান্য দেশও সাধ্যমত প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব প্যাকেজের মধ্য দিয়ে তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কতটা সম্ভব হবে, তা বলার উপায় নেই। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কৃষি ও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে এই প্রণোদনা দেয়া হবে। তবে অনেকের মতে, করোনাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় এই প্যাকেজ যথেষ্ট নয়।
আসলে কোনো দেশের প্রণোদনা প্যাকেজই যথেষ্ট নয়। এমনকি সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্যাকেজও। করোনা মোকাবেলা, প্রতিরোধক আবিষ্কার, মানবিক পরিস্থিতির অবনমন রোধ ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ইত্যাদির জন্য ব্যয়নির্বাহ কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। এ জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ঋণ ও অনুদান সহায়তা ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এডিবি ২০ বিলিয়ন ডলার, আইএমএফ ১ ট্রিলিয়ন ডলার, বিশ্বব্যাংক ১৬০ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গও করোনা প্রতিরোধ ও দুর্গত মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন। বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস এ জন্য আগে ঘোষিত ১০০ মিলিয়নের সাথে আরো ১৫০ মিলিয়ন ডলার যোগ করার ঘোষণা দিয়েছেন। ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ২০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছেন। আলীবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা প্রায় ২ কোটি ডলার ঘোষণা করেছেন। এরকমভাবে বিশ্বের ধনীরা, ক্রীড়াবিদরা, চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমানরা তাদের সাধ্য অনুযায়ী সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। তাদের এই মানবিকতা ও মহানভবতা অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কোন দেশের পক্ষেই উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিয়ে অর্থনৈতিক পুরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও একথা সমান সত্য। এ জন্য গোটা জাতিকেই যার যা সামর্থ্য আছে, সঙ্গতি আছে, তাই নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় ৫ কোটি শ্রমিক কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকেও কর্মচ্যুতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। শহরে-গ্রামে বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র। কারো অবস্থান দারিদ্র্যসীমায়, কারো সামান্য ওপরে, কারো বা নিচে। বলা হয়েছে, করোনাকারণে হাজার হাজার পরিবারের অবস্থানের অবনমন ঘটবে। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা যখন করোনাভীতি উপেক্ষা করে রাস্তায় বিক্ষোভ করে, অসহায়, দরিদ্র ও বুভুক্ষু মানুষ যখন রিলিফের দাবিতে মিছিল করে তখন মানবিক পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক ও নাজুক সেটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। অসহায়, দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের খাদ্য সংস্থান এবং অন্যান্য প্রয়োজন কীভাবে মিটবে তা যেমন সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে, তেমনি সামর্থ্যবান মানুষদেরও আমলে নিতে হবে। এসব মানুষের খাদ্যসহ সব ধরনের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিত করা অবশ্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি এবং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে একটা যৌথ নিবন্ধ লিখেছেন। ওই নিবন্ধে তারা ভারতের গরিব ও অসহায় লোকদের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের জন্য কিছু করার এটাই উত্তম সময় বলে মন্তব্য করেছেন। ভারতের গরিব-অসহায়দের ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশসহ তাবৎ করোনাক্রান্ত দেশের গরিব-অসহায়দের ক্ষেত্রেও তাদের মন্তব্যের প্রযোজ্যতা প্রশ্নাতীত।
আমরা ১৪ এপ্রিল প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে সকলের উদ্দেশে একটি সাধারণ প্রস্তাব রেখেছিলাম। নববর্ষ উপলক্ষে অনেকেরই খরচের বাজেট থাকে। বলেছিলাম, আসুন, এবার যেহেতু অনুষ্ঠান, উৎসব, কেনাকাটা কিছুই হচ্ছে না, সুতরাং ওই বাজেটের অর্থ গরিব, দুঃখী, অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়ে একটা ভিন্ন রকম নববর্ষ উদযাপন করি। আমাদের প্রস্তাব সমর্থন করে অনেকেই অসহায় ও বিপন্ন মানুষকে সহায়তা করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। অভাবগ্রস্ত, অসহায়, সম্পদহীন, কর্মহীন, এতিম, বিপদ ও দায়গ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ হলেও অত্যন্ত বিস্ময়কর এই যে, মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই এ ব্যাপারে খর্বহস্ত। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও তারা মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে চায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষকে সহায়তা করার মতো মহৎ কাজ বা সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না। করোনা মানুষকে সাহায্য ও সহায়তা করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।
