করোনায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১ হাজার ৫৯৬
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ২০২০ সালে এসে, এটা শতবার্ষিকী দিবস হয়েছে। বছরব্যাপী লেখালেখি হবেই। আজকেও প্রচুর লেখালেখি আছে বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়াতে। আমি যেহেতু সামরিক প্রেক্ষাপটের ব্যক্তি এবং একজন রণাঙ্গনের যোদ্ধা, তাই আমি এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই কিছু কথা উপস্থাপন করছি। ১৯৭৩ সালে মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাব দেন, তাদের মধ্যে আমি একজন।
আমি বঙ্গবন্ধুর কমান্ডে যুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অংশে আমার উপরে তাৎক্ষণিক বা ইমিডিয়েইট সিনিয়র ছিলেন, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও যুগপৎ ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সফিউল্লাহ। অতঃপর সিনিয়র হন পুনর্গঠিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। এসময়, মেজর মইনুল হোসেনের উপরোস্থ ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লে. কর্নেল সফিউল্লাহ। তাঁর উপরোস্থ ছিলেন বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল ওসমানী। তাঁর উপরোস্থ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, তার উপরোস্থ ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ওই সময় স্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতিই ছিলেন সর্বাধিনায়ক বা সুপ্রিম কমান্ডার। অতএব, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা তরুণ ইবরাহিমের উপরে চূড়ান্ত অধিনায়ক তথা সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় সর্বাধিনায়কের প্রতি সম্মান জানানোর নিমিত্তে কয়েকটি অনুচ্ছেদ এই কলামে লিখলাম। উল্লেখ করে রাখছি যে, ২৭ মার্চ ১৯৭১, তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে অল্প দূরে অবস্থিত কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং দ্বিতীয়বারে, আরো বর্ধিত ও সুসংহত ভাষ্যে, ‘আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ এর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। ওই অর্থে, সেদিনই বঙ্গবন্ধু সর্বাধিনায়ক হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন আমাদের কোনো মিলিটারি একাডেমি ছিল না। আমাদের কোনো ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড ছিল না। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীনই, ৬১ জন তরুণ, তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে, তৎকালীন বাংলাদেশ ফোর্সেস-এ, সরাসরি রণাঙ্গনে অফিসার হিসেবে কমিশন পান। আরো একটি দল বা ব্যাচ নির্বাচিত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেছিল কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। এই দ্বিতীয় ব্যাচ পরে ঢাকা সেনানিবাসে অস্থায়ীভাবে গঠিত ব্যাটেল স্কুল থেকে কমিশন পায় ১৯৭২ সালের আগস্ট মাসে। স্বাধীন বাংলাদেশে, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৭৩ সালের শুরুতেই, সেনাসদর ও বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে। একাডেমির জন্য ক্যাডেট নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হলো ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড বা আইএসএসবি বা আন্তঃবাহিনী নির্বাচন পর্ষদ। এই আইএসএসবি গঠনের জন্য আমিসহ পাঁচজন বাংলাদেশি অফিসার ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলাম, ১৯৭৩ সালের মার্চ-এপ্রিল ৯ সপ্তাহ। প্রশিক্ষণের স্থান ছিলো: রুরকি ক্যান্টনমেন্ট, উত্তর প্রদেশ। ওই পাঁচজনের নাম নিম্নরূপ: (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত, তৎকালীন আর্মার্ড কোর-এর) মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) মেজর দানিয়াল ইসলাম, (এই কলামের লেখক) ক্যাপ্টেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, (বর্তমানে মরহুম, মৃত্যুর পর্বে অবসরপ্রাপ্ত মেজর, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র , মধ্য আশিতে জেনারেল এরশাদ-মন্ত্রীসভায় খাদ্য প্রতিমন্ত্রী) ক্যাপ্টেন ইকবাল হোসেন চৌধুরী এবং (বর্তমানে অতি বয়স্ক এবং চট্টগ্রাম নিবাসি) বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার মোহম্মদ কামালউদ্দিন। অতঃপর এই প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই ১৯৭৩-এর জুলাই-আগস্ট মাসে আর্মি সিলেকশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। এই বোর্ডের সাথে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া ৯ জন জ্যেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও কর্নেল যুক্ত হন। সুপ্রতিষ্ঠিত এই বোর্ড, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচের জন্য ক্যাডেট নির্বাচন করে। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির প্রথম ব্যাচ এবং দ্বিতীয় ব্যাচ যাদের যথাক্রমে এসএসসি-১ ও এসএসসি-২ বলা হয়, তাদের নির্বাচনের সময় আমিও ওই আর্মি সিলেকশন বোর্ডের একজন প্রতিষ্ঠাতা- সদস্য ছিলাম। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গৌরবের বিষয়। প্রথম কোর্স তথা এসএসসি-১ এর নির্বাচন বা মনোনয়ন ১৯৭৩-এর নভেম্বরের মধ্যে শেষ হয় এবং তারা ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে, কুমিল্লা সেনানিবাসে অস্থায়ীভাবে গঠিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ এই ব্যাচ বা দলের বা কোর্সের পাসিং আউট প্যারেড তথা কমিশন প্যারেড তথা প্রেসিডেন্টস প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়, অস্থায়ী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রাঙ্গণে, কুমিল্লা সেনানিবাসে। সেই প্যারেডে প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সুধীমন্ডলীর উপস্থিতিতে, নবীন অফিসারদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, আমি সেই ভাষণ শুনে শুনে লিখে, নিচের অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত করলাম। ফেসবুক বন্ধুদের মাধ্যমে সেটি আমি ফেসবুক-মেসেঞ্জারে পেয়েছি। যতটুকু মেসেঞ্জারে পেয়েছি, ততটুকুই উদ্ধৃত করলাম; আগে-পরে কিছু থাকতেও পারে।
বঙ্গন্ধুর ভাষণ ১১ জানুয়ারি ১৯৭৫ (বিএমএ , কুমিল্লা) , ‘মনে রেখো, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। তুমি যখন শাসন করবা সোহাগ করতে শেখো। তাদের দুঃখের দিনে পাশে দাঁড়িও। তাদের ভালোবেসো। কারণ, তোমার হুকুমে সে জীবন দেবে। তোমাকে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হবে। সে শ্রদ্ধা অর্জন করতে হলে তোমাকে শৃঙ্খলা শিখতে হবে। নিজকে সৎ হতে হবে, নিজের দেশকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে এবং চরিত্র ঠিক রাখতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো কাজ করা যায় না। আমার মুখ কালা করো না, কারণ দেশের মুখ কালা করো না। সাঁ সাঁ করে মানুষের মুখ কালা করো না।
তোমরা আদর্শবান হও, সৎ পথে থেকো। মনে রেখো, মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন। মাঝেমাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। এত রক্ত দেওয়ার পরে যে স্বাধীনতা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকের হয় নাই। এখনও ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরকারবারি, মুনাফাখোরী বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত আমি এদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। কাল যখন আমি আসতেছিলাম ঢাকা থেকে, এত দুঃখের মধ্যে না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে বাস করতেছে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য। আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি, তোমরা আমাকে এত ভালোবাসো কেন? কিন্তু যেই দুঃখী মানুষ দিনভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, পেটে খাবার নাই, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার কাছে কিছু রেখে যায় নাই।
বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে এভাবে লুটতরাজ করে খায়। আমি শুধু এমার্জেন্সি দিই নাই, এবারে প্রতিজ্ঞা করেছি, যদি ২৫ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে গোলাম মোহম্মদ, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ৩০ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না? নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ পারব।
