ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পারিবারিক উপাদানসমূহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারের মাধ্যমেই শিশুর শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিশুর প্রতি অভিভাবকের আচরণ থেকে হতে শিশুরা অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক কিছু শিখে থাকে, যা তার আচরণকে প্রভাবিত করে। পরিবারে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক শিশুর শিক্ষাবিকাশে অনেক সহায়তা করে থাকে। শিশুদের নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, তাদের পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেয়া। যেমন- পরিবারে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কত? নির্দিষ্ট শিশুর অবস্থান কোথায়? সে কি প্রথম সন্তান, না দ্বিতীয়, নাকি ছোট, না এক মাত্র সন্তান? পরিবারটি কত দিন যাবত তাদের বর্তমান অবস্থায় রয়েছে? আগের অবস্থান কত দিন ছিল? বাবার পেশা কি? মা চাকরি করে কি না? দাদা-দাদী এবং অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায় থাকেন কিনা? ডির্ভোস, মৃত্যু বা অভিভাবকদের দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতির কারণে ভগ্নপরিবার কিনা?
শিশুদের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। পরিবারের ছোট সন্তানটি তার পরিবারের নতুন কোন সদস্যের জন্ম গ্রহণের ফলে অনেক সময়ই খুব উদ্বিগ্ন থাকে এবং অপরিপক্ব ও এলোমেলো আচরণ করে থাকে। নতুন ভাই বা বোনের আগমনে সে বাবা-মায়ের আদর যতœ থেকে বঞ্চিত হবে এটা ভেবে অনেক সময়ই বিষণœ হয়ে পড়ে। ঘন ঘন বাসা বদল করলে নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে শিশুরা অসুবিধায় পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরে বাড়িতে বাবা অথবা মা উভয়ের অনুপস্থিতির ফলে শিশুর শিক্ষার বিকাশ ব্যাহত হয়। গবেষণায় দেখা রগছে, যে সব শিশু ভগ্ন পরিবার থেকে আসে, যাদের মা ফুলটাইম চাকরি করেন এবং যে সব শিশু অভিভাবকদের আদর যতœ ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তাদের মধ্যে মারাত্মকভাবে উপযোজন সমস্যা দেখা দেয়। ভগ্ন পরিবার থেকে আগত ১২৫ জন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পরিবার থেকে আসা ১২৫ জন শিক্ষার্থী, যাদের বুদ্ধিমত্তার একই ধরনের এবং যাদের বাবা মায়ের পেশার মধ্যেও সামঞ্জস্য রয়েছে তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করে (Reyburn 1951) দেখা গেছে যে, দুই দলই স্কুলের পরীক্ষায় মোটা মুটি একই ধরনের ফলাফল করেছে কিন্তু অন্যের সাথে উপযোজনের ক্ষেত্রে ভগ্ন পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের দেড়গুণ বেশি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, বাড়ি এবং পরিবার সম্পর্কিত বিষয়ে ভগ্ন পরিবারে শিক্ষার্থীদের তিনগুণ বেশি সমস্যা রয়েছে। শিশুদের সার্বিক বিকাশে পারিবারিক পরিস্থিতি বিশেষ করে, বাবা-মায়ের সাথে ছেলে-মেয়েদের সুসম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করে। পারিবারিক পরিস্থিতি অনুকূল না হলে শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও লেখাপড়ায় অমনোযোগের মত সমস্যা সৃষ্টি হয় যা তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কেমন, একের প্রতি অন্যের মনোভাব অনুভূতি কেমন, তার দ্বারাই পরিবারের আবেগময় অবস্থা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনেক পরিবার রয়েছে যার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সহর্মমিতা সহানুভূতি আস্থা ও ভালোবাসা বিরাজ করে। আবার অনেক পরিবারে এ পরিবেশের অভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়। আবার কোন, কোন পরিবার পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই সব ধরনের পরিবার হতেই শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে এবং শ্রেণিকক্ষে একত্রে লেখাপড়া করে। কিন্তু পারিবারিক আবেগময় অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলে তাদের আচরণের ভিন্নতা দেখা যায়। পরিবারের আবেগময় অবস্থা যেখানে অস্বাভাবিক, হতাশাজনক এবং শিশুদের চাহিদার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন সেসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমস্যামূলক আচরণ দেখা যায় এবং শ্রেণি কক্ষে তার প্রতিফলন ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একই