দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
পূর্ব প্রকাশিতের পর
তা হলে শরীয়ত কি তাকে একজন মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেবে না? অবশ্যই দেবে; যদিও নামটি আরবী শব্দে হয়নি। এক্ষেত্রে বেশির চেয়ে বেশী শরীয়ত এ টুকু বলতে পারে যে, ‘আরবী ভাষায় হলে বা দাসত্ব প্রকাশ পায় এমন হলে বা আল্লাহ ও রাসূল স. এর নামের সঙ্গে মিল করে নাম রাখলে, অধিক ভালো হত!’ আর এটি সবাই জানেন যে, ‘ভালো’ বা ‘অধিক ভালো’ বিষয়গুলো আপেক্ষিক, যার কোন শেষ নেই। যে কারণে আইন এসবক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির সুযোগ দেয় না।
সুতরাং ‘ইনসিওরেন্স’ বা ‘তাকাফুল’ নামটির আড়ালের অর্থ যদি ভালো হয়, পারস্পারিক কল্যাণ সাধন যদি লক্ষ্য ও মূখ্য হয়, সঞ্চিত ও আহরিত অর্থ যদি শরীয়তের বৈধ ও হালাল ব্যবসায়-বাণিজ্যের পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করা হয়। যেমন মুদারাবা, মোরাবাহা, মুশারাকা ও বা‘য়ে সালাম ইত্যাদি এবং তা থেকে পূর্ব-স্থিরীকৃত কর্ম-কৌশল ও বৈধ শর্তাবলির আওতায় বিনিয়োগকারীদের একটা অংশ, যাতীয় খরচ বাবদ এটা অংশ এবং জুঁকি মোকাবেলায় একটা অংশ প্রদান করা হয়; তা তো শরীয়ত মোতাবেক হালাল না হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না!
আর যদি এমন হয় যে, ঝুঁকি মোকাবালায় শুরুতেই পূর্ব-শর্ত ও সম্মতি মোতাবেক প্রিমিয়ামের ৫% বা ২% হারে শেয়ারহোল্ডারগণ প্রদান করে থাকেন বা রাখা হয়; সেটি তো আরও উত্তম (যা কিনা আমাদের জানা মতে ফারইস্টসহ বিভিন্ন ইনসিওরেন্স কোম্পানী করে থাকে)। সুতরাং যারা মূল বিষয়টি কি? কি করা হয়? কিভাবে করা হয়? পন্থা-পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কেমন? -এসব ভালো করে না জেনে, না বুঝে শুধু ‘বিমল’, ‘নির্মল’ ও ‘বিপ্লব’ বা ‘ইনসিওরেন্স’ নাম দেখেই ‘হারাম’ বা ‘না-জায়েয’ বা ‘সুদী’ বলে ফেলেন কিংবা ‘ফাতওয়া’ দিয়ে বসেন; তাঁরা আর যাই হোন না কেন, একজন মুহাক্কিক আলেম বা মুফতী হতে পারেন না।
আর বিষয়টি যদি এমন হয় যে, নামে সেই সহীহ-সঠিক, শরীয়তসম্মত; কিন্তু কাজে-কর্মে, বোধ-বিশ্বাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন বা অসহনীয় মাত্রার ভিন্নতা রয়েছে; তা হলে নাম সহীহ হলেও, সেই নাম বা নামধারীদেরকে বা তাদের তেমন কর্মকান্ডকে বৈধ বলা হবে না, বলা যাবে না। যেমন কাদিয়ানীদের ‘ইসলাম’-কে বা তাদের নামায-রোযাকে বৈধতার সিদ্ধান্ত বা স্বীকৃতি প্রদান করা জায়েয হবে না।
