করোনায় আরও ৩৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১১ হাজার ৫৯৬
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট
আজ জন্মশতবর্ষের দিনে এসে অনেকের মনেই কৌতূহল জাগছে, মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনটি কীভাবে পালিত হয়েছিল? কেমনই বা ছিল জীবনের শেষ জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা? পাঠকদের সে কৌতূহল নিবারণ করতেই ১৯৭২ সালের ১৭, ১৮ মার্চ এবং ১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট সংবাদগুলো সংগ্রহ করে গ্রন্থনা করেছেন, সৈয়দ ইবনে রহমত।
১৯৭১ সালের নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে। এর পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি। সে বছরই মার্চ মাসে পালিত হয় মুক্তবাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জন্মদিন হিসেবে এটি পালিত হওয়ার কথা বেশ আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেটি হয়নি। সেদিন জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা পালিত হয়েছে অনাড়ম্বর আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এর কারণ হতে পারে, বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটি প্রত্যাশা করেননি বা হতে দেননি। আরো একটি কারণ ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সেদিনই উপস্থিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানকারী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। ফলে দিনটি ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। তবে সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ৫৫ কোটি ভারতবাসীর পক্ষ থেকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আয়োজনকে দিয়েছিলেন ভিন্নমাত্রা।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব হউন’ শিরোনামে ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ছাত্র ও সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জাতির পিতার জন্মদিবস উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বেতার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানও প্রচার করে। সকাল ১০টায় ‘অন্তরঙ্গ সংলাপ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকাল এবং যৌবনকালের কথামালা প্রচারিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতা, বন্ধু-বান্ধব এবং স্বগ্রামের বয়স্ক মানুষদের সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হয়। রাত ১টায় বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পোরেশন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি প্রচার করে। এর মধ্যে ছিল সন্ধ্যা ৬.৪০ মিনিটে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের অনুষ্ঠান। ৮.৩০ মিনিটে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতার সাক্ষাৎকার।
সেদিন ছিল সরকারি ছুটি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন উপলক্ষে সরকারি ছুটির বিপরীতে দিনটিকে কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের জন্য বিশেষভাবে পালনের পক্ষপাতি ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে সেদিন সরকারি ছুটি থাকলেও ভবিষ্যতে যেন সেটি আর না হয় সেজন্য একটি বিবৃতি দিয়েছিলন। ১৭ মার্চ ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠায় ‘ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ছুটি থাকিবে না’ শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল (বৃহস্পতিবার) বলেন যে, ভবিষ্যতে তাঁহার জন্মদিন আর সরকারী ছুটির দিন হিসেবে উদ্যাপিত হইবে না। এই দিনটি কঠোর শ্রম ও বৃহত্তর কল্যাণে আত্মনিয়োগের দিন হিসাবে পালিত হইবে।
গতকাল এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর ১৭ই মার্চ অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছার প্রতীক হিসাবে সরকারী ছুটি হিসাবে পালিত হইবে।” একই পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাজুদ্দীন’ শিরোনামে অপর সংবাদে জানা যায়, “বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এক শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন: আজ ১৭ই মার্চ। মহান বাঙ্গালী জাতির পিতা শেখ মুজিবের জন্মদিন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে আজ একটি মাত্র স্লোগান-জয়তু মুজিব! আর এই স্লোগানের মুহূর্মুহু ধ্বনির প্রতিধ্বনি মহান নেতার জন্মতিথিতে তাঁহাকে জানাইতেছে স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধার্ঘ্য, প্রীতি, শুভেচ্ছ, আশিস, আর ভালবাসা। কামনা তাহাদের একটিই- মুজিব, তুমি দীর্ঘজীবী হও!
