মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
আহামেদুল হক এম শাহীন : মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহপাক মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তথা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। জঙ্গলের সুঠামদেহী চারপেয়ে পশু আর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব খ্যাত দুইপেয়ে ক্ষীণকায় মানুষের মধ্যকার পার্থক্য বা মানব শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ হলো জ্ঞান। একমাত্র জ্ঞানই মানুষকে খোদার সমগ্র সৃষ্টি জগতের নি¤œস্তর থেকে ফেরেশতাকুলেরও ঊর্ধ্বে মর্যাদা দান করে। জ্ঞান শব্দের আরবি হচ্ছে ‘এলম’ যা কুরআনের একটি পরিভাষা। ‘এলম’ শব্দটি আরবি ‘আলামত’ শব্দ থেকে নির্গত হয়েছে। ‘আলামত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে প্রত্যেক্ষ দর্শন বা বাস্তবে বোঝা অথবা কোনো নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি ইঙ্গিত বা ইশারা করা। আল্লাহপাক পবিত্র আল কুরাআনে জ্ঞানকে নির্দেশ করে বা জ্ঞান অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে একাধিক আয়াত রচনা করেছেন।
পাক কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত পাঁচটি আয়াতের মধ্য চারটিই জ্ঞান অর্জন বা পড়া নিয়ে। তাতে ইরশাদ হয়েছে, ‘পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি মানুষকে জমাট রক্তপি- থেকে সৃষ্টি করেছেন। পাঠ করো আর মহিমান্বিত। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না।’ (সূরা আল আলাক, আয়াত ১-৫)। পবিত্র কুরআনের আলোকে আমাদের মহানবী (স.) জ্ঞান অর্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রধান করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক ঈমানদার নর-নারীর জন্য ফরজ বা অবশ্যই কর্তব্য’। আর এই জ্ঞান অর্জনের প্রধান বাহন হলো বই।
মানবসভ্যতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম বই। যুগে যুগে অনুসন্ধিৎসু মানবগোষ্ঠী তার যাত্রাপথে যে বিচিত্র জ্ঞান আহরণ করেছে তারই লিখিত রূপ বই। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, জ্ঞানকে আয়ত্ব করা বা জ্ঞানপিপাসাকে উসকে দেবার যন্ত্রই বই। মানবজাতির অনেক আনন্দ মাধ্যমগুলোর মধ্যে বই শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মানবজাতির সফলতা-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, জীর্ণতা-শীর্ণতার সম্মিলিত প্রকাশের নামই বই। বই নিরাশার আশার আলো, পথভোলার পথ-প্রদর্শক। বই মানবমনে সৃষ্টি করে নীতি, সহানুভূতি, স্নেহ, মায়া-মমতা, ভক্তি, প্রেম, বীরত্ব, সুন্দরের সাধনা, ত্যাগের দীক্ষা, মুক্তচিন্তার অবাধ স্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে বই চির আনন্দের উৎস, চির সজিব। প্রাত্যহিক কর্ম-ক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা, হানাহানি ও কর্মক্লিষ্ট জীবনের কর্কশতার চোরাবালি থেকে মুক্ত হতে বইয়ের বিকল্প আর কিছু হতে পারে না।
তাইতো কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম তার দুঃখ কষ্টময় বাস্তব সংসারে অবিরাম আনন্দের রোমান্টিক পরিবেশ কল্পনা করতেন। কবির সেই কাল্পনিক জগতে স্থান পেয়েছিল প্রেয়সী, রুটি, মদ, নির্জন বনভূমি ও একটি মহৎ গ্রন্থ। বলাবাহুল্য, কবির উল্লেখিত জিনিসগুলোর মধ্যে কেবল গ্রন্থটিই চিরনবীন, চিরঅমর আনন্দ সাথী হিসেবে টিকেছিল। সে জন্যই কবির বাণীটি আজও চির অম্লান- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়’। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আশা-আকাক্সক্ষা এবং অন্তরের সত্য ও স্বপ্নÑসব কিছুর সমন্বয়েই বিভিন্ন সাহিত্যের জন্ম। সাহিত্য চর্চা ব্যতীত কোন খোদাভীরু ধর্মপ্রাণ জাতির সুস্থ মানসিকতা গড়ে উঠতে পারে না। আর বইয়ের মাধ্যমেই মানুষ এই সাহিত্যর সাথে পরিচিত হতে পারে। বই ছাড়া স্বর্গীয় আনন্দ অচিন্ত্যনীয়। বই মানুষকে নরকের প্রজ্বলিত আগুনের মাঝেও ফুলের হাসি ফোটানোর দুঃসাহস দান করে।