ঠিক তেমনি কেবল নামে ইসলাম বা ইসলামী দেখে কিংবা মুদারাবা, মুশারাকা ইত্যাদি শর‘ঈ হালাল ব্যবসার টার্মগুলো যদি ফরমে, সাইনবোর্ডে থাকে অথচ বাস্তবে এগুলো অনুসরণ করা না হয় এবং তা তদারকি করার মত শরীয়তের ব্যবসায়-বাণিজ্য অধ্যায় ভালো বুঝেন এমন কোন আলেম বা শরী‘আ বোর্ড না থাকে; সেক্ষেত্রে নামে মুসলমান বা নামে ‘শরী‘আ ভিত্তিক পরিচালিত’ হওয়ারও কোন মূল্য নেই। তেমন কোন কোম্পানী বা অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানকে শরীয়তসম্মত বলা এবং তাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যকে হালাল বলা যাবে না।
তাকাফুল: ইসলামী ইনসিউরেন্স-৩
ইসলামী ইন্সুরেন্স: ইসলামী ইন্সুরেন্স কোম্পানী অনেকটা সমবায়ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার বা মালিক এবং পলিসি হোল্ডারগণ পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটির আয় এবং দায়-দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেন।
পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, দান-অনুদান অবশ্যই পুণ্যের কাজ। আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমরা চিনি বা না চিনি, জানি বা না জানি, যে কোন মানুষকেই সাহায্য করা যায়।
একশত বা পাঁচশত বা একহাজার লোকও যদি একত্র হয়ে প্রতিজ্ঞা করে যে, আমরা কারও বিপদ-আপদে সাহায্য করবো বা পরস্পরকে সাহায্য করবো এবং তার দুঃখ-যাতনায় বা অভাব দূরীকরনে আর্থিকভাবে এগিয়ে যাবো; তা কি ইসলাম বিরোধী হতে পারে?
একশত লোক যদি এমন হলফ করে যে, তারা সকলে একটা সাধারণ তহবিলে মাসে একশত টাকা হারে জমা করবে; আর সে টাকায় যা লাভ হয় তা পূর্ব- নির্ধারিত নীতিমালা ও শর্ত অনুযায়ী ভাগ করে নেবে -তা কি শরীয়ত বিরোধী হবে? যেখানে হাদীসে বলা হয়েছে- “মুসলমানরা তাদের পাস্পরিক শর্তানুযায়ী আমল করতে পারে”।
একশত লোক প্রতি মাসে ১০০/ টাকা হারে জমা করলে এক বছরে হবে ১,২০,০০০/ (এক লক্ষ বিশ হাজার) টাকা। এ থেকে দ্বিতীয় বছরে সম্ভাব্য নূন্যতম লাভ হবে ১২,০০০/ (বার হাজার) টাকা। এই একশত লোক যদি সম্মত হয়ে শর্ত করে যে, ‘আমরা এ বছর যদি আমাদের মধ্যে কেউ মারা যায়, তা হলে নিজেরা কোন লাভ না
নিয়ে, উক্ত এক লক্ষ বিশ হাজারের পুরো আয় ওই মৃত সদস্যের পরিবারকে সাহায্যার্থে তা দান করে দেব’। তা হলে সেটি কি ইসলাম বিরোধী হয়ে যাবে? না, কক্ষণও হবে না। আর এরই নাম হচ্ছে ইসলামী ইন্সুরেন্স।
যদিও আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি যে, দৈব দূর্বিপাক ও বিপদগ্রস্ত লোককে সাহায্যের শ্লোগান নিয়ে পাশ্চাত্যের লোকেরা এই ইন্সুরেন্স সিস্টেম চালু করেছে; তা প্রকৃত অর্থে বাস্তব নয়। বাস্তবে এটা হচ্ছে ইসলামের আদর্শ। ইসলাম এই আদর্শ মুসলিম উম্মাকে অনেক আগেই শিক্ষা দিয়েছে এবং মুসলমানরা তা হাজার বছর পূর্ব থেকেই লালন ও পালন করে আসছে। ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, এ টুকু বলা যায় যে, তার প্রাতিষ্ঠানিকরূপ প্রদানে অন্যরা অগ্রগামী হয়ে গেছে; যেখানে অগ্রগামী হওয়ার কথা ছিল আমাদের, মুসলমানদের।
তাকাফুল: ইসলামী ইনসিউরেন্স-৪
ইনসিওরেন্স কি বিদ‘আত?
