Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

দান-সদকা উত্তম সমাধান

‘করোনার হুজুগে অতিরিক্ত কেনাবেচা শুধুই বাড়াবাড়ি। বসতঘরকে আর গোডাউন বানাবেন না’ : চট্টগ্রামে বিশিষ্টজনদের অভিমত

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাস মহামারীর আতঙ্কের নামে হুড়োহুড়ি করে নিজেদের পরিবারের প্রয়োজেনের তুলনায় অতিরিক্ত দুই-চার, পাঁচগুণ এমনকি দশগুণ পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা-ময়দা ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী কিনে কিনে মজুদ করে রাখার কোনো মানে হয় না। মাঝখানে সুযোগটা নিচ্ছে অসৎ-লোভী একশ্রেণির ব্যবসায়ী এবং মুনাফাখোররা। ভোক্তারা কে কতদিন ধরে খেয়ে শেষ করতে পারবেন এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য? সবকিছ্রুই তো একটা শেষ আছে। এসবেরও অনেকটাই নষ্ট ও অপচয় হয়ে যেতে পারে’।

‘এভাবে হুজুগের বশে খাদ্যসামগ্রী কিনেই যখন ফেলেছেন তারাতো আর দোকান-পাটে গিয়ে গিয়ে বিক্রি অথবা ফেরত দেবেন না। তা সম্ভবও নয়। তবে গরীব-দুঃস্থ প্রতিবেশী, নিকটাত্মীয়, গৃহকর্মী, অভাবী লোকজনদের মাঝে এখন থেকে কিছু কিছু বিলি-বন্টন শুরু করে দিন। আমি মনে করি দান-সদকায় উত্তম সমাধান। তাতে এ দুঃসময়ে সমাজের অসহায়-দুঃখী জনগণেরই উপকার হবে। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও কল্যাণকর কাজের প্রতিদান দেবেন আল্লাহতায়ালা’।

গত শনিবার রাতে একটি টিভি টক শোতে আলোচনায় অংশগ্রহণকারি একজন চিকিৎসক ভদ্রমহিলার ওই কথাগুলো দর্শকদের মনে নাড়া দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তিনি চিকিৎসক হিসেবে তরুণদের উদ্দেশে এটাও বলতে শোনা গেল, করোনাভাইরাস মহামারী সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে নিজেদের প্রবীণ মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানীসহ মুরব্বীস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি যত্মশীল থাকতে হবে। কারণ তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা অবশ্যই বেশি। তিনি নিজেও তার ৮৫ বছরের বয়স্ক শ^শুড়ের দেখভাল করছেন বলে টক-শো অনুষ্ঠানে বিনয়ের সঙ্গেই জানালেন। টক শো-তো উপস্থিত অন্য আলোচকগণ ও সঞ্চালককে তার কথাগুলো সমর্থন করতে দেখা গেল।

সেই রেশ ধরে গতকাল রোববার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের অভিমত জানতে চাইলে তারা বললেন, করোনার ভয়-ভীতি হুজুগে গিয়ে অতিরিক্ত কেনাবেচা হওয়াটা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষের দিক থেকেই বাড়াবাড়ি বৈ কিছুই নয়। তাদের কথা, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, খাদ্যসামগ্রীর কোন ঘাটতি নেই। বরং আমাদের চাহিদামতো প্রচুর পরিমাণে নিত্যপণ্য হাতে আছে। কাজেই অযথা প্যানিক সৃষ্টি করে অতিরিক্ত ক্রয়ের বা মজুদ করার কোন প্রয়োজনই নেই।

বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ কারোনার ভয় তৈরি করে প্রয়োজনের বেশি নিত্যপণ্য, খাদ্যসামগ্রী কেনাবেচা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহবান জানান। তারা বলেন, ‘নিজেদের বিবেক নষ্ট করবেন না। বসতঘরকে আর কোথাও কেউ গোডাউন বানাতে যাবেন না। তাহলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যে হিড়িক পড়েছে তাও থামবে নিশ্চয়ই’। তারা জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মাহে রমজান এবং পবিত্র শবে বরাত সামনে রেখে বাজারদর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাতে চলে না যায় এবং ক্রেতাদের কারণেই তা না ঘটে এটি পবিত্র দায়িত্ব মনে করা উচিৎ। একই সঙ্গে তারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরোধ এবং মজুদদার ও মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে আরও কাঠোর হাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং র‌্যাব-পুলিশের সাহায্যে প্রতিটি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করার তাগিদ দিয়েছেন সরকারের উদ্দেশে।

এ প্রসঙ্গে গতকাল প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আযাদ ইনকিলাবকে বলেন, খাদ্য ও নিত্যপণ্যসামগ্রী আমাদের যা দরকার তা তো দেশেই পর্যাপ্ত পরিমাণে মওজুদ রয়েছে। ঘাটতি বা সঙ্কট তৈরি হলে তা এখনও অনেক দূরে। ইনশাআল্লাহ আমরা হয়তো আগামী ৩ মাসের মধেই কারোনার সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবো। অথচ যারা আতঙ্কিত হয়েই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিনে নিয়ে নিজেরাই সঙ্কট তৈরি করছি। এর সুযোগটি নিচ্ছে লোভী কিছু ব্যবসায়ী। যা চরম অন্যায় ও গর্হিত কাজ। কেননা তাতে শুধুই গরিব মানুষেরা কষ্টভোগ করে। এরজন্য সমাজে অরাজকতা তৈরি হতে পারে। এর বিপরীতে সমাজিক সচেতনতা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, চাহিদার চেয়ে বাড়তি যারা কিনেছেন তারা হতদরিদ্রদের মাঝে দান-সাহায্য করাই এখন কর্তব্য।

চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, অনর্থক বেশি বেশি নিত্যপণ্য ক্রয় যারা করেছেন তারা বর্তমান দুঃসময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠির মাঝে সাহায্য হিসেবে বিতরণ করলে সেটাই হবে সদকায়ে জারিয়া। এটি সর্বোত্তম সওয়াবের কাজ। বিশেষ করে কারোনা পরিস্থিতির মাঝে দেশে আজ অনেক মানুষ চাকরি হারা এবং কর্মহারা হয়েছেন। আরও হতে পারেন। ওদের প্রতি বাড়িয়ে দিন সাহায্য-সদকার উদার হাত। তিনি জানান, গতকাল চেম্বারের পক্ষ থেকে সর্বস্তরের ব্যবসায়ী এবং প্রতিনিধির কাছে নিত্যপণ্য অতিরিক্ত ক্রয়-বিক্রয় কিংবা মজুদ রোধে সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
চমেক হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (নিউরোসার্জন) অধ্যাপক ডা. এস এম নোমান খালেদ চৌধুরী ইনকিলাবকে অভিমত দিয়েছেন, আপদকালীন সময়ে নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য সামগ্রী যারা ক্রয় করেছেন তারা এখন যদি অন্যদের চাহিদার দিকে তাকিয়ে জোগান দেন তাহলে সমাজ উপকৃত হবে। অতিরিক্ত যারা ক্রয় করেছেন তারা নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশী দরিদ্রদের মাঝে কিছু কিছু বিতরণ করতে পারেন। তারাও উপকৃত হবেন। বাজার ব্যবস্থায় একটা সুস্থ ভারসাম্য তৈরি হবে। এটাই এ মুহূর্তে সবার প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজসেবক মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, আসলে বাংলাদেশে বর্তমানে কারোনা ভাইরাস মহামারী পরিস্থিরির ঝুঁকির কারণে বিপর্যয়কর অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ সময়েই যারা প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুল অতিরিক্ত নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে নিয়েছেন তাদের করণীয় হবে এখন থেকে বাড়তি অংশটুকু প্রতিবেশী, গরিব ও অসহায় লোকদের মাঝে উদারহস্তে দান করুন। এরফলে দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। সুষ্ঠু সমাজের জন্য এটাই হবে প্রত্যাশিত এবং কল্যাণকর।