বিখ্যাত সাহিত্যিক মাক্সিম গোর্কির মতে, ‘আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী’। আনাতোল ফ্রাঁস এ মত ব্যক্ত করেছেন, ‘নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ব করতে থাকি, ততই এক একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে’। রুচিশীল সাহিত্যের বিস্তৃত পরিসরে বিচরণের মাধ্যমেই ব্যক্তি জীবনে মানুষ হয়ে উঠে জ্ঞান পিপাসু। যার ফলে ব্যক্তির প্রাত্যহিক আচরণে প্রকাশ পায় উত্তম গুণাবলী ও অর্জিত হয় সামাজিক মূল্যবোধ। এমন মহৎ ব্যক্তিরা তাদের উন্নত চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণা এবং মেধা মননশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ সাধন করেন। যেমনটি করেছিলেন- নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভুতিভূষণ, আলাওল, শেক্সপিয়র, গ্যাটে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, সক্রেটিস, টলষ্টয়, ম্যাক্সিম গোর্কি কিংবা আলগাজ্জালী, আল ফারাবী, জালালউদ্দিন রুমি, ইবনে সিনা, ইবনে খলদুন, ইবনে রুশদ, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম ও সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারীর মত প্রমুখ ব্যক্তিগণ।
যারা স্বাভাবিক জ্ঞানকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করে প্রতিটি বিষয়ের তাৎপর্য বোঝার, সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতির চিন্তা এবং কাজে অটল থাকেন তারা কখনো অজ্ঞতার অন্ধকারে পরাজিত হন না। কাজেই এই স্বাভাবিক জ্ঞান বা সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করার প্রধান হাতিয়ার বই। এক সময় গ্রামাঞ্চলের মানুষের চিত্ত বিনোদনের প্রধান অবলম্বন ছিল বই। জোছনা রাতে বাড়ির আঙিনায় পুঁথি পাঠের আসর বসত; আসরে আবালবৃদ্ধবনিতা পুঁথিপাঠক মধ্যমণিকে ঘিরে পুঁথিপাঠ উপভোগে বিমোহিত হতেন। গ্রাম মহল্লায় এক সময় ছিলো গ্রামীণ পাঠাগার, পাঠ অভ্যাসীরা তা থেকে বই সংগ্রহ করে বইয়ের রস আস্বাদন করতেন। সে চিত্র বর্তমানে মেলা ভার। আজকাল আমাদের তরুণ সমাজ যান্ত্রিকতায় বিমোহিত।
আধুনিক সভ্যতার বাহন প্রযুক্তি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক আচার-আচরণ, চিন্তাচেতনা, রীতিনীতি, কুসংস্কার দূরীভূত করেছে। নিঃসন্দেহে এটা বাস্তববাদিতার জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু সময়ের দ্রুত পরিবর্তন-বিবর্তনের দ্বারা যান্ত্রিক সভ্যতার কবলে মানুষ বরণ করছে দিন দিন যান্ত্রিক দাসত্ব। মানুষের মন মেজজাও হয়ে উঠছে যান্ত্রিক। যার ফলে আমাদের দেশের বৃহৎ একটি অংশ তরুণ প্রজন্ম বইবিমুখ হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীরা গাইড বা নোট নির্ভরশীল। শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও উপনিবেশিক কাঠামোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্বাধীন দেশে বহাল থাকায় উচ্চ শিক্ষারও একই হালচাল। ছাত্র সমাজ হয়ে উঠছে সার্টিফিকেট সর্বস্ব বিদ্যায় বিশ্বাসী। মুক্ত আকাশে বেশে আসা মুক্ত সংস্কৃতির বেহায়াপনা বিনোদন অনুষ্ঠান তরুণদের পড়ার সময় হরণ করছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে ফেসবুক সংস্কৃতি তথা ভার্চুয়াল জগতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম অতি আসক্ত। তবে একথা বলছি না যে, বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপন্থী নয়, বরং সহায়ক। তবু এসব উপাদানকে বইয়ের বিকল্প ভাবা ঠিক নয়।
গ্রন্থপাঠে মানুষ যে সুন্দর ও পরিশীলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে এরূপ দর্শন ওইসব উপাদানে অনুপস্থিত। সঠিক জীবন-দর্শন ও অন্তর্লোক বিকাশের বইয়ের বিকল্প অন্বেষণ নিষ্ফল। নির্জীব জাতির মনে সজীবতা দান করতে হলে প্রয়োজন আধ্যাত্মিক চেতনার আলোকে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। যে ব্যক্তি নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে পেরেছে সে সক্ষম হয়েছে মুক্ত খোদা মিলন পথ আবিষ্কার করতে। মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ ও মানব সমাজকে চলমান অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে প্রয়োজন দলবাজির রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার ঊর্ধ্বে উঠে জাতি ধর্ম-বর্ণ দলমত নির্বিশেষ সর্ব শ্রেণী-পেশার মানুষকে রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার সর্বস্তরে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দান করে অন্তঃকরণের উৎকর্ষতা চর্চাজনিত একই নৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের গ্রন্থপাঠে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। অভিজ্ঞতাহীন অপূর্ণতা নিয়ে পৃথিবীতে মানুষের আগমন। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ মহৎ জাতি অতিক্রম করতে পারে ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, হয়ে উঠতে পারে মানবিক গুণসম্পন্ন। এই মানবিক গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য ও সভ্য সমাজ বিনির্মাণে বই পড়া আন্দোলন গড়ে তুলুন।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।