Inqilab Logo

বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অকার্যকর আইন

সময়োপযোগী নয় সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) বিধি স্বেচ্ছাচারী চিকিৎসা ব্যবস্থা গঠন হয়নি ‘জাতীয় কমিটি’

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২০, ১১:৫০ পিএম

মহামারী করোনা (কোভিড-১৯) মোকাবেলার লড়াইয়ে কাজে আসছে না ২০১৮ সালে প্রণীত ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন’। চিকিৎসা ব্যবস্থার হ য ব র ল অবস্থা। মানবিক হওয়ার মুহূর্তে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো হয়ে উঠেছে স্বেচ্ছাচারী। সাধারণ হাঁচি-কাঁশির লক্ষণ থাকলেই চিকিৎসা মিলছে না। ‘করোনা’ সন্দেহ হলেই ঠাঁই হচ্ছে না লোকালয়ে। একঘরে করে রাখা হচ্ছে। করোনার লক্ষণ নিয়ে ইন্তেকাল করলে ঠাঁই হচ্ছে না গোরস্থানেও। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাধা দিচ্ছেন দাফনে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর অনুরোধে মানুষ ঘরে থাকছেন বটে; কিন্তু কোয়ারেন্টাইনের বিধি-বিধান মানছে না।
আবার যে মানুষটি ‘মাস্ক’ শব্দটিও উচ্চারণ করতে পারেন না-তাকে দেয়া হচ্ছে মাস্ক পরিধান না করার শাস্তি। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন বলছে, করোনা আক্রান্ত ছাড়া মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু কোন আইনে কীভাবে কোনটি হচ্ছে এর স্পষ্ট কোনো ঘোষণা নেই। আইনজ্ঞরা বলছেন, একটি হ য ব র ল অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে করোনা মহামারী বিরোধী লড়াই। বিধি এবং নির্দেশিত জাতীয় কমিটি না থাকায় বিদ্যমান আইনের সুফল মিলছে না। গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টের নির্দেশে একটি উপদেষ্টা কমিটি করা হলেও আমলানির্ভর এই কিমিটির কার্যক্রম এখনো দৃশ্যমান নয়।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারতের ‘এপিডেমিক জিজিজেস অ্যাক্ট-১৮৯৭’র আদলে বাংলাদেশ সরকার ২০১৮ সালে ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন’ করে। কলেরা, ম্যালেরিয়া, ইবোলা, জিকা, সার্স মোকাবেলার মতো অভিজ্ঞতা নিয়ে আইনটি প্রণয়ন করা হয়। প্রণীত হওয়ার পরপরই বিশ্লেষকরা এটি নিয়ে সমালোচনা করেন। এটিকে এখন কেউ কেউ মূলতঃ বিধি-নিষেধ ও শাস্তি আরোপের ক্ষমতা চর্চার দলিল হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন।
তাদের মতে, আইনটির বড় ত্রুটি হচ্ছে, নতুন আবিভর্‚ত করোনার মতো মহামারী মোকাবেলায় আইনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কোভিড-১৯’ কে মহামারী ঘোষণা করলেও বিদ্যমান আইনে বাংলাদেশ সেটি করতে পারছে না। আইনে ২৩টি রোগকে ‘সংক্রামক রোগ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় নতুন আবিভর্‚ত করোনা কিংবা ‘কোভিড-১৯’ নেই। তবে ধারা ৪(ভ)-এ বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ঘোষিত কোনো নবোদ্ভূত বা পুনরুদ্ভূত রোগসমূহ’। অর্থাৎ ২৩টির বাইরে যদি অন্য কোনো সংক্রমক ব্যধি আবিভর্‚ত হয় সেটিও সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে এই আইনের আওতায় আনতে পারবেন।
হাইকোর্টের নির্দেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৩ মার্চ নভেল করোনা ভাইরাসকে (কোভিড-১৯) ‘সংক্রমণ ব্যধির’ তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে। গেজেটে গত ৮ মার্চকে বাংলাদেশে নভেল করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রথম তারিখ ধরা হয়েছে। গত ১৮ মার্চ হাইকোর্টে করোনাকে সংক্রমণ ব্যধি ঘোষণা করে গেজেট করার নির্দেশ দেন।
সূত্র মতে, গত ২২ মার্চ ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র দায়েরকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল এবং বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের অবকাশকালীন বেঞ্চ খাস কামরায় বসে আদেশ দেন। সেই আদেশে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কী কী উপকরণ দরকার তা নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করতেও বলা হয়। তবে এ নির্দেশনার আগেই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এ কমিটি আদালত নির্দেশিত কমিটি নয় বলে জানা গেছে।
