Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাইকোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষিত

হারিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

নদী রক্ষায় হাইকোর্টের নির্দেশনা কার্যকর করা হচ্ছে না। নদী-খাল দখল দূষণ রোধে উচ্চ আদালতের আদেশ হচ্ছে উপেক্ষিত। উচ্চ আদালতের আদেশ না মানায় বাংলাদেশের ছোট-বড় তিন শতাধিক নদী হারিয়ে যাচ্ছে। ত্রিশটি নদী ও খালের দখল, পুনরুদ্ধার ও দূষণ রোধে আদালতের আদেশ থাকা সত্তে¡ও নদী ও ভ‚মিখেকোদের কবল থেকে নদী ও খালগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভ‚মিতে সীমানা পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় এক হাজার সীমানা পিলার, ছয়টি জেটি এবং সাড়ে তিন কিলোমিটার নদী তীররক্ষার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় চার হাজার সীমানা পিলারের ভিত্তিস্থাপন করা হয়েছে।

জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার ইনকিলাবকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন আইন ২০১৩ সংশোধনীর জন্য গত আট মাস ধরে কাজ করছে। তিনি বলেন, সংশোধনীতে আমরা দখলদার ও দূষণকারীকে দখল ও দূষণকারীকে অপরাধমূলক অপরাধ হিসাবে গণ্য করার বিরুদ্ধে বেশি শাস্তির বিধান রাখব।

রাজধানী ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর অবস্থাও খুবই খারাপ। নদীখেকোদের কারণে দেশের মানচিত্র থেকে নদ-নদীগুলো হারাতে বসেছে। দখল করে ভরাটের কারণে পানি প্রবাহ কমে গেছে। নদীগুলোতে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অনেক চর। নদীর নাব্য হারানোর ফলে দূষণের মাত্রাও বেড়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে প্রতিলিটারে দশমিক ৪৭ মিলিগ্রাম। নদীর পানিতে কোথাও কোথায়ও অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। নদী দখলের কারণে দেশের ছোট-বড় ২৩০টি নদীর মধ্যে ১৫০টি নদীই মৃতপ্রায়।

এ ছাড়া প্রতি বছরই দুই একটি করে নদী মরে যাচ্ছে বা শুকিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলো শুকিয়ে যাবার কারণে তার প্রভাব হাওড় বিলেও পড়ছে। যার ফলে বর্ষার সময়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাশাপশি নদী ভাঙনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। অন্যদিকে নদ-নদী ও মিঠা পানির প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নদী দখলের নেতিবাচক প্রভাব প্রাণিকুলেও পড়েছে। নদী শুকিয়ে যাবার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে। সুন্দরবনেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ মূল্যবান সম্পদ ধ্বংসের সম্মুখীন। একই সঙ্গে অনেক পাখি, বন্যপ্রাণী, বনজ উদ্ভিদ ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতিও বিলুপ্তির পথে। সবকিছুর ওপরই প্রভাব পড়েছে নদী দখলের কারণে।