শিশু বিভিন্ন ধরনের আবেগময় অবস্থায় ভিন্ন, ভিন্ন আচরণ করে থাকে (Lewin, Lippitt and White-1939) মেয়ার (Meyer-1947) তার গবেষণায় দেখেছেন যে, বাবা মা যদি ছেলে-মেয়েদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন এবং তাদের আচরণ বোঝার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেন তাহলে শিশুদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব কম বিকশিত হয় এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যে সমস্ত বাবা, মা ছেলে-মেয়েদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করেন এবং তাদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে চান তাদের ছেলে-মেয়েরা আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। এরা শ্রেণি কক্ষে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং শিক্ষাকের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে। একই ধরনের আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা গণতান্ত্রিক পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের চেয়ে শিক্ষা মূলক সমস্যা কম থাকে এবং তাদের উপযোজন ভাল হয় (Stone and lands-1953)।
উপরের আলোচনা হতে সহজেই বুঝা যায় যে, পারিবারিক সম্পর্ক শিশুর শিক্ষা জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক আবেগময় অবস্থার উপর ভিত্তি করে শিশুর মধ্যে তার নিজের সম্পর্কে এবং জীবন সম্পর্কে একটি মনোভাব গড়ে ওঠে। আবেগময় অবস্থা যদি খুব উত্তেজনাকর ও উদ্বেগময় হয় তাহলে শিশুর মধ্যেও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা হতাশার সৃষ্টি হয়। আবেগময় অবস্থা যদি কর্তৃত্ববাদী হয় যেখানে বাবা-মা যা বলবে তাই ঠিক এবং শিশু যা বলবে তাই ভুল সেই পরিবারের শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করে। যদি পরিবারের আবেগময় অবস্থা ও খোলামেলা হয়, সেখানে শিশু তার আবেগ সহজেই প্রকাশ করতে পারে, সেই পরিবারের ছেলে-মেয়েরা দায়িত্বর্শীল হয় তার মধ্যে স্বতস্ফূর্ততা থাকে এবং তারা সব বুঝে তা সহজেই অপকটে প্রকাশ করতে পারে। সুতারং শিশুরা যেন সুষ্ঠুভাবে বিকাশ লাভ এবং সুস্থ জীবন-যাপন করতে পারে তাই নিচের বিষয়গুলোর প্রতি পিতা-মাতা এবং অভিভাবক তীক্ষè দৃষ্টি রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
১) পরিবারের পিতামাতার সুসম্পর্ক রেখে চলতে হবে। পিতা মাতার কথায় যেন নেতিবাচক না হয়ে ইতিবাচক হয়। ছেলে-মেয়ের চালচলন রীতিনীতি এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই বয়সে তাদেরকে যা শিখানো হবে তাই তারা রপ্ত করবে।
২) ছেলে-মেয়েদেরকে অতিশাসন কিংবা সোহাগ থেকে বিরত থাকতে হবে। পিতা-মাতা তাদের স্কুলে আসা-যাওয়া সর্বদা মনিটরিং করতে হবে। শ্রেণির কাজ এবং বাড়ির কাজ ভালো ভাবে করলো কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।
৩) ভালো বন্ধুদের সাথে চলা ফেরা করে কি না বিদ্যালয় গিয়ে করণীয় দিক কি এবং বর্জনীয় দিক কি তা পিতা-মাতা বা অভিভাবক ঠিক করে দিতে হবে।
৪) বিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শ্রেণি কক্ষে বসে শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পরামর্শ শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
৫) পিতামাতাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে একজন শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা শিক্ষাকের সান্নিধ্য বা বিদ্যালয়ে থাকে। বাকি সময় শিশু বাসার বাড়িতে থাকে। এই স্বল্প সময়ে শিশুেেক সব কিছুতে পারদর্শী করে তোলা সম্ভব নয়। শিশুর প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র হলো পরিবার। পরিবার থেকে যা শিখে স্কুলে এবং পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে সুতারং শিশু যেন একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে পরিবারকেই তার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিবার হলে শিশুর শিক্ষার আগা। শিক্ষার এই আগা ভেঙে গেলে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই অভিভাবক, পিতা-মাতা, শিক্ষক সবাই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে শিশুকে ভবিষ্যৎ দিক নিদের্শনার দিকে চালিত করা উচিত।
লেখক : শিক্ষক ও প্রবন্ধিক
কোটবাড়ি, কুমিল্লা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।