করোনায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১ হাজার ৫৯৬
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট
[দেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারতীয় সৈন্য তখনো ফিরে যায়নি। কবে ফিরবে, কেউ জানে না। স্বাধীন দেশে বিদেশি সৈন্য অনির্দিষ্টকাল ধরে থাকবে, এটা কাম্য হতে পারে না। এ নিয়ে নানা মহলে কথাবার্তা হচ্ছিল। স্বাধীনতার পূর্ণতার জন্য ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ছিল জরুরি। স্বাধীন দেশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্যও এর অতিব প্রয়োজন ছিল। ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতির কারণে অনেক দেশই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা-দ্ব›েদ্ব ছিল। গোটা বিষয়টি বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে উপলব্ধি করে সম্ভাব্য প্রথম সুযোগেই বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে উত্থাপন করেন। জানতে চান, কবে নাগাদ তার দেশের সৈন্য বাংলাদেশ ছাড়বে? জবাবে ইন্দিরা গান্ধী ইতিবাচক সাড়া দেন এবং স্বাধীনতার ৯০ দিনের মাথায় ভারতীয় সৈন্য কীভাবে বাংলাদেশ ছাড়বে তার ব্যবস্থা স্থির হয়। মুজিব-ইন্দিরা সংলাপের কোনো সরকারি বিবরণ পাওয়া যায় না। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুলের স্মৃতিনির্ভর একটি প্রতিবেদনে এর একটি বিবরণ পাওয়া যায়। আমরা সেটি এখানে তুলে দিলাম।]
দেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম করার অব্যবহিত পর শেখ মুজিবুর রহমান আরো একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তার উল্লেখ না করলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধু আলোচনার মাধ্যমে এ দেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার একক কৃতিত্বও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক সহযোগিতা ছিল তুলনাহীন।
আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন অসম্ভব ছিল। স্বাধীনতার ঠিক ৯০ দিনের মাথায় কীভাবে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা হয়েছিল, আমি নিজেই তার অন্যতম সাক্ষী। এখন সেই দুর্লভ মুহূর্তের প্রতিবেদন।
দুপুরে খাওয়ার পর কলকাতার রাজভবনে আমরা জনাকয়েক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একান্তে আলাপ করছিলাম। আমি তখন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দপ্তরের মহাপরিচালক। দিন দুই আগে ঢাকা থেকে ৩৫ জন সাংবাদিককে নিয়ে কলকাতায় এসেছি। এসব সাংবাদিক কলকাতায় এসেছেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফরসংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের জন্য। তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কলকাতার বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে। আমার মনে তখন দারুণ কৌতূহল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বুকে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘স্যার, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে আলোচনা হতে যাচ্ছে, তাতে এজেন্ডা তো দেখলাম না? তাহলে আপনারা কী কী বিষয়ে আলোচনা করবেন?’
শেখ সাহেব তাঁর পাইপটাতে ঠিকমতো আগুন ধরিয়ে এরিনমোর তামাকের গন্ধওয়ালা একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে কথা বলতে শুরু করলেন: ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গেলাম। সেখান থেকে ঢাকায় আসার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে জীবনে প্রথম এই মহিলাকে [ইন্দিরা গান্ধী] দেখলাম। এর আগে তো এঁর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয়ই ছিল না।’
সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘স্যার, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে সাহায্য করা ছাড়াও আপনার জীবন বাঁচানোর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দরজায় ঘুরেছেন।’
বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে আবার কথা শুরু করলেন, ‘তোদের বন্ধুবান্ধবরা তো আমাকে অর্ধশিক্ষিত বলে। তাহলে ইতিহাস থেকে একটা কথার জবাব দে? আজ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ কিংবা কমিউনিস্ট কিংবা অন্য কেউ, যারাই অন্য দেশে সৈন্য পাঠিয়েছে, তারা কি স্বেচ্ছায় সৈন্য প্রত্যাহার করেছে? তোরা কি দেখাতে পারিস যে এমন কোনো দেশ আছে?’
আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম।
উনি পাইপে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে হালকা মেজাজে কথা আরম্ভ করলেন, ‘কানের মাঝ থেকে সাদা-কাঁচা চুল বাইরাইয়া আছে, ভারতে এমন সব ঝানু পুরনো আইসিএস অফিসার দেখছোস? এঁরা সব ইন্দিরা গান্ধীরে বুদ্ধি দেওনের আগেই আজ আলোচনার সময় ম্যাডামের হাত ধইরা কথা লমু। জানোস কী কথা? কথাটা হইতাছে, ম্যাডাম তুমি বাংলাদেশ থাইক্যা কবে ইন্ডিয়ান সোলজার ফেরত আনবা?’
বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রæতি রেখেছিলেন। কলকাতার রাজভবনে ফার্স্ট রাউন্ড আলোচনার শুরুতে দুজনে পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আসল কথাটা উত্থাপন করলেন।
মুজিব: ম্যাডাম, আপনে কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন?
ইন্দিরা: বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি তো এখন পর্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। পুরো ‘সিচুয়েশন’ বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন, সেটাই করা হবে।
মুজিব: মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ লোক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইন ও শৃঙ্খলাজনতি পরিস্থিতির জন্য আরো যদি লাখ দশেক লোকের মৃত্যু হয়, আমি সেই অবস্থাটা বরদাশত করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
ইন্দিরা: এক্সিলেন্সি, কারণটা আরেকটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হব।
মুজিব: এখন হচ্ছে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময়। এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরোধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরোধীপক্ষ দ্রæত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়। ম্যাডাম, আপনেও বোধ হয় এই অবস্থা চাইতে পারেন না। তাহলে কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করছেন?
ইন্দিরা : (ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলেন) এক্সিলেন্সি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী ১৭ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
মুজিব: ম্যাডাম, কেন এই বিশেষ দিন ১৭ মার্চের কথা বললেন?
ইন্দিরা: এক্সিলেন্সি প্রাইম মিনিস্টার, ১৭ মার্চ আপনার জন্ম তারিখেই আমাদের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসবে।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ভারত সরকারের আমলাতন্ত্র এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহলের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে যেদিন ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি বাংলার মাটি ত্যাগ করে সেদিন ছিল ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।
[‘পুরো সিচুয়েশন বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়?’ ইন্দিরা গান্ধীর এই আশঙ্কা যে কতখানি সত্য, কয়েক মাসের মধ্যেই টের পাওয়া যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বিদ্রোহীদের কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিল না বাংলাদেশের নবগঠিত প্রতিরক্ষা বাহিনী। তাই প্রত্যাহারের কয়েক মাসের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্যদের আবার ডাকতে হলো।
সূত্র: এম আর আখতার মুকুলের ‘মুজিবের রক্ত লাল’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।