এছাড়া আইনটির ৬ (১) ধারায় একটি ‘উপদেষ্টা কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে। আইনজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন- এটি সেই কমিটিও নয়। আইনটির ৫ ধারা অনুসারে আইনের অধীন ‘দায়িত্বপালন এবং কার্য সম্পাদনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক দায়ী থাকবেন’ মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। করোনার ব্যাপকতা, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলা, জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি, স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, দেশের অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জীবন যাত্রা বন্ধ কিংবা স্থগিত করার মতো সিদ্ধান্তও তাকেই নিতে হবে।
একই সঙ্গে ৬(১)ধারায় উল্লেখিত উপদেষ্টা কমিটিতেও স্বাস্থ্যের মহাপরিচালককে রাখা হয়েছে। উপদেষ্টা কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের উপরে রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু আমলাকে। মহাপরিচালককে চলতে হবে উর্ধ্বতন ৬ কর্মকর্তার পরামর্শ ও নির্দেশনায়। বিশ্লেষকদের মতে যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবাস্তব ও সাংঘর্ষিকও বটে।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের একটা আইন ছিলো। সেটিকে আপডেট করা হয়েছে। এতে ইবোলা, ডেঙ্গু, টাইফয়েডসহ অন্তত ২৩ রোগের কথা বলা হয়েছে। তবে কোভিড-১৯ নেই। তবে আইনের ৪ ‘ভ’ অনুসারে সরকার গেজেট করে এটিকেও আইনের অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। হাইকোর্টের আদেশে এটির গেজেট হয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। তবে এখনো গেজেট পাইনি।
আইনে সমস্ত ক্ষমতা সরকার তথা স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে দেয়া হয়েছে। কোনো হাসপাতাল অন্যান্য রোগের চিকিৎসা না দিলে কী করতে হবে সেটি তো প্রচলিত আইনেই আছে। হসপিটালগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। করোনাকে সরকার এখনও মহামারী ঘোষণা করেনি। মহামারী ঘোষণা করলে আইন কার্যকর করতে সুবিধা। আদালতও বলেছে মহামারী ঘোষণা করতে। সরকার এখনও ঘোষণা দেয়নি।
তবে একই প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে সাবেক সিনিয়র জেলা জজ মঈনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, মহামারী ঘোষণার কোনো প্রয়োজন নেই। আইনে যে বিধি এবং উপদেষ্টা কমিটির কথা বলা হয়েছে এ দু’টি কার্যকর হলেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব। এ বিষয়ে সরকার একটি গেজেট করেছে শুনেছি। তবে যে প্রক্রিয়ায় যে গেজেট হয়েছে সেটি যথার্থ হয়নি। আইনে উপদেষ্টা কমিটির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ কমিটির কার্যক্রম এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।
আইনে নির্দেশিত কমিটিও আমলা ভারাক্রান্ত। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবদের নিয়ে জোড়াতালি দেয়া কমিটি। স্বাস্থ্য বিভাগের লোক নেই কমিটিতে। করোনার বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহা-পরিচালক সংক্রমণ ব্যধি আইনে পরিস্থিতি মোকাবেলার উপযুক্ত কি না সন্দেহ। বিদ্যমান আইনে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, মানুষের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ, সামাজিক দূরত্ব (৩ ফুট) নিশ্চিত করা, একসঙ্গে দু’জনের বেশি না থাকা, এ সময় বাজার ব্যবস্থাপনা কি হবে-ইত্যাদির কোনো নির্দেশনা নেই আইনে।
আইনে বিধিমালার কথা বলা আছে। সেটি এখনও প্রণয়ন করা হয়নি। ফলে বিদ্যমান আইনও কার্যকর করা যাচ্ছে না। সরকারের একেক প্রতিষ্ঠান একেক নির্দেশনা দিচ্ছে। নির্দেশনাগুলো আসছে বিক্ষিপ্ত আকারে। নির্দেশনাগুলো আসতে পারতো বিধিমালার আওতায়। হসপিটালের আয়া-বুয়া-বয়রা পিপিই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাতে সাধারণ রোগের চিকিৎসাও দিচ্ছে না হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালও নিচ্ছে না ভর্তি।
