দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
সমাজে সৃষ্ট অরাজকতা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। যথা-১. সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র, ২. বেকারত্ব ও হতাশা ৩. অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তি এবং ৪. জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধকরণ ইত্যাদি।
সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র: যতদিন এরূপ আগ্রাসন, নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র থাকবে ততদিন যে কোনো দেশে কিছু মানুষ অজ্ঞতা ও আবেগের প্রেষণে উগ্রতায় লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। এরূপ সম্ভাবনা একেবারে রহিত করা যায় না। অনুরূপভাবে যে মুসলিম দেশের ভৌগলিক বা অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে সে দেশে আধিপত্য বিস্তার করতে বা সে দেশের সরকারকে ছাড় দিতে বাধ্য করতে কিছু ‘‘জঙ্গি’’ তৈরি করা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য অত্যন্ত সহজ ও কার্যকরী পন্থা। তবে আমরা বাকি তিনটি কারণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে প্রথম কারণটিও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে।
বেকারত্ব ও হতাশা: বেকারত্ব, বঞ্চনা ও হতাশার পাশাপাশি জ্ঞানহীন আবেগ চরমপন্থা ও জঙ্গি কর্মকান্ডের জন্ম দেয়। আমাদের সমাজে যারা সর্বহারার রাজত্বের জন্য বা ইসলামী রাজত্বের জন্য সহিংসতায় লিপ্ত তাদের প্রায় সকলের জীবনেই এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা শিক্ষিত বেকার যুবককে কেউ বুঝিয়েছে যে, এরূপ সহিংসতার মাধ্যমে অতি তাড়াতাড়িই তোমার ও অন্যদের কষ্ট ও বঞ্চনার সমাপ্তি ঘটবে এবং সর্বহারার রাজত্ব বা ইসলামী রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। তুমি ক্ষমতা ও কর্ম অথবা জান্নাত লাভ করবে। হতাশগ্রস্থ যুবকরা সহজেই এ কথা বিশ্বাস করে এ সকল কর্মে লিপ্ত হয়। কারণ তার অন্য কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছই নেই। বেকারত্ব, সামাজিক অবহেলা, ন্যায় বিচারের দুর্লভতা, বঞ্চনা ও অজ্ঞতা প্রভৃতি দূর না করে শক্তি বা আইন দিয়ে কঠোর হস্তে ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূলের চেষ্টা করলে জাতির ক্ষতি হবে। এতে এদেশের অনেক সন্তান ‘‘নির্মূল’’ হলেও ‘‘জঙ্গিবাদ’’ নির্মূল হবে না। যারা চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকান্ডে লিপ্ত তারা আমাদের সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারের শিকার। তাদেরকে শত্রæ বিবেচনা করে নির্মুল করার চেয়ে নাগরিক ও দেশের সন্তান বিবেচনা করে যথাসম্ভব সংশোধন করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয় নি এরূপ যুবকদের সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব পিতৃত্বের বা অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়ে সকল নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি প্রদান এবং নিরপরাধকে শাস্তি থেকে রক্ষার পাশাপাশি কম অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া তাদের কর্তব্য। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, ইনসাফ, বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট শাসক ও প্রশাসকগণ আল্লাহর সর্বোচ্চ দয়া ও পুরস্কার লাভ করবেন।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে নিরপরাধের শাস্তিঃ জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর দিক হলো নিরপরাধের শান্তি। জঙ্গিবাদ দমনের নামে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে নিরপরাধ মাদ্রাসা ছাত্র বা ধার্মিক মানুষদেরকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, কারাগারের রাখা, রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি কর্ম একদিকে মানবাধিকার ভূলণ্ঠিত করবে, অপরদিকে এ সকল নিরপরাধ মানুষ ও তাদের আপনজনদেরকে জঙ্গিবাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে এবং সর্বোপরি আমাদেরকে আল্লাহর গযব ও শাস্তির মধ্যে নিপতিত করবে। কারণ নিরপরাধের শাস্তি ও বিচারবহির্ভুত হত্যা, শাস্তি ও কষ্টদান যখন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক রূপ প্ররিগ্রহণ করে তখন আল্লাহর গযব ও জাগতিক শাস্তি সে দেশের ভাল ও মন্দ সকল মানুষকে গ্রাস করে।