এদিকে প্যানিক তৈরির কারণে বাজারে একটি অস্থিরতার দৃশ্য তুলে ধরেন ষোল শহর ২ নম্বর গেইট বাজারে গত শনিবার কিছু দৈনন্দিন নিত্য ও ভোগ্যপণ্য ক্রয় করতে যাওয়া গৃহবধূ তাহমিনা খাতুন। তিক্ত অভিজ্ঞতাটা তার, একজন বয়োবৃদ্ধ ভদ্রলোক দীর্ঘ একটি কেনাকাটার ফর্দ নিয়ে একের পর এক নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী কিনছেন। দোকান কর্মচারীদের হিমশিম অবস্থা। কেননা তার বায়না যেন ফুরায় না। জিনিসপত্রের পরিমাণও অনেক বেশি। ততক্ষণে বেশকয়েকজন ক্রেতার লাইন পড়ে গেছে। তারা অপেক্ষাই করছেন।
বৃদ্ধ ক্রেতাকে এক পর্যায়ে এটাও বলতে শোনা গেল, ‘ভাই এতসব জিনিসপত্র বিপদের সময়ে দরকার হবে তাই বাধ্য হয়ে কিনছি। পরে যদি লকডাউন, শাট ডাউন এবং সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়! তখন পাবো কোথায় কিভাবে? কিন্তু করোনাভাইরাস যেভাবে হানা দিচ্ছে তাতে এসব খাদ্যপণ্য খাওয়ার জন্য ক’দিন বাঁচবো তাও বেশ চিন্তার কথা’। দেখা গেল বয়স্ক এ ব্যক্তি খেই হারিয়ে পাগলের মতো ছুটে এলেন বাজারে। মহামারীতে আক্রান্ত হলে নিজের সম্ভাব্য মৃত্যুর ভয়-শঙ্কার কথাও কিন্তু মাথায় আছে তার।

অন্যদিকে গত শনিবার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চাক্তাই খাতুনগঞ্জ, কাজীর দেউড়ি বাজার, সিডিএ মার্কেটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম তার বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সাংবাদিকদের জানান, বেশ কয়েকজন ক্রেতার বস্তাভর্তি চাল ক্রয়ের প্রমাণও আমরা পেয়েছি। ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল প্রভৃতি এভাবে অতিরিক্ত কেনা হচ্ছিল। যার সুযোগ নিচ্ছে অসৎ ব্যবসায়ীরাই। তারা সুযোগ বুঝে নিত্যপণ্যের দাম বেশি আদায় করে নিচ্ছেন। আমরা ক্রেতাদের উদ্দেশে বলেছি, চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে প্রচুর খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য মজুদ আছে। খুচরো বাজারে বেশি দামে পণ্য বিক্রি ঠেকাতে অভিযান পরিচালনা করছি। ভোক্তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজেদের বাড়িঘরকে আর কোনভাবেই মিনি সুপারশপ অথবা গুদামে পরিণত করবেন না। যার এখন যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই কিনুন। অহেতুক ধৈর্য্য হারাবেন না।
তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে আরও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনাকারী প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটগণ দেখতে পেয়েছেন, কারোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির মাঝে আতঙ্ক, হুজুগের বশবর্তী হয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই মাত্রাতিরিক্ত হারে নিত্যপণ্য ক্রয় ও বিক্রয়ে নিছক বাড়াবাড়িই করছেন। এতে করে বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটা হিড়িক তৈরি হয়েছে। যার সুযোগ নিচ্ছে বাড়তি দাম হাকিয়ে কিংবা কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে অসৎ শ্রেণির গুটিকয়েক ব্যবসায়ী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