Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনা মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ যথাযথ ছিল না: গবেষণা প্রতিবেদন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫৮ এএম

দেশে করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর থেকে নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নেওয়া সরকারি পদক্ষেপ যথাযথ এবং বিশ্বাসযোগ্য ছিল না বলে মত দিয়েছেন দেশের সাত জন গবেষকের একটি দল।
গত ১ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের ১২টি জাতীয় দৈনিক এবং অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং সমালোচনার ভিত্তিতে ‘করোনাকালীন মানবাধিকার পরিস্থিতি’ গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণাটি করেন আনু মুহাম্মদ (শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), শহিদুল আলম (আলোকচিত্রী), ফরিদা আক্তার (নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী), জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট), রুশাদ ফরিদী (সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সাইদিয়া গুলরুখ (গবেষক ও সাংবাদিক) ও রেজাউর রহমান লেনিন (গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী)।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এই মহামারী প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে অন্তত দুই মাস সময় পেলেও এই সময়টাতে সরকার যথাযথ সাড়া দেয়নি এবং প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য, কৃষি, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন খাতের অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণাপত্রে।
দেশের স্থল-জল-বিমান বন্দরগুলোতে চলাচলের ক্ষেত্রে নূন্যতম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হয়েছে বলেও এতে অভিযোগ করা হয়।
অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা
গবেষণা প্রতিবেদনে আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল বলে সমালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এই মুহূর্তে শুধু করোনার জন্য নিবেদিত আইসিইউ প্রস্তুত রাখা আছে ১০০ থেকে ১৫০টি। গবেষকেরা বলছেন, সংক্রমণের চতুর্থ পর্যায়ে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য যা যথেষ্ট নয়।
স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য যথাসময়ে পারসোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সরবরাহ করা হয়নি বলেও এতে জানানো হয়।
গবেষণায়পত্রে বলা হয়েছে, মার্চের ৮ তারিখ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর লক্ষণ নিয়ে অন্তত ১৩০ জন মারা গেছে। এই মৃত্যুগুলোকে ‘নিউমোনিয়া’, ‘সাধারণ জ্বর’ ও শ্বাসকষ্ট’, কিংবা ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলা হয়েছে। এমনকি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার নজিরও আছে।
করোনা পরীক্ষা নিয়ে টাল বাহানা
গবেষকেরা বলেন, করোনা নির্ণয় পরীক্ষা নিয়ে টাল বাহানা করা হয়েছে। শুরু থেকেই রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর ১ হাজার পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলেও তা করা হয়নি উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ৮৩১৩ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয়েছে।
পরীক্ষার পুরো বিষয়টি সরকার শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছে, এমনকি সরকারি অন্য সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করার অভিযোগ করেছেন গবেষকরা। গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বল্প খরচের টেস্ট কিট তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
বলা হয়, গণস্বাস্থ্যের কিট তৈরিতে বাধা দেয়া হলেও, বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া সরকারি দলের নেতারা অবৈধভাবে চীন থেকে অনির্ভরযোগ্য টেস্টিং কিট আমদানি করে বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করেছেন।
কৃষিখাতে দুর্যোগের আশঙ্কা
সারাদেশে প্রায় লকডাউন পরিস্থিতিতে কৃষিখাত ভয়ংকর দুর্যোগের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে উল্লেখ করে গবেষণায় বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব ঘটবে বলে আশঙ্কা জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ঘরবন্দি মানুষ কিভাবে খাদ্য পাবে কিংবা কিনবে তার কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী, গত ৫ এপ্রিল ৭২,৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কৃষি ও কৃষকের জন্য আলাদা করে কোন প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার মুখে, অনেক দেরিতে হলেও, ১২ এপ্রিল কৃষি ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার ‘প্রণোদনা তহবিল’ করার ঘোষণা দেয়া হয় উল্লেখ করে গবেষণায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, এটি আসলে কতটা প্রণোদনা আর কতটা ঋণ এবং তার কত অংশ আসলে কৃষকরা পাবেন?
অমানবিক অবহেলার শিকার শ্রমিকেরা
করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটির মধ্যে গার্মেন্টস, চা শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা হয় এই গবেষণায়।
পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে সরকার এবং মালিকেরা মিলে ‘পিংপং’ বলের মতো একবার ঢাকা থেকে বাইরে ও পরে বাইরে থেকে ঢাকাতে ছুঁড়ে ফেলার যে দৃষ্টান্ত রেখেছে তা ‘অমানবিক ও নিষ্ঠুর’ ছিল বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
মানবিক সহায়তা তছরুপ
করোনার সময়ে মানবিক সহায়তা তছরুপ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং এ প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা নেই উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়েছে, ৬৪ জেলায় সরকার চার দফায় ৬৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চাল এবং ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্যের জন্য তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে কিন্তু এগুলো কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে তা নিয়ে কোন সরকারি ঘোষণা নেই।

