বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ
দেশের ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের কিছু নেতা-নেত্রী এবং নিজেদের জ্ঞানীগুণী ভাবেন এমন কিছু মানুষের অতিকথন দেশটাকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী প্রতিহিংসামূলক এসব শব্দ চয়ন এত বেশি উচ্চারিত হচ্ছে যার ফলে দেশ আজ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। দেশের গুণী ও বিশিষ্টজনরা এ কারণে বলছেন, বাংলাদেশের গোটা রাজনৈতিক পরিবেশই জঙ্গিবাদী অপতৎপরতা বৃদ্ধির সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ জন্য দেশের মানুষ অবশ্যই রাজনৈতিক দল ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের দায়ী করবে। অতীতেও বিয়োগাত্মক ঘটনার জন্য মানুষ তাদেরকে দায়ী করেছিল। এটা একটা শিক্ষণীয় বিষয়ও বটে।
শুক্রবার ১ জুলাই রাত পৌনে ৯টায় রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি নামক একটি রেস্টুরেন্টে যে ঘটনা ঘটে গেল বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে এরকম রোমহর্ষক ঘটনা আর ঘটেনি। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের (২৫-২৬) পিলখানা বিডিআর হত্যাকা-ে ৫৭ জন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারসহ ৭০ জন নিহত হয়। এর পরের ১ জুলাই ২০১৬ রমজান মাসে (জুমাতুলবিদায়) গুলশান-২ এর হত্যাকা-ের ঘটনায় নিহত হয় ২৮ জন এবং আহত হয় ৫০ এর অধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। ইতিহাসের পাতায় আওয়ামী লীগের শাসনামলে পর পর দুই টার্মে ক্ষমতায় আসার পর ঘটে যাওয়া এরকম দুঃসাহসিক নির্মম ও বর্বর হত্যাকা- অতীতে কোনো শাসক গোষ্ঠীর আমলে ঘটেনি। নিহত ও আহতের সংখ্যা এত বেশি সংখ্যক কখনো ছিল না। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার এই দুটো ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা সুশিক্ষিত, স্মার্ট ও বুনিয়াদি পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিল বলে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক একাধিক মিডিয়ায় ছবিসহ প্রকাশিত হয়েছে। তাদের জীবনবৃত্তান্তও আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে ১ জুলাই ২০১৬ গুলশানে হত্যাকা-ের সাথে সরাসরি যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, এসব ঘটনার নেপথ্য কারণ কী? তাছাড়া বর্তমান সরকার ৫ জানুয়ারির ২০১৪ নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন দল, মত ও ধর্মের মানুষদের ওপর দমন-পীড়ন বেড়ে যাওয়ার তথ্যানুসন্ধান খুঁজে দেখলে যে সত্য কথাটি বেরিয়ে আসবে সেটা হলো দোষারোপের রাজনীতি দেশকে সহিংসতার পথে ধাবিত করছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হলোÑ পৃথিবীতে যেসব দেশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি সেসব দেশে জঙ্গি তৎপরতা জ্যামেতিক পারে বেড়ে যাচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সুবিধাভোগীরা সন্ত্রাসকে উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এটাই হলো সন্ত্রাস ও জঙ্গিপনা বৃদ্ধির বাস্তবতা, যা আমাদেরকে স্বীকার করতেই হবে। গোটা বিশ্বে বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা এতই জোরদার যে, কোনো রাষ্ট্রই তাদের লেটেস্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করেও তা নিরসনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিজ্ঞ আইজীবী ড. কামাল হোসেন যথার্থই বলেছেন, ‘আইনের শাসনের অভাবেই দেশে জঙ্গিবাদের তৎপরতা বাড়ছে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৪ জুলাই ’১৬)। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ‘গুলশান হামলায় প্রশিক্ষিত শিবির কর্মী জড়িত’ (৩ জুলাই ’১৬)। ওই বক্তব্যের ওপর একজন পাঠিকা প্রথম আলোর অনলাইনে মন্তব্যে বলেছেনÑ যারা গুলশানে হামলা করেছে তাদের পরিচয় বের হওয়া শুরু হয়েছে। সেই হামলাকারীদের একজন হলো রোহান ইমতিয়াজ, তার বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক এবং এই বাবুল গত বছর (২০১৫) অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। হামলা করল আওয়ামী লীগের নেতার ছেলে আর দোষ হলো নন্দ ঘোষের। এই হলো আপনাদের মানসিকতা। এ মানসিকতা নিয়ে আপনারা জঙ্গিবাদ দমন করছেন না, লালন ও উৎপাদন করে চলেছেন? অতিকথনের এক দোষারোপের রাজনীতি চর্চার জবাব পাঠক-পাঠিকারা এভাবেই প্রতিনিয়ত দিচ্ছে।
সম্প্রতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি মন্তব্য যা পাঠকদের ওপরে বর্ণিত অনলাইন মন্তব্যের সাথে মিলে যায়। মন্ত্রীর মন্তব্য যা সবকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়েছিলÑকথা কম কাজ বেশিÑ অতিকথন। বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর গুলশান-২ এ সেটাই মনে হয় প্রমাণ হলো। সেতুমন্ত্রী অনেক সময় উচিত কথা বলে ফেলেন যেটা দলের অনেকের কাছেই ভালো লাগে না। তদ্রƒপ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাহেব তথ্যমন্ত্রীর দল জাসদ সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট কথা বলেছেন, যা নিজ নিজ দলের মধ্যে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। এই যে বাক্যবোমা দেশে সুস্থ রাজনীতিকে কলুষিত করে সেটা রাজনীতিকরা এখন স্বীকার করেছেন। এক মন্ত্রী বলেছেন, অর্থনীতির দুর্নীতি বাংলাদেশকে আগাতে দেয়নি। এটাও সত্য কথা। এ ধরনের আত্মসমালোচনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়, অন্যদিকে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য অর্থাৎ মিথ্যা বচন দেশকে পিছিয়ে দেয়। দেশ-বিদেশের যে কোনো সন্ত্রাসী হামলা সব মানবিক লোকের বিবেককে নাড়া না দিয়ে পারবে না। বিনা বিচারে মানুষ হত্যা মহাপাপ, পবিত্র কোরআনে এ কথা আল্লাহপাক বার বার বলেছেন।
আমাদের দেশের মানুষ হত্যা সেটা বন্দুকযুদ্ধে হোক, ক্রসফায়ারে হোক, জেলহেফাজতে হোক এটা কখনো সরকারি দলে যারা থাকেন তারা অপরাধ হিসেবে গণ্য করেন না। কিন্তু পবিত্র কোরআনে একাধিকবার আল্লাহ বলেছেন, এ কথা সাংবিধানিক এবং বিচারিক আইনেও বলা আছেÑএকজন অপরাধীর বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। সম্প্রতি ইউপি নির্বাচনে ১৫০ জীবন ঝরে গেল। এখন প্রশ্ন জঙ্গিরা যদি হত্যা করে সেটাও অন্যায় এবং এই অন্যায় কাজটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অথচ বিরোধী মত ও দলকে শায়েস্তা করার জন্য সম্প্রতি প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে কারাবন্দি করা হয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ১৯৪ জন সন্দেহভাজন ছিল। তাহলে অবশিষ্ট মানুষকে কোন আইনে গ্রেফতার করা হলো। বিরোধী মতকে দমন করলে জঙ্গিবাদীরা সুযোগ পায় সন্ত্রাসী কর্মকা- করে মানুষ খুন করতে। এটা যারা রাষ্ট্র চালায় তাদের মস্তিষ্কে কেন কাজ করছে না এটা ভাবনার বিষয়।
