Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সুযোগ

করোনায় আক্রান্ত ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়ার গার্মেন্টস শিল্প

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের নাম। চীনের সীমান্ত ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ও চীনের বাইরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মানুষের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হবার হারই যে শুধু বাড়ছে তাই নয়, এর অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে। করোনার প্রভাবে তৈরী পোশাক রফতানির বিশ্ববাজারে অপ্রতিদ্ব›দ্বী চীন রফতানিবাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। আশার খবর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী ভিয়েতনাম এবং ঘাড়ে নিঃশ্বাস নেওয়া কম্বোডিয়ায় করোনাভাইরাসের প্রভাব। চীনের উপর নির্ভরশীল দেশ দুটি বড় ধরণের ঝুঁকিতে আছে। আর তাই চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার হারানো বাজার দখলে বাংলাদেশের সুযোগ থাকছে। এদিকে দেশে এখনো কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি। তবে এ রোগ মোকাবেলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিভিন্ন খাতে আমদানি-রপ্তানি ক্ষতি শঙ্কার মধ্যেও থাকলেও অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, এই পরিস্থিতির পুরোটাই বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক নয়। পাশাপাশি গার্মেন্টসখাতে বাংলাদেশের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই গার্মেন্টসখাতে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার বাজার দখল করার সুযোগ থাকছে বাংলাদেশের জন্য। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্পে। কারণ এই শিল্পের অধিকাংশই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আব্দুল কাদের খান ইনকিলাবকে বলেন, কাঁচামালের কিছু অংশ চীন থেকে আমদানি করতে হয়। বাকীটা দেশেই উৎপাদন করা হয়। তবে গার্মেন্টসখাতে আমাদের মূল প্রতিদ্ব›দ্বী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় করোনার প্রভাব দিন দিন বাড়ায় রপ্তানি বাজারে আমাদের গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্পের সুযোগ বাড়বে। যদিও বিষযটি বায়ারদের উপর নির্ভর করবে। তবে আমরা আশাবাদী। একই সঙ্গে প্রতিদিনই রপ্তানিমুখী এক্সেসরিজ শক্তিশালী হচ্ছে। দেশের রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে।

সূত্র মতে, বর্তমানে গার্মেন্টস সেক্টরের এক্সেসরিজের ৯৫ ভাগেরও বেশি ধরনের পণ্য দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। তৈরী পোশাক খাতের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ পূরণ করছে এসব শিল্প। আর এসব পণ্য সরাসরি বিভিন্ন দেশেও রফতানি হচ্ছে। রফতানির জন্য তৈরী পোশাক শিল্পের প্যাকেজিং হচ্ছে দেশেই। তৈরী পোশাক খাতের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর সংশ্লিষ্ট গাম, টেপ, কার্টন, লেবেল, প্যাকেজিং ও প্রিন্টিং শিল্প ও বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৫শ’র অধিক গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসকল শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩০-এর অধিক রকমের এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্য উৎপাদন হয়। যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। ভিয়তনাম ও কম্বোডিয়ায় করোনার প্রভাব বাড়ায় এবং প্রায় ২০০ গার্মেন্টস বন্ধের পথে থাকায় এই শিল্প বাংলাদেশের জন্য আর্শীবাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

এছাড়া চীন থেকে পোশাক খাতের জন্য অন্য যে সব কাঁচামাল আমদানি হয় এ নিয়ে কিছুটা বিপাকে থাকলেও যে কাঁচামাল রয়েছে তা দিয়ে আরও কয়েক মাস চলবে বলে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং শিল্প মালিকদের সূত্রে জানা গেছে। একই সঙ্গে ইতোমধ্যে চীন থেকে কাঁচামালের শিপমেন্ট বাংলাদেশে পৌছার অপেক্ষায়। কিছু কাঁচামাল দু’একদিনের মধ্যে বাংলাদেশে পৌছবে। আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে আরও কিছু শিপমেন্ট বাংলাদেশে আসবে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া তাদের অধিকাংশ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজই চীন থেকে আমদানি করে। এক অর্থে চীনের উপর নির্ভরশীল। চীনে করোনার প্রভাব কমায় এবং ওই দেশ দুটিতে বাড়ায় চীনও চাইবে না কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বা ব্যবসা বাড়িয়ে নতুন করে আক্রান্ত হতে।