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরুদ্ধকরণঃ এটা সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর বিষয়। মাওবাদী সন্ত্রাসীগণ বা আমাদের দেশের চরমপন্থী বলে কথিত ‘‘বামপন্থী জঙ্গিগণ’’ যে মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া প্রচার করেন মূলধারার মার্কসবাদী, সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থীগণও একই মতাদর্শ ও দাবি-দাওয়া প্রচার করেন। অনুরূপভাবে ইসলামের নামে উগ্রতায় লিপ্ত বা জঙ্গিবাদীরা যে সকল মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া পেশ করেন প্রায় একইরূপ মতাদর্শ ও দাবি দাওয়া প্রচার করেন মূলধারার ইসলমী রাজনীতিবিদ, আলিম, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও পীর-মাশাইখগণ। পার্থক্য হলো কর্মপদ্ধতিতে। চরমপন্থী ও জঙ্গিরা বলপ্রয়োগ, আইন অমান্য ও মানব হত্যার মাধ্যমে তাদের আদর্শ চাপিয়ে দিতে চান। পক্ষান্তরে মূলধারার মানুষেরা দেশের আইনের আওতায় গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। গ্রহণ করা বা না করা জনগণের ইচ্ছাধীন।
সাম্যবাদী জঙ্গি বা সমাজতন্ত্রী সন্ত্রাসীদের কারণে কেউ মূলধারার সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রীদেরকে দায়ী করেন না বা ‘‘চরমপন্থা’’ দমনের নামে বামপন্থী রাজনীতি ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন না। কেউ বলেন না যে, সাম্যবাদী রাজনীতির কারণেই চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী জন্ম নিচ্ছে; কাজেই সাম্যবাদী রাজনীতি বন্ধ করা হোক। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যায়। জঙ্গিবাদ দমনের অযুহাতে অনেক সময় ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আইন ও বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি বা ইসলামী মূল্যবোধ বিকাশের দাবি বন্ধ করার অপচেষ্টা করা হয়। ‘‘ধর্মনিরপেক্ষতার’’ নামে কিংবা ‘‘জঙ্গি’’ নির্মূল করার নামে ‘‘ইসলামী রাজনীতি’’ বা ইসলামী মূল্যবোধ প্রসারমূলক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের দাবি করা হয়। অথচ ধর্মনিরপেক্ষতার মূল দাবী হলো সকল ধর্মের মানুষকে তার ধর্ম পালন ও ধর্মের বিষয়ে তার নিজের ব্যাখ্যা ও মতবাদ প্রচারের সুযোগ দেওয়া। গণতান্ত্রিক অধিকারের আওতায় মতপ্রকাশের অধিকার দিলে উগ্রতার পথ রুদ্ধ হয়। অতীতে কোনোকোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি নিষেধ করার ফলে সমাজতান্ত্রিক জঙ্গিবাদের উন্মেষ ঘটেছে। পরবর্তীতে মূলধারায় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সুযোগ দেওয়ার ফলে সাম্যবাদের নামে সন্ত্রাস ক্রমান্বয়ে কমে যায়।
বস্তুত, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে পারেন। যারা ইসলামী মূল্যবোধ, আখলাক-আচরণ, শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুকেই ‘‘আফিম’’, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’’ বা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক বলে বিশ্বাস করেন, অথবা তাদের বাণিজ্যিক, সাম্রাজ্যবাদী কিংবা অনুরূপ স্বার্থের প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন তারা জঙ্গিবাদের অযুহাতে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিস্তারের সকল কর্ম নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। অনুরূপভাবে ‘‘ইসলামপন্থীরা’’ চরমপন্থা নির্মূল অযুহাতে সাম্যবাদী বা সমাজতন্ত্রী আদর্শ প্রচার নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। মত প্রকাশের অধিকার উভয়ের আছে। তবে সরকার ও প্রশাসনকে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। তাদের নিজস্ব কোনো মত বা পক্ষ থাকলেও সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের দায়িত্ব হয় সকলের অধিকার রক্ষা করা এবং দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখা। আমাদের বুঝতে হবে যে, ভাল বা মন্দ কোনো কথারই ‘‘কণ্ঠ’’ রুদ্ধ করার প্রবণতা কখনোই ভাল ফল দেয় না। বিশেষত জঙ্গিবাদের নামে ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী আদর্শ প্রচার, শিক্ষা বিস্তার ও ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠার আইনসম্মত দাওয়াতকে নিষিদ্ধ বা বাধাগ্রস্থ করলে তা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণের অপরাধ ছাড়াও দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে। এ জাতীয় যে কোনো কর্ম জঙ্গিদেরকে সাহায্য করবে, তাদের প্রচার জোরদার করবে, তাদের নতুন রিক্রুটমেন্ট দ্রুত বাড়বে এবং দেশ ও জাতিকে এক ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী অশান্তির মধ্যে ফেলে দিবে।
মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে প্রিয়নবী এর রাষ্ট্র পরিচালনার অনুপম আদর্শে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে ন্যায় বিচার ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমীন বিজাহিন নবিয়িল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।