রাষ্ট্রে যখন সহিংসতা বেড়ে যায় তখন সর্বদলীয় কনফারেন্স ডাকা হয়। রাষ্ট্রের সব দলের রাজনীতিকের ওই আলোচনায় অংশগ্রহণ করা নৈতিক দায়িত্ব। দেশ স্বাধীনের আগে (১৯৭১) ভারত-পাকিস্তানে আমরা এ দৃশ্য বহুবার অবলোকন করেছি। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেনাশাসক আইয়ুব খানের সর্বদলীয় বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছিলেন। ১৯৭১ মার্চে ঠিক স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১৫ দিন ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা অব্যাহত রেখেছিলেন। সে সময় গণমাধ্যমের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা ছিল এসব রাজনৈতিক ইতিবাচক চিন্তা তাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। মূল্যবোধের অভাবে বেশির ভাগ মিডিয়া দলীয় মতাদর্শে নির্ভর হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রের চিন্তা তাদের মস্তিষ্কে কাজ করছে না। এ ছাড়া ভয়ভীতির কারণে ও রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপ থাকার কারণে অনেক সময় সত্য কথাগুলো অকপটে বলতে সাহস পাচ্ছে না। গণমাধ্যম কর্মী সাগর-রুনী দম্পতির ক্ষেত্রে বিষয়টি আমরা লক্ষ করেছি। নৃশংসভাবে তাদের নিজ বাসভবনে ঘাতকরা খুন করেছিল। দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিচার এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তারপরও বলব, দেশ মাতৃকার বৃহত্তর স্বার্থে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত¯œাত এই মাতৃভূমির রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গণমাধ্যম দেশ ও জাতির স্বচ্ছ দর্পণস্বরূপ। তাদের জাতীয় ঐক্যের কথা একই প্লাটফর্ম থেকে জোরালো কণ্ঠে বলতে হবে। এই মুহূর্তে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে জাতীয় ঐক্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই ঐক্য দেখেছি অতীতে এবং বর্তমানেও। তাদের এই ঐক্যের কারণেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ ভূখ-ে একটু ফাটল ধরেনি। একটি উদাহরণ তুলে ধরছিÑ ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে পূর্ব পাঞ্জাবে শিখ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানে স্বর্ণমন্দির ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। বহু শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ হতাহত হয়েছিল। এর কিছু দিন পর শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন। এর পরের আরেকটি ঘটনা যেটা কাস্মীরে হযরত বাল মসজিদে আশ্রিত স্বাধীনতাকামী মানুষগুলোর ওপর কামান ও মেশিনগানের গুলির মাধ্যমে মসজিদে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল। এ দুই ক্ষেত্রে সরকারি দল কংগ্রেস এবং সব বিরোধী দল ডান, বাম ও মধ্যপন্থি লোকসভায় একত্রিত হয়ে সেনা মোতায়েনের ঐকমত্য প্রকাশ করেছিল। কিন্তু আমাদের দেশে যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের একক চিন্তায় দেশ পরিচালনা করছে। এতে জাতীয় রাজনীতিতে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ অন্ধকার পথে হাঁটছে। ৪ জুলাই ২০১৬ পত্রিকায় দেখলাম শাসক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল হানিফ বলেছেন, খালেদা জিয়া ৩ জুলাই রোববার প্রেস কনফারেন্সে জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে সর্বদলীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছেন তা প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগ। তার জবাব ছিলÑ জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকের সাথে কোনো আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। এই নেতিবাচক আচরণই আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যা। যারাই ক্ষমতায় থাকেন আমাদের দেশে, বৃহত্তম বিরোধী দলকে এবং তাদের মতামতকে শুধু অবজ্ঞাই করা হয় না, উল্টো দেখা যায় গ্রেফতারি পরোয়ানা, জেল, জুলুম, রিমান্ড এসবই যেন চলমান ঘটনা। আমাদের দেশের যুবকরা রাষ্ট্রের এসব কর্মকা- দেখে ভীতিপ্রদ হয়ে ভিন্ন পথের অনুসন্ধানে পা বাড়ায়। মানুষের মতামতকে অগ্রাহ্য করলে, মূল্যহীন ভাবলে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ রহিত হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যাবে।