এদিকে কম্বোডিয়ার তৈরি পোশাক পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এতে ইইউর বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়বে বলে মনে করছেন কম্বোডিয়ার রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরাও মনে করছেন যে, এ ঘটনায় ইইউতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে।
সূত্র মতে, রফতানি বাণিজ্যে ৮৮ শতাংশ অবদান রাখা তৈরী পোশাক শিল্প একসময়ে পুরোপুরি বিদেশনির্ভর ছিল। সব কাঁচামালই আসত বিদেশ থেকে। দেশে কেবল সেলাই হতো। আবার চলে যেত বিদেশে। এতে করে মূল্য সংযোজন হতো খুব সামান্যই। বাংলাদেশ কেবল সস্তা শ্রমজনিত সুবিধাটাই পেত। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে এসে দেশে তৈরী পোশাকের পশ্চাৎশিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় সরকার। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প প্রতিষ্ঠায় দেশী উদোক্তাদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হয়। ফেব্রিক্স, এক্সেসরিজ, লেইস-ফিতা, প্যাকেজিং, প্লাস্টিকসহ নানামুখী পশ্চাৎশিল্প স¤প্রসারিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরী পোশাকের পশ্চাৎ শিল্পের বড় অংশ সরবরাহ করছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। গার্মেন্টস খাতে প্রায় এক কোটি লোক সরাসরি কাজ করছে। এর মধ্যে আবার ৭৫ ভাগ নারী শ্রমিক। বাংলাদেশ তৈরী পোশাক খাতে বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় করে থাকে। এর মধ্যে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ খাতের অবদান সাড়ে ৬ ভাগ।

গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যগুলো হলো- পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, ইলাস্টিক, বাটন, বাটন ট্যাগ, কলার স্ট্যান্ড, বাটারফ্লাই, লেবেল, করোগেটেড কার্টন, জিপার, হ্যাংটেগ, ব্যাক বোর্ড, নেক বোর্ড, সুইং থ্রেড, প্রাইস ট্যাগ, ফটোবোর্ড, গামটেপ, টিস্যু, ট্যুইল টেপ, এমব্রয়ডারি, প্যাডিং, কুইলটিং প্রভৃতি। এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ।
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে তার আলোকে বিজিএমইএ ২০২১ সালে তৈরী পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যের রফতানির লক্ষ্যমাত্রাও ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হবে। এ জন্য সরকারের নীতিগত সহায়তার কোনো বিকল্প নেই।

বিজিএপিএমইএ সভাপতি আব্দুল কাদের খান বলেন, আমাদের মজুদ কাঁচামাল যা আছে তা দিয়ে আরও কয়েকমাস চলবে। তবে চীন থেকে কিছু কাঁচামাল, মেশিন ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয়। ইতোমধ্যে শিপমেন্ট শুরু হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যে কিছু কাঁচামাল চলে আসবে। আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে আরও কিছু শিপমেন্ট হবে। তিনি বলেন, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ শিল্পে করোনার প্রভাব খুব একটা পড়বে না আশাকরি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা এগুচ্ছি, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার বাজার ধরার সুযোগ আমাদের থাকছে বলে উল্লেখ করেন আব্দুল কাদের খান।
সূত্র মতে, মধ্য চীনের উহান থেকে উদ্ভূত করোনভাইরাস থেকে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৩ হাজার ছাড়িয়েছে। চীনে বেশিরভাগ লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে বর্তমানে চীনে নতুন করে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও বিশ্বব্যাপি বাড়ছে। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন এ নিয়ে বলেছেন, কম্বোডিয়ার ৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্প মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ পোশাক খাতের ৬০ শতাংশ কাঁচামালের জন্য চীনের উপর নির্ভর করতে হয়। একই সঙ্গে করোনার প্রাদুর্ভাব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল শিল্পগুলিকে বিকল করে দিয়েছে এবং সীমান্ত বাণিজ্যকে জটিলতায় ফেলেছে। গত সপ্তাহে কম্বোডিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে, ১০ টি কারখানা তাদের উৎপাদন কমিয়েছে। ৩ হাজার শ্রমিককে কাজ থেকে বাদ দিয়েছে। চলতি মার্চ মাসে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চীন থেকে কাঁচামাল না আসায় প্রায় ২০০ কারখানা বন্ধের আশঙ্কা করেছে। এর মাধ্যমে ১ লাখ ৬০ হাজার কর্মী ছাটাই হতে পারে। যা কম্বোডিয়ার পোশাকখাতে কর্মরত ৭ লাখ শ্রমিকের ২০ শতাংশেরও বেশি। কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন বলেছেন, চীনকে জরুরি ভিত্তিতে গার্মেন্টস সামগ্রী পাঠাতে বলা হয়েছে, যাতে শ্রমিকদের ছাটাই করা না লাগে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কারখানাগুলিতে কাঁচামাল আসছেনা। তাই শ্রমিকরা তাদের কাজের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। গার্মেন্টস কর্পোরেশন ভিএনটেক্সের মহাপরিচালক লে তিয়েন ট্রুং রাষ্ট্রীয় বলেছেন, প্রতিবেশী ভিয়েতনামও যদি আরও দু’সপ্তাহের জন্য চীন থেকে আমাদনীকৃত কাঁচামাল সামগ্রী না পায় তবে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার লোকসান হবে। কম্বোডিয়ার মতো ভিয়েতনাম টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল অ্যাসোসিয়েশনের (ভিআইটিএএস) মতে, তাদের পোশাক উৎপাদনের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করতে হয়। এখন পর্যন্ত, ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ১ দশমিক ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