এই বাংলার মাটি থেকে এই দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখোরী এই চোরাচালানকারীদের নির্মূল করতে হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো। আর না, অধৈর্য, সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এইজন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই। কয়েকটি চোরাকারবারি, মুনাফাখোর ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বাইর করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম গুদাম করে মানুষকে না খাইয়া মারে। উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকের থেকে এদের। দেখি কতদূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি না ঈমানদারের শক্তি বেশি, সেটাই আজ প্রমাণ হয়ে যাবে।’ উদ্ধৃতি শেষ। এই ভাষণের কথাগুলো বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের বেদনার প্রতিফলন; এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। একজন সর্বাধিনায়ক হিসেবে, তিনি তরুণতম অফিসারদের যুগোপযোগী উপদেশই দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, অনেক দেশাত্মবোধক জনপ্রিয় গান, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সমগ্র দেশের মানুষকে উদ্বেলিত করত, তাদের মনোবলকে সর্বদাই উজ্জীবিত রাখত। এরকম একটি গানের শিরোনাম বা প্রথম লাইনটি হলো ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’। গানটির রচয়িতা ছিলেন গোবিন্দ হালদার এবং মুক্তিযুদ্ধকালে প্রথম এই গানটি গেয়েছিলেন ওই আমলের প্রখ্যাত তরুণ সঙ্গীতশিল্পী আপেল মাহমুদ। গানের কথাগুলোর তাৎপর্য। সেই ফুল কী ছিল? সেই ফুল ছিল বাংলার মেহনতি মানুষ, সেই ফুল ছিল স্বাধীনতা, সেই ফুল ছিল স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, সেই ফুল ছিল গণতন্ত্র, সেই ফুল ছিল পাকিস্তানিদের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছিল একটি ফুলকে বাঁচানোর জন্য এবং সেই সময় স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ প্রায় সমার্থক ছিল। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবসে, আমরা মনে করি নতুন ফুলকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করতে হবে। নতুন ফুল কী? নতুন ফুল গণমানুষের সার্বিক অধিকার, দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা, নতুন ফুল গণতন্ত্র এবং নতুন ফুল মুক্তিযুদ্ধের আদি ও অকৃত্রিম চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধকালে ও বর্তমানে। সুপ্রিম কমান্ডার বা সর্বাধিনায়ক এবং কমান্ডার ইন চিফ বা প্রধান সেনাপতিÑএই পদবিগুলোর তাৎপর্য নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হয়। বিতর্কের কারণ, সঠিক সচেতনতার অভাব। তাই এই অনুচ্ছেদে ওই সম্পর্কে কিছু কথা তুলে ধরছি। বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিক্যাল ৬১ মোতাবেক, ১৯৭২ থেকেই, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টই হলেন সব বাহিনীর চূড়ান্ত অধিনায়ক এবং তাকে বলা হয় সর্বাধিনায়ক বা সুপ্রিম কমান্ডার। ব্যাখ্যা দিচ্ছি। প্রত্যেক দেশেই সশস্ত্র বাহিনী থাকে। সশস্ত্র বাহিনীগুলো সেনা বা নৌ বা বিমান ইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রত্যেকটি বাহিনীর পেশাগত প্রধান (ইংরেজি পরিভাষায় : প্রফেশনাল হেড) থাকে। ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশদের অধীনে ছিল তখন পেশাগত প্রধানকে কমান্ডার ইন চিফ বলা হতো। কমান্ডার ইন চিফের বাংলা অনুবাদ প্রধান সেনাপতি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হয় এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। জন্মলগ্নে, এই উভয় দেশের সংবিধান ছিল না। তাই ব্রিটিশ আমলে যেই পদ্ধতি বা যেই রেওয়াজ বা যেই আইন মোতাবেক দেশ চলছিল, সেগুলোই পাকিস্তানে, কম-বেশি হুবহু বহাল বা চলমান থাকল। উদাহরণস্বরূপ ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানকে অভিহিত করা হলো কমান্ডার ইন চিফ ইন্ডিয়ান আর্মি, এই পরিচয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানকে অভিহিত করা হলো কমান্ডার ইন চিফ পাকিস্তান আর্মি, এই পরিচয়ে। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতে যখন নিজেদের সংবিধান গৃহীত হলো, তখন তারা বাহিনী প্রধানের পদবিকে অভিহিত করল ‘চিফ অফ স্টাফ ইন্ডিয়ান আর্মি’, ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স, ইন্ডিয়ান নেভি- এরূপ। এই রেওয়াজ আজ অবধি চলছে। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীন পাকিস্তানে যখন নিজেদের সংবিধান গৃহীত হলো, তারা কিন্তু বাহিনী প্রধানদের পদবি পরিবর্তন করল না। পাকিস্তানে এই পদবি পরিবর্তিত হলো, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখের পর, যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করল এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্ব নিল এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব নিলেন।