দেশে এখন ভয়াবহ সংকট চলছে গণতন্ত্রের। এই গণতন্ত্র শুধু বিরোধী দলের একক সম্পত্তি নয়। এটা গণমানুষের সম্পত্তি। জনগণতন্ত্র হলো মানুষ কথা বলতে চায়। নিজের মতামত তুলে ধরতে চায়। এখানে কেন বাধা আসবে? বাধা এলেই সন্ত্রাসবাদীদের পথই সুগম হবে। এতে সরকারি দল বিরোধী দল কেউই লাভবান হবে না। বরং মাঝখানে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির ক্ষতি হবে। এ জন্য দায়ী রাষ্ট্রের জনগণ নয়। প্রথমত দায়ী রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা, দ্বিতীয়ত বিরোধী দল ও সুশীল নাগরিক সমাজ, যারা দেশের ক্রান্তিকালে নীরব ভূমিকা পালন করেন। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা মনে করি রাষ্ট্র ভুল করছে না, জনগণও ভুল করছে নাÑ ভুল করছে রাষ্ট্রযন্ত্র। প্রবাদবাক্য বহু পুরান, বর্তমানে এগুলো অচল হয়ে গেছেÑ রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়, অবশেষে দেশে শান্তি চলে যায়। ঈদের দিন বৃহস্পতিবার ৭ জুলাই শোলাকিয়ায় গোলাগুলি ও বোমাবাজির ঘটনা ঘটে। জঙ্গিসহ ৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়, পুলিশও খুন হয়, আহত হয় ১১ জন। এসব বড়ই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনা। মানুষের মুখ থেকে অনেক কথাই শুনিÑ শিবির শিবির করে প্রায় আট বছর দোর্দ- প্রতাপে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার কিন্তু শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে এত ভয় কেন। তারাই যদি জঙ্গির মদদদাতা হয়ে থাকে, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করুন। এতগুলো ব্লগার খুন হলো, পুরোহিত খুন হলো, মসজিদের মুয়াজ্জিন খুন হলো, শিয়া সম্প্রদায়ের লোক খুন হলোÑ কয়জন খুনিকে ধরেছেন, কয়জন জঙ্গির বিচার করেছেন? আসলে কি আপনাদের দেশের জন্য কোনো মায়া আছে? আবার বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। তাহলে ৪৫ বছর ধরে এত রক্ত ঝরছে কেন? মনে হয়, আপনারা চান দেশ গোল্লায় যাকÑআমরা ঠিক থাকলেই হলো। আপনারা চান, সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ এসব চলতে থাকুক। আমরা সেক্যুলার তাই এগুলো দমন করতে আমাদেরই ক্ষমতায় থাকা প্রয়োজন। সারা পৃথিবীকে দেখাতে চান দেশ জঙ্গিতে ভরে গেছে। দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে হলে আমাদেরই ক্ষমতায় থাকা দরকার। প্রশ্নÑ দেশে সিআইডি, র্যাব, পুলিশ, আনসার, স্পেশাল বাহিনী, সাদা পোশাকধারী থাকতে এতসব খুন এবং জঙ্গি বাহিনীর জন্ম কীভাবে হয়। আজ দেশে যা ঘটছে তা প্রশাসনের অদক্ষ পরিচালনা আর অগণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষ মনে করছেÑ শাসক দলই গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ করে দেশে জঙ্গিবাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে আর এই ফাঁকে কোনো এক সময় বহিঃশক্তির পাকিস্তান ও আফগানিস্তান স্টাইলে ড্রোন হামলার শিকার যে আমরা আমজনতা হব না এর নিশ্চয়তা কে দেবে। ইতালির গণমাধ্যমগুলো বলছে, দোষারোপের রাজনীতির ফল গুলশান হামলা। অবশেষে ২৮ জন মানুষের জীবন প্রদ্বীপ নিভে যাওয়া চিরদিনের জন্য। শাসক দল এবং কথিত দেশপ্রেমিক মানুষদের এসব ভাবা দরকার বলে আমরা মনে করি।
