Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি

স্টালিন সরকার (তেঁতুলিয়া থেকে ফিরে) | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

সীমান্ত নদী মহানন্দার পাড়ে মধ্য ফাল্গুনের এক সন্ধ্যায় বসে রয়েছি। হঠাৎ পিছন থেকে চিৎকার; স্যার, পশ্চিম দিকে তাকান সাগরতীর কুয়াকাটার দৃশ্য। মুখ ফেরাতের চোখে পড়লো পশ্চিমে লাল সূর্য নদীর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কাঁটাতারে ঘেরা মহানন্দার পানিতে যেন কুয়াকাটার সাগরে সূর্য্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখলাম।

থালার মতো লাল সূর্য মহানন্দা নদীতে ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখছি; এমন সময় নদীর ওপার (ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার লালদাস পাড়া মসজিদ) থেকে কানে ভেসে আসছে ‘আল্লাহু আকবার.. আল্লাহু আকবার.....’ মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি। আযানের ধ্বনি শুনেই বিএসএফের সদস্যদের দেখা গেল ভারতীয় সীমান্তের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারগুলোতে বাতি জালাচ্ছেন। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। হিমালয়ের কোলঘেঁষা তেঁতুলিয়ায় মহানন্দা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন! রাতে আকাশের তারার মতো হিমালয় পাহাড়ে বিদ্যুৎ বাতির সারি! ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যখন কাঁপছে তেঁতুলিয়া, ঠিক তখনই হিমালয়ের কোলঘেঁষা জনপদটি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। সমতলে দিনভর ধানি জমিতে চা বাগান, বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর, পাথর ভাঙ্গা এবং নদীতে পাথর ছেঁকে তোলা, পশ্চিম দিনাজপুরের বাগডোগরা বিমান বন্দরে বিমান উঠানামার দৃশ্য এবং সীমান্তে বসবাসরত মানুষের যাপিত জীবনের বন্দিত্বের কাহিনী শুনে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে এসে বসেছি। হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে এলেন ইনকিলাবের তেঁতুলিয়া উপজেলা সংবাদদাতা মো. আবু তাহের আনছারী। প্রস্তাব, স্যার বিকেলে চলেন মহানন্দা নদী পাড়ে যাই। বিএসএফের যুদ্ধাবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য আর ভারতীয়দের যাতায়াত দেখবেন।

অনিচ্ছা সত্তে¡ও বাইকের পিছনে বসতে হলো। ২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। শীতকাল চলে গেলেও তেঁতুলিয়া থেকে শীত বিদায় নেয়নি। বিকেলে মহানন্দার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা গেল শ্রমিকরা নদী থেকে পাথর তুলছেন। চোখে পড়লো ভারতের শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি থেকে আনা পাথরের পাহাড়সম স্তুপ। চোখে পড়লো ওপারে শিলিগুড়ি ব্রিজ। সকালে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে মহানন্দা নদীর তীরে বসে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। হঠাৎ নদীতে পানির ঢেউ! স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক ও পাথর শ্রমিক রহিম উল্লাহ জানালেন, মহানন্দা নদীর উজানে রয়েছে ফুলবাড়ি বাঁধ। বৃস্টি হলেই বাঁধের কপাট খুলে পানি ছেড়ে দিলে ঘন্টার মধ্যে মহানন্দা ভরে যায়। তবে সে পানি বেশিক্ষণ থাকে না। বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট দেখে ফেরার পথে উপজেলার শালবাহান ইউনিয়ের রওশনপুরের সুনিবিড় পরিবেশে গড়ে উঠা মনোরম অবকাশ যাপন স্পটে দেখেছি পর্যটক ভিড়। দূর দূরান্ত থেকে এসেছেন তেঁতুলিয়ার ভারতীয় সীমান্ত দেখতে।

পৃথিবীকে লাল করে মহানন্দার পানিতে সূর্য তলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ওপার থেকে এক সঙ্গে কয়েকটি মাইকে ভেসে আসা আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনে সম্বিত ফেরে এলো। বাংলাদেশের ঝাড়য়া পাড়া গ্রামে মসজিদ আছে কিনা বোঝা গেল না। সীমান্তের ওপর থেকে ভেসে আসা আজান শুনেই নদী পাড়ের কয়েকজন নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিতে নদীর পানিতে উযু করতে নীচে নেমে গেলেন।

ভারতের গ্রামের মসজিদের মাইকে আযান শুনে বাংলাদেশের মানুষ নামাজ পড়েন (!) জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম মহানন্দা তীরের বাংলাদেশ অংশের ঝাড়য়াপাড়া গ্রামের চাষি আয়াত আলীর দিকে। তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে নদী তীরে এসেছেন। বললেন, এটা প্রতিদিনের দৃশ্য। নামাজের পাঁচ ওয়াক্তেই ভারতীয় সীমান্ত থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে, আমরা নামাজ পড়ি। ওদের (ভারত) মাইকের আওয়াজ বেশি হওয়ায় মূলত আযান স্পষ্ট শোনা যায়। মহানন্দা নদীর পাড়ে বাংলাদেশ অংশে ঝাড়য়াপাড়া গ্রামের বিপরীতে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার লালদাস পাড়া গ্রাম। ওই গ্রামেই ৪টি মসজিদ। ২০০৮ সালে কাঁটা তারের বেড়া দেয়ার আগে আমরা ওই গ্রামে যেতাম; ওদের মসজিদে নামাজও পড়েছি। মুসলমানদের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের বিদ্বেষ ছড়ানো এবং এনআরসি নিয়ে ভারতে তোলপাড় চললেও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জে মুসলমানরা বেশ প্রভাবশালী।