সবখানে কেমন স্বাধীন স্বাধীন ভাব ! হ য ব র ল অবস্থা। যে লোকটা মাস্ক শব্দটিই উচ্চারণ করতে পারে না তাকে পেটানো হচ্ছে মাস্ক না পরার জন্য। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়া মাস্ক প্রয়োজন নেই। সাধারণ রোগ-বালাইয়ের চিকিৎসাও তো দেওয়ানো যাচ্ছে না। বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে চলছে সব। সবাই স্বেচ্ছাচারী। এ জায়গায় মনে হচ্ছে সরকারেরর নিয়ন্ত্রণ নেই। নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা দরকার। সেনা টহলের কাছে ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে বললো এটতো রহিত করা হয়েছে।
বিধি থাকলে চিকিৎসা না দেয়ার মতো বিশৃঙ্খলাগুলো এড়ানো সম্ভব হতো। ‘লক ডাউন’-এর কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। কোয়ারেন্টাইন করলে কীভাবে থাকতে হবে, আইসোলেশন কীভাবে করতে হবে বিধিতে এসব থাকার কথা। মানুষকে শুধু ঘরে থাকার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ঘরে যদি না থাকে তাহলে তার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? নির্দেশ মানতে বাধ্য করার মতো আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নেই। তাহলে একজন মানুষকে আপনি ঘরে আবদ্ধ থাকতে বলবেন কোন আইনে?
একটি আইন দিয়েই তো নিষেধাজ্ঞাটা দিতে হবে। সেই আইনটি কোথায়? না মানলেই বা কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? করোনা আক্রান্ত হলে ‘লালপতাকা’ টানানোর কথাই বা কোথায় আছে? গোরস্থানে করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন করা যাবে না-এই আইন কোথায় আছে? এখানে মানবাধিকার কোথায়?
হ্যাঁ, অবস্থার প্রেক্ষিতে যদি আপনি ধরেই নেন যে, প্রয়োজন আইন জানে না- সে ক্ষেত্রে অধিকার রহিত করারও বিধান সংবিধানে আছে। আইন দিয়েই সেটি খর্ব করা যায়। কিন্তু সেটি আইনে থাকতে হবে। গোরস্থানে লাশ না নেয়ার আইন কোথায় আছে? কবর দিতে না পারলে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটিও থাকা দরকার বিধিতে। মনে হচ্ছে যা কিছু করা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায়। কিন্তু তাতে তো আমাদের স্থানীয় বাস্তবতাগুলো কথা বলা নেই। এটি বিধিতে থাকতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র এই জেলা জজ বলেন, সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির কথা বলা হয়েছে। বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ গোলযোগ। দু’টি কারণের একটিও নেই। তাই জরুরী অবস্থা ঘোষণাও অবান্তর। কোনো প্রেক্ষাপট নেই। আরেকটি আছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। সে অনুযায়ী কারফিউ জারি করা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার এমন কিছু ভাবছে কিনা জানি না।
২০১৮ সালের আইন কতখানি কার্যকর করা যায় সেটি এই আইন অনুযায়ী চললে একটি পরীক্ষা নিরীক্ষা হতে পারতো। বিধির অভাবে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। তবে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সরকার যেকোনো দিন এই বিধিটা করে নিতে পারে। আইনে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সেই উপদেষ্টা কমিটির কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়। মনে হচ্ছে করোনা মোকাবেলায় সব কিছুই চলছে আইনি কাঠামোর বাইরে।



 

Show all comments
  • jack ali ১৩ এপ্রিল, ২০২০, ১০:৪৮ এএম says : 0
    Unfortunately government how to govern a country effectively. Majority of them are ignorant as such they cannot save us from corona virus and also hunger.. This the is very good time for government supporters to steal relief. May Allah curse upon them who are playing game with life and death of our helpless people.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