Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিধি না থাকায় সুফল মেলেনি সাত বছরেও

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

আইন পাসের ৭ বছরেও সুফল মিলছে না ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইনের। বিধির অভাবেই আইনের সুফল মিলছে না বলে জানা গেছে। ফলে ‘কাজীর গরুতে পরিণত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং আইনজ্ঞরা বলছেন, বিধি প্রণয়ন হলে আইনটি নিয়ে ভুক্তভোগীরা নির্দ্বিধায় আদালতে যেতে পারবেন। কারণ, ইতিমধ্যেই আইনের আওতায় দায়েরকৃত মামলা নিয়ে আদালতে গিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু এ আইনের আওতায় তেমন কোনো সুবিধা মেলেনি। এ ছাড়া আইনটি নানাভাবেই ত্রæটিপূর্ণ। ফলে যে উদ্দেশ্যপূরণকল্পে আইনটির সৃষ্টি সেটিই ব্যহত হচ্ছে। তবে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুই বছর আগে বিধির খসড়া প্রণয়ন করা হয়। নানা জটিলতায় বিধিটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি।

আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন-২০১৩’। তবে বিধি প্রণীত না হওয়ায় এটির সুফল মিলছে না। গুরুত্বপূর্ণ আইনটিতে ‘পিতা’র সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘পিতা’ অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি সন্তানের জনক। ‘মাতা’র সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘মাতা’ এমন এক ব্যক্তি যিনি সন্তানের গর্ভধারিণী। ‘সন্তান’র সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘সন্তান’ অর্থ পিতার ঔরসে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেয়া সক্ষম ও সামর্থবান পুত্র বা কন্যা। আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিতে হইবে। ৩(৩) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, এই ধারার অধীন পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করিতে হইবে।

বিশ্লেষকদের মতে, আইনটির ধারাগুলো একেবারেই যৌক্তিক। সমকালীন সংকটের প্রতিকার রয়েছে আইনটিতে। পরিবার ও সমাজের উৎকট-বাস্তবতার নিরিখে প্রণীত হয়েছে এ আইন। কারণ, উচ্চ শিক্ষিত সন্তান দ্বারা বয়োবৃদ্ধ বাবা-মায়ের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। স্বচ্ছল, স্বাবলম্বী, সক্ষম সন্তানরাই করছেন পিতা-মাতাকে অবমাননা। নিভৃত গৃহকোণে কোন সন্তান দ্বারা কোন বাবা-মা কিভাবে নিগৃহ হচ্ছেন সেটির পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদান্যতায় দু’চারটি ঘটনাই কেবল আলোচনায় আসে। যা অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। ফ্যামিলি কাউন্সেলর ড. কামরুন মুস্তাফা বলেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক সংকট চলছে। পরিবারগুলো ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারই এখন বেশির ভাগ। ফলে পরিবারের সিনিয়র সিটিজেনরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ছেন। পরিবারগুলোতে বৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা-দাদীদের দুর্বিষহ জীবনের কথা আমরা মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি। তাদের সুরক্ষার কথা ভেবেই সরকার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন করেছেন। আইনটির সুফল পেতে অন্তরায়গুলো দূর করা জরুরি।

সমাজসেবা অধিদফতর সূত্র জানায়, শেষ বয়সে প্রবীণদের অসহায়ত্ব বিবেচনা করে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন ২০১৩ পাস করে সরকার। এ আইনে পিতা-মাতা, দাদা-দাদী এবং নানা-নানির ভরণ-পোষণ করা সন্তানের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। অন্যথায় তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। যদি কোনো প্রবীণ তার সন্তানদের বিরুদ্ধে ভরণ-পোষণ না করার অভিযোগ আনেন, সেটি প্রমাণিত হলে সন্তানদের ১ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ৩ মাসের কারাদনোডর বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়, কোনো সন্তান তার বাবা বা মাকে অথবা উভয়কে তার বা ক্ষেত্রমতো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। তা ছাড়া সন্তান তার মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। কোনো সন্তান স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে তারাও একই অপরাধে অপরাধী হবে। তারাও অভিন্ন শাস্তির মুখোমুখি হবে। এ আইনের মাধ্যমে বাবার অবর্তমানে দাদা-দাদী এবং মায়ের অবর্তমানে নানা-নানিরও ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ভরণ-পোষণ বলতে খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান করতে আইনে বলা হয়।

বিধির খসড়ায় পিতা-মাতার আচরণ কেমন হবে, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের আচরণ কেমন হবে সেটি উল্লেখ রয়েছে। ‘ভরণ-পোষণের ন্যূনতম মানদন্ডও বাতলে দেয়া হয়েছে। আইন ও বিধির ব্যত্যয় ঘটলে রয়েছে শাস্তির বিধানও।
বিধিমালা অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন কার্যকরে একটি কমিটি থাকছে। এ কমিটি বিধি দ্বারা পরিচালিত হবে। কমিটির সহ-সভাপতি হবেন সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকবেন সমাজসেবা অধিদফতরের মহা-পরিচালক। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত দু’জন নারী সংসদ সদস্য (একজন সরকার ও একজন বিরোধীদলীয়), জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, সমাজকল্যাণ সচিব, মহাপুলিশ পরিদর্শক বা তার মনোনীত অন্যূন উপ-পুলিশ পরিদর্শক পদ মর্যাদার কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র অর্থ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, শিক্ষা, তথ্য এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদ মর্যাদার কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা, এনজিও প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।
আইন বাস্তবায়নে গঠিত জাতীয় কমিটি পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিষয়ক কার্যক্রম তদারকি, সমন্বয় সাধন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবেন। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সরকারকে পরামর্শ দেবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত পরিচর্যা কেন্দ্র মনিটরিং করবেন। পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ বিষয়ক তহবিল, বাজেট প্রণয়ন পরিকল্পনা ও বার্ষিক ব্যয় বিবরণী অনুমোদন দেবেন। জাতীয় কমিটি ছাড়াও স্থানীয়ভাবে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের বিষয়গুলো তদারকির জন্য একইভাবে জেলা, উপজেলা এবং শহর কমিটি থাকছে। জেলা কমিটিতে জেলা প্রশাসক, উপজেলা কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং শহর কমিটিতে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতির দায়িত্বে থাকছেন।

পরিবেশ ও মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ইনকিলাবকে বলেন, আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়। এটি বাস্তবায়নেও সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। বিধি প্রণয়নের পর হয়তো মামলা হবে। এসব মামলা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হবে। আইন ও বিধির সুবিধা-অসুবিধাগুলো চিহ্নিত হবে। সেটি সংশোধনের মধ্য দিয়েই আইনটি কার্যকর আইনে পরিণত হতে পারে।

এদিকে ৭ বছর আগে আইন প্রণীত হলেও আইনের বিধি কবে গেজেটে আকারে প্রকাশিত হবে- নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ। প্রণীত আইনে বিধি প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। আইন হওয়ার চার বছর পর বিধি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে চিঠি দেয়া হয় সমাজ সেবা অধিদফতরে। ২০১৮ সালে মতামত গ্রহণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় খসড়া। অগ্রগতি জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও সংস্থা) শিবানী ভট্টাচার্য্য বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে বলেন, বিধিটির খসড়া হয়েছে আরো আগেই। এটি আইনমন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভে পাঠানো হয়েছিল। এটি আজই (বৃহস্পতিবার) হাতে পেয়েছি। আমরা এখন বিধির পরিচ্ছন্ন কপি লেজিসলেটিভ শাখায় পাঠব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইন

৭ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