ভারতের লালদাস পাড়া গ্রামে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন ২০ বছর আগে সোমনাথ রায়। বাংলাবান্ধা গ্রামের সোমনাথ জানালেন, কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার আগে প্রায় প্রতিমাসে একবার মেয়েকে দেখতে ভারতে যেতাম। এখন দু’তিন বছরে দু’একবার পুজার সময় যাই। সোমনাথ রায় আরো বলেন, মোদি সরকার মুসলমানদের উপর জুলুম নির্যাতন চালালেও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা খুবই শক্তিশালী, কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ। পশ্চিম দিনাজপুরের অনেক গ্রামে স্থানীয় রাজনীতিতে হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানদের প্রভাব বেশি। পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর মসজিদ ও মাদরাসা রয়েছে; সেগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সহায়তা করেন।

তেঁতুলিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকরা জানালেন, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত মানুষের শতকরা ২৮ শতাংশ মুসলমান। রাজ্য রাজনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভ‚মিকা গুরুত্বপ‚র্ণ। মুসলমানদের সমর্থন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে ভোটযুদ্ধে জেতা কঠিন। জ্যোতি বসু-বুদ্ধদেব বসুদের বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল মুসলমানদের সমর্থন নিয়ে। বামফ্রন্টকে হটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই মুসলমানদের জন্য অনেক যুগান্তকারি পদক্ষেপ নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের রোজাদারদের জন্য রমজান মাসে অল্প পয়সায় ইফতারের পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে মসজিদে ইমামদের সরকারি ভাবে ভাতা দেয়া হয় না। অথচ পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বিশেষ সরকারি ভাতা দেয়া হয়।

বাংলাবান্ধা স্থল বন্দর চালু হওয়ার পর ব্যবসায়ীদের অনেকেই নিয়মিত ভারতে যাতায়াত করেন। তাদের একজন বাংলাবান্ধার আমদানী ও রফতানীকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স রুবি ট্রেডার্সের মালিক রওশন আলী। ভারতের মুসলমানদের যাপিত জীবন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আসামে নাগরিক পুঞ্জি, এবং মোদি সরকার সারা ভারতে এনআরসি করার ঘোষণা দিলেও স্থানীয় রাজনীতি এবং সামাজিক ভাবে মুসলমানরা খুবই শক্তিশালী। ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের মুসলমানদের স্থানীয় নেতারা সমীহ করতে চলতে বাধ্য হন। কারণ মুসলমান স¤প্রদায় ঐক্যবদ্ধ। পশ্চিম দিনাজপুরসহ পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান সমাজের মধ্যে কোনো স্তরভেদ বা বিভাজন নেই। হিন্দুদের মতো জাতপাতের বালাই নেই। মুসলমানরা সবাই মোটামুটি একভাবে চিন্তা করেন। মসজিদ কেন্দ্রীক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠায় মুসলমান সমাজের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন মসজিদের ইমামরা। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে মুসলমানরা তাঁদের মসজিদের ইমামের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে থাকেন। যে কারণে মুসলমানদের কিছু অংশ সুযোগ সুবিধায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও তাদের শক্তি বেশ প্রবল।



 

Show all comments
  • Juwel Khan ৬ মার্চ, ২০২০, ৩:১৫ এএম says : 0
    ভারত সরকারকে দয়া করে বলুন আমাদের সেই কাজটা এত কঠিন করে তুলবেন না।"
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Hameed ৬ মার্চ, ২০২০, ৩:৪৬ এএম says : 0
    সুন্দর একটা প্রতিবেদন। সীমান্ত এলাকার মানুষের প্রতিদিনের চিত্র ফুটে উঠেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • কে এম শাকীর ৬ মার্চ, ২০২০, ৩:৪৭ এএম says : 0
    সারা বিশ্বের যেখানেই মুসলিমরা থাকুক না কেন আজানের ধ্বনিই আমাদে র আশা-আকাঙ্খার প্রতীক।
    Total Reply(0) Reply
  • নাসিম ৬ মার্চ, ২০২০, ৩:৪৮ এএম says : 0
    নিউজটা পড়ে অনেক ভালো লাগলো। আমরা রেগুলার এই ধরনের লেখা দেখতে চাই
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফুল ইসলাম চঞ্চল ৬ মার্চ, ২০২০, ৩:৪৯ এএম says : 0
    এখানে সীমান্ত এলাকায় অন্য রকম একটা আবহ আছে, ওখানে না গেলে বোঝা যাবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Emam ৬ মার্চ, ২০২০, ১:২৬ পিএম says : 0
    আমি আপনাদের যাওয়ার কয়েকদিন আগে গেছি জায়গাটা খুবসুন্দর
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আজান

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