বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
ইংরেজি militant Ges militancy শব্দের অর্থ হচ্ছে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ। উপমহাদেশে ব্রিটিশদের শাসন চলাকালে কিংবা তার পরবর্তী সময়েও এই শব্দ দুটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতো না। তৎকালীন সময়ে শাব্দিক বা রূপকভাবে যোদ্ধা, সৈনিক, যুদ্ধে ব্যবহৃত বস্তু বুঝাতে ইংরেজি এ শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হতো। সে কারণে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কমান্ডার ইন চিফকে ‘জঙ্গিলাট’ বলা হতো। কিন্তু আমরা বর্তমানে ‘জঙ্গি’ বলতে বুঝি বে-আইনী সহিংসতা ও খুনখারাপির সাথে জড়িত ব্যক্তিকে। এ অর্থে প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত পরিভাষা সন্ত্রাস (terrorism), যারা সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা সর্বহারার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাপিতে লিপ্ত তাদেরকে আমরা ‘চরমপন্থী’ বলি। আর যারা ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাপিতে লিপ্ত তাদেরকে বলা হয় ‘জঙ্গি’। তবে জঙ্গিবাদ শব্দটি কোনো রূপ ভাষাগত ভিত্তি ছাড়াই ‘ইসলামের নামে সংিসতা’ অর্থে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ মূল ভাষাগত অর্থে ইসলামের নামে, অন্য কোনো ধর্মের নামে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে, অন্য যে কোনো মতবাদ, আদর্শ বা অধিকারের নামে উগ্রতার আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষকে জঙ্গি বলা চলে এবং তাদের মতবাদকে জঙ্গিবাদও বলা চলে। (ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ; ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর)। আর সন্ত্রাসের মূল কথা-মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে, জানমালের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোনো কিছু করতে বাধ্য করা। এটা রাজনৈতিক রূপ নিলে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠের মতকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দেয়া।’
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই। অনৈতিক, অকল্যাণ, অনিয়ম, ন্যায়ের পরিপন্থী, ক্ষতিকর, অগ্রহণীয় ও অগ্রহণযোগ্য কোনো কাজই ইসলাম সমর্থন কিংবা অনুমোদন করে না। বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ইসলামকে সন্ত্রাসের জনক বলে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অথচ ইতিহাস ও বাস্তবতা হচ্ছে এর বিপরীত। সন্ত্রাস অর্থে যা বুঝানো হয় তার শুরু হয় ইহুদি উগ্রবাদীদের দ্বারা। প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদি উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ‘ধর্মীয় আদর্শ’ ও ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। ইহুদিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ‘জায়নবাদ’ মতবাদ প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতায় একশ্রেণির মুসলমান নামধারী বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ইসলামী আন্দোলনের মূল ধারাকে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। অথচ সন্ত্রাসের সংজ্ঞা, যুগে যুগে সন্ত্রাসের খ- চিত্র এবং সন্ত্রাসবাদের আধুনিক রূপÑএর কোনটার সাথেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রমের কোনো যোগসূত্র থাকার প্রশ্নই উঠে না। ইসলামের ইতিহাসে আমরা যুদ্ধ দেখতে পেলেও সন্ত্রাসের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের মাধ্যমে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল ইসলাম সমর্থন করে না। সম্প্রতি কিছু নামধারী মুসলিম বিভিন্ন দেশে অযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে বা সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে-এটি ন্যাক্কারজনক। গোটা পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে সন্ত্রাসী ঘটনা সংগঠিত হলেও ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মকে দায়ী করা হয় না। ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস বা হত্যার বিষয়ে যা কিছু বলা হয় তার অধিকাংশই উদ্দেশ্যমূলক ও অনুমান নির্ভর অপপ্রচার, যা ভিত্তিহীন।
কোনো মানুষ যদি সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদী কাজ করে তাহলে সেটা তার ব্যক্তি অপরাধ বলেই গণ্য হবে। অপরাধী যেই হোক না কেন বা যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন তার অপরাধের কারণে দল, প্রতিষ্ঠান বা ধর্মকে দোষারোপ করা যাবে না। কেউ যদি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে তাকে জোর করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না। ইসলাম গ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর স্বয়ং আল্লাহই ছেড়ে দিয়েছেন এবং বল প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যার মন চায় সে ঈমান আনবে, আর যার মন চায় সে কুফরী করবে” (সূরা আল কাহাফ : ২৯)। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে, “দ্বীন গ্রহণে কাউকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্য করা যাবে না। সত্য পথ গোমরাহী বা ভুল পথ থেকে সুস্পষ্টভাবেই পৃথক হয়ে পড়ছে” (সূরা আল বাকারা : ২৫৬)।
সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যারা হামলা করেছিল তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে। কিন্তুু কেউ তো সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধের জন্য আওয়াজ তুললো না। অথচ গুলশানের ওই হামলাকারীরা যদি কোনো মাদরাসার ছাত্র হতো বা কোনো মূলধারার ইসলামী দলের কর্মী হতো তাহলে সেই মাদরাসা কিংবা সেই দলকে শাস্তির আওতায় আনতে এক শ্রেণির মানুষ রাজধানীতে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করতো। আর কতিপয় মিডিয়া সাত বা নয় জনের সেই বিশাল মিছিলকে ইস্যু করে টকশোর আয়োজন করতো সে কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। একই সাথে এটিও বলবো, কোনো শিক্ষার্থী বা কোনো মানুষ বিপদগামী হলে সে জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা দলকে ততক্ষণ পর্যন্ত দায়ী করা উচিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের সহযোগিতা বা জড়িত থাকার সত্যতা না মিলবে। কেউ একজন দাবি করলো আমি অমুক ব্যক্তির অনুসারী আর এই কথা আমলে নিয়ে তার কর্মকা-কে অবৈধ ঘোষণা করা মোটেই সমীচীন নয়। যেমনটি ঘটেছে ডা. জাকির আবদুল করীম নায়েকের বেলায়। তাঁর ফেসবুক ভেরিফাইড পেইজের তথ্যানুযায়ী গোটা পৃথিবীতে তাঁর ভক্ত বা অনুসারীর সংখ্যা ১ কোটি ৪৩ লক্ষ ১১হাজার ৭৭১ (১৩ জুলাই ’১৬)। তাকে ফলো করলেই যদি জঙ্গি হয় তাহলে বিশাল সংখ্যক এই অনুসরণকারীদের সবাইকেই কি জঙ্গী বলা হবে? গুলশানের হত্যাকা-ের ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৭৪ ধরনের আলামত জব্দ করলেও পিস টিভিকে বন্ধ করার মতো আলামত ছিলো বলে এখনো জানা যায়নি।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী (জানুয়ারি ’১৬) বাংলাদেশ বর্তমান জনসংখ্যার ৮৬.৬% মুসলিম। ইসলাম কখনো জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না বরং এটি হারাম। তাই এদেশের মানুষ সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদকে পছন্দ করেন না। জঙ্গিদের কর্মকা-কে তারা গ্রহণ করেন না। গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, উগ্রবাদী ও জঙ্গিরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করে। সাধারণ মানুষের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা খুব কম বলেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের দিন পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় নিহত জঙ্গি আবির রহমানের জানাযায় কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক মাওলানা মাহতাব উদ্দিন ব্যতীত আর কাউকে দেখা যায়নি। এ থেকেই বুঝা যায় এ দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা-কে গ্রহণ করেন না। অথচ এক শ্রেণির মানুষ এসব জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক বা সহয়তাকারী হিসেবে কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তির ওপর অপবাদ আরোপ করে থাকেন। তাদের বোধগম্য হওয়া উচিত যাদের জানাযায় লক্ষ লক্ষ লোক হাজির হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাদের গায়েবানা জানাযা হয় তারা কখনই জঙ্গিবাদ তো দূরের কথা জঙ্গি মনোভাবও তারা পোষণ করেননি। সুতরাং বোদ্ধা মহলকে বলবো, সুস্থ বিবেক কাজে লাগিয়ে মন্তব্য করুন। আর সেটাই হবে সকলের জন্য কল্যাণকর।
সমাজে শান্তি, কল্যাণ ও ন্যায়-ইনসাফ এবং মানুষের জানমাল ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের দিক নির্দেশনা রয়েছে। কেউ যদি ইসলামের বিধি-বিধান উপেক্ষা করে তাদের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেয় সেটা হবে মহা অন্যায়। অপরাধী তার স্বার্থ হাসিল করার জন্য মুখে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান তুললেও অপরাধ কখনোই ক্ষমা পাবে না এবং সেই কর্মটিও বৈধ হবে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন কোনো হামলা হয় তখন একশ্রেণির লোকদের বলতে শোনা যায়, হামলা কারীর মাথায় টুপি ছিল, গায়ে লম্বা জামা ছিল, মুখে দাড়ি ছিল, মাদরাসার ছাত্র ইত্যাদি। তাদের উদ্দেশে বলছি, ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতে লিপ্ত বিভিন্ন দল নিরস্ত্র অযোদ্ধা মানুষদের হত্যা করলে তাকে সকলেই সন্ত্রাস বলে গণ্য করেন। কিন্তু মার্কিন বাহিনী ফালুজা এবং অন্যান্য স্থানে অযোদ্ধা মানুষদের হত্যা করলে তাকে কখনোই সন্ত্রাস বলে স্বীকার করা হয় না। তেমনিভাবে দেশ পরিচালনায় ক্ষমতার বাইরের যে কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে তাকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলা হবে আর একই ধরনের অপরাধ ক্ষমতাসীনরা করলে তাদের বেলায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অপরাধীকে প্রশ্রয় দিলে কখনোই সন্ত্রাসী কর্মকা- বন্ধ করা যাবে না। সন্ত্রাসী কর্মকা- যেই করুক না কেন তাকে যথাযথভাবে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। একই সাথে বলতে চাই, ইসলামি স্কলারদের মতে জঙ্গিবাদের কারণগুলোর মধ্যে ১. সা¤্রাজীবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র; ২. মুসলিম দেশে ইসলাম দমন; ৩. বেকারত্ব ও হতাশা এবং ৪. ইসলামের শিক্ষার বিকৃতি উল্লেখযোগ্য। এগুলোকে আমলে নিয়ে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।