সহায়তা নিয়ে দুর্নীতিকারীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শাস্তির হুঁশিয়ারী সত্ত্বেও বিভিন্ন জেলায় চাল চুরি, ত্রাণ দেয়ার ছবি তুলে আবার ত্রাণ কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার সাথে জড়িত প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে।
সংক্রমণ মোকাবিলায় যেসব আইনের প্রয়োগ করা হয়েছে তার অধিকাংশই কোন সুনির্দিষ্ট আইনের মধ্যে পড়ে না বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই ‘তথ্য প্রবাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে চিন্তা, বিবেক, ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাংলাদেশ সরকার আঘাত করছে’।
এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির সুরক্ষা এবং পাহাড়ে হাম পরিস্থিতির বিষয়েও উদ্বেগ জানানো হয় এ গবেষণা প্রতিবেদনে।

 



 

Show all comments
  • নূরুন নবী ১৪ এপ্রিল, ২০২০, ১২:৫৭ পিএম says : 0
    সামনে মহাবিপদ বাংলাদেশের করোনা নিয়ে চরমভাবে অবহেলা করা হয়েছে আমি নিজেই খাদ্য সংকটের আশংকায় আছি, আমি নিজেই একজন গার্মেন্টস শ্রমিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ১৪ এপ্রিল, ২০২০, ৮:৪৪ পিএম says : 0
    আজকাল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত আঞ্চল থেকেও খবরাখবর আমরা পেয়ে যাই কারন এখন দেশে হাজার হাজার বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমের জন্ম হয়েছে। আবার সেইসব মাধ্যমের গ্রাম-সংবাদদাতাও রয়েছেন কয়েক লক্ষ সাংবাদিক তাই আমরা সংবাদ মাধ্যমে সকল খবরই পেয়ে যাই সঠিক ভাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই গবেষণায়পত্রে বলা হয়েছে, মার্চের ৮ তারিখ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর লক্ষণ নিয়ে অন্তত ১৩০ জন মারা গেছে এটাও খুবই সত্য কথা। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সরকারের কাজে বাধা প্রদান সহ প্রবাসীদের খামখেয়ালী ও তাদের দাম্ভিকতার কারনেও যে করোনা রোগে দেশের লোক আক্রান্ত তাছাড়া সরকারের নির্দেশ ঘরে থাকো না মানাতেও যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এসব খবরও আমার গবেষণায় এসেছে। তবে এখানে যারা গবেষণা করেছেন তারা বার বার সরকারের বিফলতার কথাই বলেছেন তাই না?? গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এই মহামারী প্রতিরোধের প্রস্তুতিতে অন্তত দুই মাস সময় পেলেও এই সময়টাতে সরকার যথাযথ সাড়া দেয়নি এবং প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হয়েছে”। আমি কানাডার নাগরিক, গত মার্চ ২০২০ মাসের ১৭ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেছি। আমি সেসময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে করোনা সংক্রান্ত খবর খুবই