সামনে পবিত্র রমজান মাস। রহমত, বরকত, মাগফেরাতের এই মাস মুসলমানদের জন্য ইবাতদের মওসুম হিসেবে গণ্য। শুধু রোজা, নামাজ, তারাবি নয়, জাকাত, দান-খয়রাত, ইফতার ও খাদ্য দান ইত্যাদি অপরিসীম পুণ্যের কাজ। সাধারণ অবস্থায় মানুষ নেক আমল করে যে সওয়াব পায় রমজান মাসে সে আমলের জন্য ৭০ থেকে ৭০০ গুণ বা তারও বেশি সওয়াব দেন আল্লাহ। আমাদের দেশে রমজান মাসেই জাকাত প্রদান ও দান-খয়রাত বেশি বেশি হয়ে থাকে। জাকাত বিধিবদ্ধ বিধান নির্দেশিত পন্থায় তা দেয়া বাধ্যতামূলক। ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ জাকাত হিসেবে প্রদান করতে হয়। এ ব্যাপারে বলার কিছু নেই। যারা জাকাত দেয়ার উপযুক্ত তাদের তা দিতেই হবে। ইসলামে নামাজের পরেই জাকাতের প্রসঙ্গ এসেছে। এ থেকে জাকাতের গুরুত্ব বুঝা যায়। এছাড়া যে যত বেশি ইচ্ছা দান-সদকা করতে পারে। রমজানে তো বটেই, অন্য সময়েও।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যারা আল্লাহর গ্রন্থ পড়ে, নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে নিশ্চয় তারা আশা করে, যার মধ্যে কখনো লোকসান হবে না। (এই ব্যবসায়ে তাদের সবকিছু লাগিয়ে দেয়ার কারণ এই যে) যাতে আল্লাহ তাদেরই বদলা পুরোপুরি তাদেরকে দিয়ে দেন এবং তার মেহেরবাণী থেকে আরো বেশি দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি গোনাহ মাফ করেন এবং নেক আমলের কদর করেন। সুরা ফাতির: ২৯-৩০। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। তার বান্দা হিসেবে মানুষ সেই ধন-সম্পদের ভোগাধিকার লাভ করে। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা বার বার বলেছেন, আমি যে ধন-সম্পদ তোমাকে দান করেছি তা থেকে দান করো। আল্লাহ দান করা ধন-সম্পদের বহুগুণ বাড়িয়ে দেন। তিনি বলেছেন, যারা আল্লাহর পথে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়, প্রত্যেকটি শীষে একশ করে দানা থাকে। আল্লাহ তায়ালা চান আরো বাড়িয়ে দেন। তিনি তো অত্যন্ত দানশীল ও সর্বজ্ঞ। সুরা বাকারা: ২৬। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অভাবগ্রস্ত, দীন-দুঃখীদের মধ্যে দান কারার নামই সাদকা। আল্লাহ তায়ালা রাসুল সা.-কে মুসলমানদের কাছ থেকে সাদকা আদায় করার তাকিদ দিয়েছেন এবং বলেছেন, সাদকা তাদের পবিত্র করবে, তাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধান করবে।
এই বালা-মুসিবত ও বিপদের দিনে আমাদের বেশি করে সালাত আদায় করতে হবে, জাকাত দিতে হবে এবং দান-খয়রাত করতে হবে। বিপদাপদ মানুষের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা ও সতর্কবার্তা। তাই যে কোনো সঙ্কটে ও মহামারীতে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে হবে। দোয়া-দরূদ ও নেক আমলে যেমন সওয়াব হয়, তেমনি আজাব-গজব থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে মুমিনগণ, তোমরা ধৈর্য্যরে সঙ্গে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সঙ্গে আছেন, যারা মুসিবতে বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং আমরা তার কাছেই ফিরে যাবো। সুরা বাকারা: ১৫৩।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বার বার নামাজ ও দোয়া দরূদ পাঠ করার তাকিদ দিয়ে যাচ্ছেন। আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখও একই আহŸান জানাচ্ছেন। এর পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই জাকাত ও ফিতরা যথাযথভাবে আদায় করতে হবে, দান-খয়রাত বাড়িয়ে দিতে হবে। দুস্থ-অসহায় মানুষের কল্যাণে আমাদের বিশেষ আহŸান, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান, বেশি বেশি দান-খয়রাত করুন। এই রমজানে অনেকে খাদ্যখানার অতিরিক্ত আয়োজন করে থাকে, যার একটা অংশ অপচয় বা নষ্ট হয়ে যায়। এবার অতবেশি আয়োজন থেকে বিরত থাকতে হবে। এ থেকে যে অর্থ-সাশ্রয় হবে তা দরিদ্র ও অভাবীদের দান করলে তারা উপকৃত হবে।
আমরা বরাবরই দেখে আসছি, রমজানে সরকারি-বেসরকারিভাবে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এবার করোনার কারণে ইফতার মাহফিল হবে না। এই খাতে ব্যয়যোগ্য অর্থ গরিব-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করে দিলে দানের সওয়াব যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষ উপকার লাভ করবে। আমরা আশা করতে চাই, সরকার ও আলেম সমাজ বেশি বেশি দান-খয়রাত করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ-পদক্ষেপ নেবে। মনে রাখতে হবে, অভাবী অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
বিপদকালে আল্লাহমুখিতা বেড়ে যায়। মানুষ আল্লাহর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তার সাহায্য কামনা করে। এই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা যে একমাত্র আল্লাহর করোনা সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় অহং ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। করোনাকালে মানুষের মধ্যে আল্লাহমুখিতাই শুধু বাড়েনি, নেক আমলও বেড়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমতের জন্য এই আল্লাহমুখিতা ও নেক আমল অব্যাহত রাখতে হবে। আল্লাহই একক অভিভাবক ও শ্রেষ্ঠ সাহায্যকারী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।