পরিবেশ বিষয়ে আইনজীবীরা বলেছেন, গত এক বছরে দেশের নদী দখল ও দূষণ থেকে রক্ষার জন্য জারি করা হাইকোর্টের নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং এজেন্সিগুলি অবহেলিত রয়ে গেছে। বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় এবং এজেন্সিগুলো ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি দেয়া হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীগুলোকে বাঁচানোর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কিন্ত বিআইডবিøউটিএ অর্থের স্বার্থে নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকার মানুষ যে পানি পান করে ও গৃহস্থলি কাজে ব্যবহার করছেন সেটা আসে সায়েদাবাদ প্লান্ট থেকে। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে পানি নিয়ে আসা হয় ঐ প্লান্টে। কিন্তু বুড়িগঙ্গায় ধাতব জাতীয় পদার্থ ক্রোমিয়ামসহ অন্যান্য পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধির কারণে সায়েদাবাদ প্লান্টের মাধ্যমে পানি সস্পূর্ণ পরিশোধন করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে ঐ পানিই পান করা হচ্ছে এবং নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রাজধানীতে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়ছে। রাজধানীর ভেতর ও বাইরে ছোট-বড় ১৮টি নদী রয়েছে। আর ঢাকার অভ্যন্তরেই রয়েছে ৪৩টি খাল। কিন্ত বর্তমানে সবই এখন বিলীন। এখনও চোখে পড়ে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদী। তাদের অস্তিত্বও আজ বিপন্ন। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সেখানে কোন মাছ বাঁচতে পারে না। নদীর পচা দুর্গন্ধ পানিতে নৌকা লঞ্চ চলাচল করছে। যাত্রীদের মুখে রুমাল দিয়েই এই পানিপথে চলাচল করতে হয়।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ ইনকিলাবকে বলেন, নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ। সংবিধানে এবং আলাদা আইনে খাল নদী পুকুর ডোবানালা ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীদের কারণে ভরাট অব্যাহত রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ আইনগুলো অমান্য করে প্রজেক্ট গ্রহণ করা হচ্ছে। যদিও আদালত প্রায় ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিকারমূলক আদেশ দিচ্ছেন। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বেগ পেতে হয়। তিনি বলেন, চার নদী রক্ষার ব্যাপারে অনেক সময় পদক্ষেপ নিয়েছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে।

ঢাকার চার নদী রক্ষার জন্য ২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট রায় প্রদান করে। এরপর হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করলে ২০১০ সালের ৩ মে আপীল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আবেদনের নিষ্পত্তি করে দেন। হাইকোর্ট সে সময় চার নদী রক্ষায় ১২ দফা দিকনির্দেশনা দেয়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ঢাকা জেলার বিভিন্ন অংশ দিয়ে অবশেষে নারায়ণগঞ্জের কাছে ধলেশ্বরী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন বুড়িগঙ্গার উৎস যমুনা নদী। অন্যদিকে তুরাগ নদী গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার বংশী ভাওয়াল গড়ের পাহাড়ীয়া এলাকা থেকে উৎপন্ন হয়ে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদী নরসিংদী জেলা ও বালু নদী গাজীপুর জেলার টঙ্গী খাল থেকে উৎপন্ন হয়ে শীতলক্ষ্যায় মিলিত হয়েছে।

নদী বাঁচাতে বেসরকারী কিছু সংগঠন কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি), পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ (পবা) অন্যান্য সংগঠন। তারা নদী দখল দূষণের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। রিটের কারণে আদালত বেশ কিছু আদেশও দিয়েছে। দেশের অধিকাংশ নদীর নাব্য হারিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় নদীর চিহ্নও নেই। নদীগুলোকে রক্ষার জন্য দেশের হাইকোর্ট এগিয়ে এসেছে। নদী রক্ষায় তারা আদেশ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতাশালীদের কারণে কিছুই করা হচ্ছে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নদী প্রধান দেশ আমাদের বাংলাদেশ। এদেশের নদী খাতের দুর্বাবস্থা নজিরবিহীন। নদীর নাব্যতা রক্ষাই বর্তমানে প্রধান হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রভাব পড়েছে প্রাণীকুলে। এরই মধ্যে ১৮ প্রজাতির প্রাণী হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সাম্বার হরিণ, বন মহিষ, গয়াল, নীল গাই, হায়েনা, হপ ডিয়ার, মার্বেল বিড়াল, গোল্ডেন বিড়াল, গোলাপী মাথার হাঁস, ময়ুর, বেঙ্গল ফ্লোরিকান, বড় মদন টাকসহ রাজ শকুন। এছাড়া ভাতে মাছে বাঙালি বাস্তবে এ প্রবাদের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নদী খাল দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে দেশের প্রায় ৬৫ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদের অভিযান পুরোদমে চলছে। আগামীতে চলবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাইকোর্ট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