মন দিয়ে দেখতাম ও পড়তাম। আমি দেখেছি বাংলাদেশে সরকার তাঁর সাধ্যমত সকল ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন আমি যদি কানাডার সাথে বাংলাদেশকে মিলিয়ে বিচার করি তাহলে চলবেনা আমাকে বাংলাদেশের ক্ষমতার উপরই বিচার বিশ্লেষন করতে হেব এটাই সত্য। আমি দেখেছি বাংলাদেশ গরীব দেশ হলেও নিজ দেশের নাগরিকদেরকে করোনার উৎপত্তিস্থল চায়না থেকে ফেরত এনেছে উন্নত দেশের মত। এদেরকে এনে সরকার নিজ দায়িত্বে কোয়ারেন্টাইন করিয়েছেন। এমনকি পরবর্তীতে অন্যান্য যাত্রীদেরকেও সন্দেহ হলে সরকার নিজ দায়েত্বে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়েছেন (অগণিত সংখ্যা)। তারা বিমান বন্দরে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রেখেছে, সাথে সাথে যাদের মধ্যে করোনার আলামত প্রকাশিত হয়নি তাদেরকে বাসায় গিয়ে কোয়ারেন্টাইন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। ঠিক সেই সময় যদি আমাদের এসব বুদ্ধিজীবি নামধারিরা এগিয়ে এসে এসব প্রবাসিদেরকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্যে তাদের বক্তব্য সরকার যেমন সাবধানতার কথা প্রচার করছিল সেইমত এনারাও যদি প্রচার করতেন তাহলে দেশের অবস্থা আজ এমন হয়না কারন আমাদের দেশের লোক আবার সরকারের কথা শুনে না তবে সত্য হউক বা মিথ্যা হউক যারা এখানে গবেষণা করেছেন তাদেরমত বুদ্ধিজীবীদের কথা আবার জনগণ শুনেন এবং সেইভাবে চলেন; এটাই আমার গবেষণার ফল। সরকার ২৬ মার্চ বন্ধ ঘোষনা দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনকে রাস্তায় নামালেন আর তারা যখন মানুষকে ঘর মুখি করার জন্যে পদক্ষেপ নিলেন তখন এইসব গবেষকরা সরকারের সমালোচনা করে দেশের জনগণকে প্রশ্রয় দেয় যেজন্য লোকজন বাহিরে থাকে আর করোনাভাইরাসকে প্রশারিত করার জন্যে। আর আজ এনারা বলছেন সরকার সবকিছুর জন্যে দায়ী... আরে সরকার অবশ্যই সবকিছুর জন্যে দায়ী ঠিক আছে কিন্তু সাথে সাথে আপনারা যারা আজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলছেন আপনাদের যে সমাজের প্রতি দায় দায়িত্ব রয়েছে তাঁর কি আপনারা এতদিন করেছেন এর জবাবটা আপনারা দিতে পারবেন কি?? আজ সরকারকে একহাত দেখে নেয়ার জন্যে সাথে সাথে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপে বাধা দেয়ার জন্যে আজ আপনারা সমালোচনায় নেমেছেন এটাও আমার গবেষণায় উঠে এসেছে। আল্লাহ্‌ আমাকে সহ দেশের সকল লেখাপড়া জানা ব্যাক্তিদেরকে বুদ্ধিজীবি নয় শিক্ষিত করুন। আমিন
    Total Reply(0) Reply
  • A HANNAN KHAN ১৪ এপ্রিল, ২০২০, ১০:১২ পিএম says : 0
    করনার জন্য যে টাকা বা চাল খাদ্য, সরকার সহ বিভিন্ন মহল যে খাদ্য দিয়েছে,সে সব বিতরণ করা দরকার, সেনাবাহিনী দিয়ে। তাহলে আর কোন দিন ও এ দেশে জালীআতি হবেনা
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