৪ জুলাই একটি টিভি চ্যানেলে পুলিশের মহাপরিদর্শক যেভাবে চোখের পানি মুছছিলেন তা তো নিজের সহকর্মীদের মৃত্যুর কারণে। আমরাও এ মৃত্যুতে সমবেদনা প্রকাশ করছি। পাশাপাশি একবার ভাবা দরকার ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুলিশেল গুলিতে কতশত নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। কত হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, কত মা-বাবা তাদের সন্তান হারিয়েছে। কত নারী-পুরুষ তাদের স্বামী ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন। তারাও এদেশের সন্তান। তাদের বাঁচার অধিকার কারা কেড়ে নিয়েছিল। ভাবতে হবে তাদের কথাও। এদেশ কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নয়। ১৬ কোটি মানুষের বাঁচার সমঅধিকারে বাধা দিলে স্বয়ং মজলুম জনতার অভিশাপে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। ইতিহাস থেকে বিগত কোনো শাসক শিক্ষা গ্রহণ করেনি বলেই বিশ্বের চেহারা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এসবই হলো মানব সৃষ্ট কর্মকা-ের ফল।
একজন পাঠক ভয়ানক কষ্টে লিখেছেনÑ পুলিশ বলেছে, এই জঙ্গিদেরই ধরার জন্য তারা দেশব্যাপী ১৩ হাজার মানুষকে আটক করে। কথাটা শতভাগ মিথ্যা। পুলিশ তো এই জঙ্গিদের নাম-পরিচয়ই জানত না। তারা গণমাধ্যমকে বলেছে, নিহত পাঁচ জঙ্গির নাম আকাশ, বিকাশ, রিপন, ডন ও বাঁধন। এর একটা নামও সঠিক নয়। আরেক পাঠক তার বুকের ব্যথা এভাবে প্রকাশ করে লাঘব করতে চেয়েছেনÑ জঙ্গিরা সবাই স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়েছিল, এদের বাবা-মায়ের জন্য কীসের সহমর্মিতা। অথচ এদের বাবা-মায়েরা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য থানায় জিডি করেছিলেন। কিন্তু শাসক দলের লেজুড় পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নিলে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। আরেকজন পাঠক আহত বিবেক নিয়ে ৪ জুলাই ২০১৬ তার বক্তব্য এভাবে তুলে ধরেছেনÑ বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেনÑ সরকার জাতীয় এক্য গড়তে মোটেও আগ্রহী নয়। কারণ তারা সব ব্যাপারেই শর্ত আরোপ করে। এ ব্যাপারে উক্ত পাঠকের মন্তব্য সরকারের ঐক্য পুলিশ প্রশাসন, সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ ব্যাংক লুটেরা আর শেয়ারবাজার লুটেরাদের সঙ্গে, এরা জাতির সঙ্গে ঐক্য করতে যাবে কেন। আমি প্রায় সময়ই সুপ্রিয় পাঠকদের মতামতকে গুরুত্ব দিই এ কারণে যে, তাদের সুচিন্তিত মতামত থেকে জাতির অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে। কারণ দেশের মানুষই তো বাংলাদেশের নির্মাতা ও শেকড়।
জনগণের আরো প্রশ্নÑ ৫ জঙ্গিকে জীবিত ধরতে পারলে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা যেত। বড় মাপের জঙ্গি পাকড়াও করাও সম্ভব হতো। জঙ্গিদের বিচারিক আদালতে পাঠিয়ে সবকিছুই আইনি ধারায় সুসম্পন্ন করা যেত। জনগণ ’৭১ সালে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শত্রুমুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে কীভাবে দেশকে স্বাধীন করতে হয়। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এই জনগণই সেনাশাসক এরশাদকে মাত্র ছয় দিনে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। জনগণই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। তারাই পারবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে, পারবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে। জয় হোক জনতার ঐক্যেরÑ এই আশাবাদ ব্যক্ত করি এবং প্রার্থনা করি মহান ¯্রষ্টার দরবারে জনতার বৃহৎ ঐক্যের প্রত্যাশায়।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক এবং কলামিস্ট
যধৎঁহৎধংযরফধৎ@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।