Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

খোঁয়াড়ে ফেরানোর উপায়!

হোম কোয়ারেন্টাইন ফাঁকি দিয়ে ঘুরছেন বেশিরভাগ বিদেশফেরত করোনা সংক্রমণে বাড়ছে ঝুঁকি : উদ্বেগ-শঙ্কায় সুরাহা চান চট্টগ্রামবাসী

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২০, ১২:১০ এএম

বিদেশফেরত। করোনাভাইরাস মহামারী সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে বেশিরভাগ প্রবাসীই আসেন চলতি মার্চ মাসের প্রথম থেকে। অনেকে আসেন আগের মাসেও। বৈশি^ক সংক্রমণকালে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসা বিদেশফেরত প্রবাসীর সংখ্যা হাজার হাজার। অথচ ঝুঁকিমুক্ত থাকা নিশ্চিত করতে নিয়ম মেনে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন অধিকাংশই। তারা উধাও। যত্রতত্র যথেচ্ছ ঘুরছেন। আর তাতে করোনা সংক্রমণের বাড়ছে ঝুঁকি। এ নিয়ে চরম উদ্বেগ-শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রামবাসী।

গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব মতে, চট্টগ্রাম জেলায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৯৭৩ জন। পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো মিলেই আছেন মাত্র ১৩শ’ ৯২ জন। বাস্তবে এই সংখ্যা লাখের কম-বেশি হওয়ারই কথা। চট্টগ্রাম ও ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দুটি ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে তারা এসেছিলেন। ওদিকে চট্টগ্রামে প্রশাসন বিদেশফেরতদের নিজ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো শুরু করে কেবল গত ৯ মার্চ থেকে। ঢাকার মতো চট্টগ্রামে সরকারি উদ্যোগে নেই কোন হোম কোয়ারেন্টাইন বা সেন্টার।

এ অবস্থায় সহজেই বোঝা যায়, হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন বাস্তবে আসা প্রবাসীর সংখ্যার চেয়ে অনেক কম। আর যারা উধাও তারা সরকারের নির্দেশ লঙ্ঘন করে এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দিব্যি ঘুরছেন-ফিরছেন। গতকাল খোলা থাকার শেষ সময় পর্যন্ত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মার্কেট, বিপণিবিতান, শপিং মল, সুপার শপগুলোতে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। এমনকি সদ্য বিদেশফেরতদের হচ্ছে বিয়ে-শাদি। স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মিশেই চলেছেন, সংস্পর্শে আসছেন। নিজেদের গ্রাম থেকে মহানগরীতে আসা-যাওয়া করছেন। অনায়াসেই।
হোম কোয়ারেন্টাইন অমান্যের ঘটনাগুলো হাতেনাতে প্রমাণ চট্টগ্রাম জেলা-উপজেলা ও পুলিশ প্র্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে রয়েছে ভুরি ভুরি। প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এরমধ্যে অন্তত ৩২ জন ধরা পড়েছে, যারা হোম কোয়ারেন্টাইন ফাঁকি দিয়ে বাইরে যথেচ্ছ অবস্থান কিংবা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বৌভাত অনুষ্ঠান থেকে ধরে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয় সদ্য বিদেশফেরত নতুন বর-কনেকে। ইউএনওরা পর্যন্ত চালাচ্ছেন অভিযান। কিন্তু বেশিরভাগই উধাও।

অন্যদিকে হোম কোয়ারেন্টাইন নির্দেশ এড়ানো বা অমান্যকারী এই বিদেশফেরতদের ‘খোঁয়াড়ে’ কীভাবে ফিরিয়ে নেয়া যায় বা তা এখন আদৌ সম্ভব কিনা তা নিয়ে তাদের নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ ও বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, সিটি মেয়রও। (‘খোঁয়ার’ ফারসি শব্দ। ফল-ফসলে বা বসতবাডির বাগ-বাগিচা বিনষ্টকারী যথেচছ বিচরণশীল বিশৃঙ্খল গবাদিপশু গবাদিপশু আটকে রাখা এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের গারদ হচ্ছে ‘খোঁয়াড়’।) তাছাড়া সুনির্দিষ্ট হোম বা প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ছাড়াই আগত প্রবাসীকে নিজের বাড়িঘরে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলে প্রশাসন শুধুই তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রেখে স্থানীয় থানা পুলিশে তথ্য দিয়ে রাখছে। কিন্তু নিজ বাড়িতে গিয়েও অনেকেই কোয়ারেন্টাইনের ধার ধারছেন না।

এ অবস্থায় সদ্য বিদেশ প্রত্যাগত এবং হোম কোয়ারেন্টাইন ফাঁকিদাতা প্রবাসীদের সম্ভাব্য সংক্রমণের উৎস একটি বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে এমনটি উদ্বেগ ও শঙ্কা স্বাস্থ্য বিভাগ, চিকিৎসক মহল স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে চট্টগ্রামবাসীর মাঝে প্রকট এ মুহূর্তে। এদের খোঁয়ারে ফেরানোর কী উপায় বা আদৌ সম্ভব কিনা এ নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও উদ্বিগ্ন। চরম বিপাকে আছে সমগ্র প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা জানিয়ে বলেন, প্রশাসন এ ব্যাপারে সতর্ক। ওদের খোঁজা হচ্ছে। যারা হোমে আছে তাদের অবস্থান ও স্বাস্থ্যগত দিক মনিটরিং হচ্ছে। একই সঙ্গে ঝুঁকি এড়ানোর স্বার্থে হোম কোয়ারেন্টাইন ফাঁকিদাতাদের সামাজিকভাবে সহযোগিতা নিয়েই খুঁজে দ্রæত বের করতে হবে।