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক জন্ম তথা অভ্যুদয় তথা স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ ১৯৭১। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শুরুতে (১০ এপ্রিল) যখন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং যখন সেই সরকার শপথ গ্রহণ করে (১৭ এপ্রিল), তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্টপতি বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; এবং তিনি সরকার প্রধানও হলেন। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন, অতএব তিনি অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হন এবং দায়িত্ব গ্রহণ করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ক্ষুদ্র কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। অন্য তিনজন মন্ত্রী ছিলেন কামরুজ্জামান, মনসুর আলী এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদ। ওই সরকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাহিনীর পেশাগত প্রধান হিসেবে মনোনীত করেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে।
কিন্তু যেহেতু যুদ্ধ চলছে, সেহেতু তিনি আর অবসরপ্রাপ্ত থাকলেন না। তিনি একজন চাকরিরত তথা যুদ্ধরত সৈনিক বা অফিসার হয়ে গেলেন। তাকে অভিহিত করা হয়: ‘কমান্ডার ইন-চিফ বাংলাদেশ ফোর্সেস’। উল্লেখ্য, কর্নেল ওসমানী ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করেছিলেন এবং অবসরের কিছু মাস পরই আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে, তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানী, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য তথা এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্ণ নয় মাস, কর্নেল ওসমানী এই পরিচয়েই দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই, বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসমানীকে চার তারকা ‘জেনারেল’ এ পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশের চাকরি থেকে পুনরায় অবসর দেয়া হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটে একজন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে এবং ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী একটিই ছিল, নাম: বাংলাদেশ ফোর্সেস। পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধকালে এই বাংলাদেশ ফোর্সেস-এর অধীনেই ছিল সব সেক্টর, সব ফোর্স এবং সকল সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধাগণ (বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী ব্যাতীত)।
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে, জেনারেল ওসমানীর প্রস্থানের পর, বাংলাদেশে তিনটি বাহিনী আলাদা পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। যথা- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এপ্রিল ১৯৭২-এ এই তিনটি বাহিনীর জন্য, আলাদাভাবে পেশাগত প্রধান বা বাহিনী প্রধান নিয়োগ করা হয় এবং ওই পদটিকে অভিহিত করা হয় চিফ অফ স্টাফ নামে। যথা : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য চিফ অফ আর্মি স্টাফ, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য চিফ অফ নেভাল স্টাফ এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য চিফ অফ এয়ার স্টাফ। তাদের উপরে হলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উপরে হলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর উপরে হলেন রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট। ১৯৭২ সালে এপ্রিল মাসে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে পাওয়া সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়, রাষ্ট্রপতি ছিলেন সর্বাধিনায়ক। বাংলাদেশের ইতিহাসে, শুধুমাত্র একবারই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য আলাদা একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়েছিলো; বঙ্গবন্ধুর আমলেই: জনাব নুরুল ইসলাম হয়েছিলেন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের মধ্য দিয়ে গঠিত গৌরবোজ্জ্বল সেনাবাহিনীর প্রথম চিফ অফ আর্মি স্টাফ ছিলেন মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ বীর উত্তম, দ্বিতীয় ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তৃতীয় ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫তম সেনাপ্রধান বা চিফ অফ আর্মি স্টাফ হচ্ছেন জেনারেল আজিজ আহমদ। বর্তমান সেনাপ্রধান এবং বর্তমান সেনাবাহিনীকে, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে, আমার শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।