পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘গরিবের ডাক্তার’ খ্যাত ডা. মো. মঈনউদ্দিনের মৃত্যুতে কাঁদছে হাজার হাজার মানুষ। চিকিৎসা পেশায় এসে তিনি আত্মমানবতার সেবায় প্রাণ বলিদানের মধ্যদিয়ে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু সিলেট-সুনামগঞ্জ নয়, সারাদেশের মানুষ কাঁদছে। ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
করোনা চিকিৎসা দেয়া নিয়ে অন্য ডাক্তাররা যখন অপারগতা প্রকাশ করেন; তখন সিলেটে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে এগিয়ে আসেন ডা. মো. মঈনউদ্দিন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীর চিকিৎসা দিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন ৯ দিন করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করে গতকাল বুধবার ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদছেন সিলেটের হাজার হাজার মানুষ। ডাক্তার মঈন শিখিয়ে গেলেন ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন দেয়া গৌরবের’।
ডা. মঈন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গ্রামে এসে অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিতেন। অসহায়দের বিনামূল্যে ওষুধও দিতেন। কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত ওষুধের স্যাম্পল তিনি বিলিয়ে দিতেন এলাকার অসহায় রোগীদের মধ্যে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এলাকার অসহায় মানুষদেরই সেবার পাশাপাশি সিলেটের চেম্বারে এলাকার কেউ গেলে তাদেরকেও বিনামূল্যে সেবা দিতেন। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ এমন গরিবের বন্ধু ডাক্তারকে হারিয়ে শোকে কাঁদছেন। করোনা ভয় উপেক্ষা করেও তারা গ্রাম ও এলাকা থেকে বেরিয়ে পরস্পরের সঙ্গে স্মৃতি রোমন্থন করছেন।
ডা. মঈন উদ্দিনের পিতা মুনসী আহমদ উদ্দিন ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক এবং আলেম ছিলেন। তার একমাত্র ছেলে সন্তান ছিলেন ডা. মঈন। মৃত্যুকালে ডা মঈন দুই অবুঝ ছেলে, স্ত্রী পার্ক ভিউ মেডিক্যাল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. ইফ্ফাত জাহান এবং তিন বোন রেখে গেছেন। তার তিন বোনের সবাই শিক্ষক। ডা. মঈনের শ্বশুর ডা. নুর আহমদ ও শাশুড়িও চিকিৎসক।
উত্তর খুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডা. মঈন উদ্দিনের আত্মীয় মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, তিনি একজন মেধাবী ও সৎ চিকিৎসক ছিলেন। তার মৃত্যুতে কেবল তার জন্মস্থান ছাতক নয়, পুরো সিলেটের মানুষ কাঁদছে। তিনি গরিব রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না। বিশেষ করে গ্রাম থেকে যাওয়া গরিব রোগীদের ভালোবাসতেন। তিনি আমার পারিবারিক চিকিৎসকও ছিলেন। এলাকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আছকির মিয়া বলেন, এলাকার অসহায় হিন্দু-মুসলিম সবাই ডা. মইনুদ্দিনের কাছ থেকে বিনামূল্যে সেবা পেয়েছেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এসে তিনি এলাকার রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। বিনা ফিতে দেখা দরিদ্র রোগীদের কোম্পানি প্রদত্ত ওষুধও বিলিয়ে দিতেন। এলাকার মুরুব্বী সোহেল আহমদ বলেন, ডা. মঈনুদ্দিন গরিবের ডাক্তার ছিলেন। তিনি মানুষের সঙ্গে এমন ভালো ব্যবহার করতেন যাতে রোগীর রোগ অর্ধেক কমে যেতো। ডাক্তার মঈন উদ্দিনের গ্রামের বাসিন্দা গিরিধর দাস বলেন, ‘ডা. মঈন গরিব মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে মানুষ কাঁদছে।
রোগী দেখার ফিস বেশি নেয়া এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে চুক্তি করে পয়সা নেয়ায় রোগীদের অধিক পরীক্ষা দেয়ায় বেশিরভাগ ডাক্তারকে ‘কসাই’ সম্বোধন করে নিন্দুকেরা। কিন্তু ডা, মঈন ছিলেন ব্যতিক্রম। মানবদরদি চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিন গরিব মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দেয়ায় তাকে গরিবের ডাক্তার উপাধি দেয়া হয়।
ডা. মঈন ছিলেন সিলেটে করোনা যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা। তিনি সিলেটে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ টিমের সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর সিলেটে ছড়িয়ে পড়ার পর তার সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীসহ সিলেটবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পরোপকারী এই চিকিৎসকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তার রুহের শান্তি কামনা করে অনেকে দোয়া চেয়েছেন। তার স্মৃতিচারণ করে অনেকেই লেখেন, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের গরিবের চিকিৎসক। মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ গুণী চিকিৎসকের মৃত্যুতে যেন কাঁদছে সিলেটের হাজারো মানুষ।
২০১৪ সালে এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর এখানেই তিনি গ্রামের খেটে খাওয়া গরিব-দুঃখী মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তার সেবা নিয়ে খুশি ছিলেন রোগী ও স্বজনরাও। ডা. মঈন উদ্দিনের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়া একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগী নগরের আখালিয়া এলাকার আরব আলী তার মৃত্যুর খবর শুনে সাংবাদিকদের ফোন করে বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে প্রাইভেটে দেখিয়ে আসছি। এই সমাজে তার মতো একজন ভালো চিকিৎসক পাওয়া বিরল।
জানা গেছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হন ডা. মঈন উদ্দিন। তিনি সিলেটের প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী। গত ৫ এপ্রিল আইইডিসিআর থেকে তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। ৩০ মার্চ থেকে তিনি তার বাসায় কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। পজেটিভ রিপোর্ট আসার পর নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে গত ৭ এপ্রিল সিলেট নগরের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে করোনা আইসোলেশনে সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়। ৮ এপ্রিল পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালেই তার চিকিৎসা চলছিল। অবস্থার অবণতি ঘটলে ১৩ এপ্রিল তাকে আইসিইউয়ে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) নেয়া হয়। আইসিইউয়ে থাকা অবস্থায় বুধবার ভোর সাড়ে ৪টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডা. মঈন উদ্দিন ছিলেন সিলেটের একজন মেধাবী চিকিৎসক। তিনি মেডিসিনের পাশাপাশি কার্ডিওলজিরও চিকিৎসক ছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ১৯৯৮ সালে তিনি এফসিপিএস’র পাশাপাশি কার্ডিওলজিতে এমডি করেন। এ কারণে রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তার সহজ, সরল ও সাবলীল ব্যবহার রোগীদের মুগ্ধ করতো।
ডা. মঈন উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের নাদামপুর গ্রামে। নাদাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ধারণনতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি, সিলেটের এমসি কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যালে। এমবিবিএস পাসের পর তিনি এফসিপিএস ও এমডি কোর্সসম্পন্ন করেন। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন।
স্বাস্থ্য ক্যাডারে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের ২০ মে তিনি এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ কলেজে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে ডা. মো. মঈনউদ্দিনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এই মহৎপ্রাণ চিকিৎসক নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে গেছেন। দেশ ও জাতি তার এই ত্যাগ মনে রাখবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।