কেউ বলছেন মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার অর্থাৎ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় অবিলম্বে কোয়ারেন্টাইন এড়ানো প্রবাসীদের খুঁজে বের করাই হবে সহজ। তা অবিলম্বে শুরু করা উচিৎ। কেননা এ ধরনের বিদেশফেরতদের ঘিরে সবার মাঝেই উদ্বেগ-শঙ্কার দিকটি হচ্ছে, হোম কোয়ারেন্টাইন এড়িয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ানো এসব কান্ডজ্ঞানহীন প্রবাসী কার মাধ্যমে কোথায় কখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে তা কেউই বলতে পারে না। চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ওদেরকে অবিলম্বে হোম কোয়ারেন্টাইন অর্থাৎ ‘খোঁয়াড়ে’ ফেরানোর উদ্দেশ্যে নিজেই গাড়িতে বসে মাইকিং করলেন গত সোমবার শহরময় চার ঘণ্টা ধরে।

নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণরোধে হোম কোয়ারেন্টাইনের নির্দেশ না মানলে ব্যবস্থা নেব। বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সচেতন করুন। নিজে, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে হোম কোয়ারেন্টাইনে তাদেরকে থাকতে হবে। আর যদি নির্দেশ না মানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে খবর দিন। আমাকে জানান। ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগেও জনসচেতনতামূলক প্রচার ও মাইকিং করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই। তবে হাতছাড়া হওয়ার আগেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা না রেখে এখন মাইকিং ও খোঁজাখুঁজি করে ওইসব প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টাইন অর্থাৎ ‘খোঁয়াড়ে’ ফেরানো সম্ভব কী? অনেকেরই সামনে এই প্রশ্নের সমাধান জরুরি।

অধ্যাপক ড. এম এ ফয়েজ
করোনায় সংক্রমণরোধ ও জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ পরিস্থিতি মোকাবিলা প্রসঙ্গে বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী (মেডিসিন এবং নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সাবেক স্বাস্থ্য মহাপরিচালক) অধ্যাপক ড. এম এ ফয়েজ সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাব প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎকারে জানান, ‘নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বৈশ্বিক মহামারী ব্যাধিটি মারাত্মক ধরনের ছোঁয়াচে। কোভিড-১৯ সংক্রমণরোধে সবচেয়ে গুরত্বের দিকটি হলো, বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকা চাই। হোম কোয়ারেন্টাইন মানে হচ্ছে অন্যের সংস্পর্শ যাতে না ঘটে এরজন্যই সংঙ্ঘনিরোধ ব্যবস্থা। নিজের ঘরেবাড়িতে পৃথক কক্ষে থাকতে হবে। অর্থাৎ নিজেকে আলাদা করে রাখা। অন্তত ১৪ দিন। কঠিন কাজ নয়। এরপর বোঝা যাবে কেউ ঝুঁকিমুক্ত কিনা। বিশেষ করে কোভিড-১৯ সংক্রমিত পৃথিবীর যে কোন দেশ বা অঞ্চল থেকে যারা এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে এসেছেন বা আসছেন তাদের সংঙ্ঘনিরোধ মানে হোম কোয়ারেন্টাইন অবস্থান অতি জরুরি’। চট্টগ্রামের কৃতিসন্তান অধ্যাপক ড. এম এ ফয়েজ তিনি এটাও স্মরণ করিয়ে দেন, বন্দরনগরীসহ চট্টগ্রাম অঞ্চল দেশের অন্যতম প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা। এখানে ঝুঁকির প্রশ্ন জড়িত।

খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরী ছাড়াও জেলায় মীরসরাই, সীতাকুন্ড রাউজান, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী এলাকায় সদ্য বিদেশফেরত অনেক প্রবাসী ইতোমধ্যে উধাও এবং অবাধে ঘুরছেন। বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন হোম কায়ারেন্টাইনের নির্দেশনা পালনে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাহী অফিসারগণ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে গিয়ে তার প্রমাণ পেয়েছেন। জরিমানাও হয়েছে এসব ক্ষেত্রে।

তাছাড়া চট্টগ্রাম নগরীতে ঘুরতে আসছেন এখানে কর্মরত বিদেশি লোকজন এবং বন্দর হয়ে আগত জাহাজের বিদেশি নাবিকগণও। বৈশি^ক এ মহামারীর বিস্তার রোধে সেনাবাহিনী মাঠে আসায় চট্টগ্রামবাসী এর বিষয়ে কঠোর এবং অতিদ্রুত পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে সুরাহার প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছেন।



 

Show all comments
  • Mohammed Kowaj Ali khan ২৫ মার্চ, ২০২০, ৯:১৩ এএম says : 0
    নিয়ম কানুন মেনে আল্লাহ তা'আলার তাসবিহ কালাম পড়তে থাকুন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাহেন। মচিবতের দোয়া পড়তেই থাকেন। মচিবতের দোয়া। ইন্না লিল্লাহি উয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন আল্লহুম্মা ইনদাকা আহ তাছিবু মোচিবাতি ফাজিরনি ফিহা উয়া আবদিল নি মিনহা খাইরা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