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের আনন্দানুভূতির সাথে সাথে কোটি মানুষের হৃদয় আজ বাংলার মাটিতে আর একজনের শুভাগমনের আনন্দে উদ্বেল। তিরিশ লক্ষ নর-নারীর রক্তের আলেখ্যমাখা স্বাধীন বাংলার বুকে রক্তেরাঙ্গা রাখী বন্ধনে মিত্র মহান ভারতবর্ষে ছাপ্পান্ন কোটি মানুষের স্নেহ, প্রীতি ও ভালবাসার বাণী লইয়া শুভ পদার্পণ করিতেছেন আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার জনগণ-নন্দিত মহীয়সী নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার ধ্বংসপূর্ণ পিঠে দাঁড়াইয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ের অর্ঘ্যে আজ তাঁহাকে জানাই স্বাগতম।
জয় বঙ্গবন্ধু-জয় শ্রীমতী গান্ধী-জয় বাংলা।”
চার ছাত্রনেতার বিবৃতি: একই দিনের খবর থেকে জানা যায়, ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ. স. ম. আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যৌথ বিবৃতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রæতি দিয়ে ৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
১৮ মার্চ ইত্তেফাকে ‘মুক্তবাংলায় বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনে’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়, “গতকাল (শুক্রবার) জাতি যুদ্ধবিধ্বস্ত, রিক্ত বাংলাদেশের বুকে অনাড়ম্বর অথচ শ্রদ্ধাবনত-চিত্তে নবীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৩তম জন্মতিথি পালন করে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্তরের মানুষ গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীস্থ বাসভবনে গমন করিয়া তাঁহাকে মালাভূষিত এবং প্রিয় নেতার দীর্ঘায়ু কামনা করে। মহান ভারতের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ জাতির জনককে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ মহান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তিনি এই উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ফলমূল ও মিষ্টান্ন উপহার দেন। ৫৫ কোটি ভারতবাসীর শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তিনি এগুলি ভারত হইতে লইয়া আসিয়াছেলিন।
ভারতরতœ ইন্দিরার সফর উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তাঁহার জন্মদিনের অনুষ্ঠানাদি সর্বক্ষেত্রে যথাসম্ভব সংক্ষেপ করা হয়। এতদসত্তে¡ও বিভিন্ন দল ও সংস্থার পক্ষ হইতে কিছু কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে এবং হইতেছে।
গতকাল ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই দিনটিকে পালন করে। দলের পক্ষ হইতে ভোরে বঙ্গবন্ধুকে মালাভূষিত করিয়া দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়, যাহাতে তিনি বাঙ্গালী জাতিকে উন্নতি ও সমৃদ্ধি পথে আগাইয়া লইয়া যাইতে পারেন।”
জীবনের শেষ জন্মদিন
দৈনিক ইত্তেফাকের ১৯৭৫ সালের ১৮ মার্চ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্ম-জয়ন্তী নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গবন্ধুর ৫৫তম জন্ম-জয়ন্তী: নেতার স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা’ শীর্ষক সংবাদ থেকে জানা যায়,
“গতকাল (সোমবার) ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধার সহিত এই দিনটি পালন করে। এই দিন সরকারী ও বেসরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং দেশের বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থা করা হয়।
বাকশাল, জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল প্রভৃতির আয়োজন করা হয়।
নেতার জন্মদিনে আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনাসভায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাইবার জন্য কর্মদ্যোগী হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিদেশী কূটনৈতিক মিশনগুলির পক্ষ হইতেও বঙ্গবন্ধুকে মালাভূষিত করা হয়।
জন্মদিনে নেতাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাহার বাসভবন অভিমুখে ছিল জনতার স্রোত। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোন বাধা ছিল না। ভোর সাড়ে ছয়টা হইতে ৩২ নং রোডস্থ বাসভবনে নেতার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড় শুরু হয়। কেহ ফুলের মালা, পুষ্পস্তবক, কেহবা জন্মদিনের কেক, মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী লইয়া জাতির জনকের বাসভবনে উপস্থিত হন, শুভেচ্ছা জানান, মঙ্গল কামনা করেন। বঙ্গবন্ধু প্রফুল্লচিত্তে আগতদের সকলকেই সাক্ষাৎদান করেন ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সকাল ৭টা হইতে সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টাধিককাল ধরিয়া তিনি শুভার্থীদের সাক্ষাৎদান করেন। বাকশাল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা আসিয়াছিল মিছিলসহকারে, দলবদ্ধভাবে।---
বঙ্গবন্ধু পুষ্পমাল্যগুলি পাঠাইয়া দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষা আন্দোলনের শহীদানের মাজারে, শহীদ মিনারে এবং সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বঙ্গবন্ধু আগত সকলকেই দেশ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করার উপদেশ দেন। ---
সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাইব, অল্পক্ষণের জন্য হইলেও অফিসের কাজ করিব।’ উপস্থিত সকলকে তিনি নিজ নিজ অফিসে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সকাল প্রায় সোয়া ১১টার সময় বঙ্গবন্ধু গণভবনের উদ্দেশ্যে বাসভবন ত্যাগ করেন।”
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।