ইসলাম ও শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে আমাদের প্রয়োজনীয় ও কারও কারও নূন্যতম জ্ঞান না থাকাতে অনেক ক্ষেত্রে আমরা প্রশ্ন ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি। উদাহরণত, শরীয়তের বিধি-বিধান ইবাদাত, মো‘আমালাত, মো‘আশারাত, ইকতেসাদিয়াত, সিয়াসিয়াত (ইবাদত, লেনদেন, সামাজিকতা, অর্থনীতি ও রাজনীতি) ইত্যাদির ক্ষেত্রে ‘বিদ‘আত’ এর প্রসঙ্গ বা তেমন প্রশ্ন কেবল ‘ইবাদত’ এর বিষয়ে প্রযোজ্য; অন্যান্য বিষয়ে তেমন প্রশ্ন প্রযোজ্যই হয় না। কেননা বিদ‘আত এর সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘ইবাদত জ্ঞান করে বা ইবাদত মনে করে’ কর্মটি সম্পাদন করা। অথচ ব্যবসায়-বাণিজ্য ইত্যাদি মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই কর থাকে। এতে কারও ‘ইবাদত করছি’ এমন লক্ষ্য ও মানসিকতা আদৌ কাজ করে না। সুতরাং এ বিষয়ে এমন প্রশ্ন করা যে, ‘তা কি বিদ‘আত নয়’ -সম্পূর্ণ অবান্তর ও অর্থহীন।
এটা একটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, একজন মুমিন-মুসলমানকে তার নেক নিয়ত ও কল্যাণ চিন্তার দরুন ‘নিয়তকেন্দ্রিক’ একটা পৃথক সওয়াব প্রদান করা হয়; হোক তা মল-মূত্র ত্যাগ, আহার-বিহার, ব্যবসায়-বাণিজ্য বা জাগতিক যে কোন কাজ এবং হোক না তা মৌল বিবেচনায় ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত।
তাকাফুল: ইসলামী ইনসিউরেন্স-৫
ইসলামী ইনসুরেন্স ও জুয়ার প্রশ্ন: শরী‘আভিত্তিক ইসলামী ইন্সুরেন্স প্রক্রিয়া-পদ্ধতি যারা অবলম্বন করেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে জুয়া ও লটারী ইত্যাদির তো প্রশ্নই আসে না এবং তার কোন প্রয়োজনও পড়ে না। এমনটি প্রশ্ন আসতে পারে, হয়তো সুদী কার্যক্রম দ্বারা পরিচালিত ইন্সুরেন্স কোম্পানীর ক্ষেত্রে। ইসলামী ইন্সুরেন্সগুলোতে বীমা’র দাবী পরিশোধে দু’টি প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়ে থাকে বা হতে পারে। যার একটির কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, অর্থাৎ সাধারণত এমন প্রয়োজনে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্দোক্তারা একটা তহবিল ‘তাবাররু‘ নামে পৃথক গঠন করে রাখেন এবং মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোতাবেক পূর্ব-সম্মতি ও শর্ত মোতাবেক প্রত্যেক সদস্য ও শেয়ারহোল্ডার নিজ নিজ প্রিমিয়াম বা কিস্তি হিসাবে যে টাকার অংক জমা করেন, তার উদাহরণত ৫% ওই ‘তাবাররু‘ ফান্ডে চলে যায়। অবশিষ্ট মূল টাকা এবং এই ছোট অংক সবই ব্যবসায়-বিনিয়োগে লেগে থাকে। উভয় ফান্ডের বিনিয়োগ থেকেই মুনাফা আসে। তবে এরই মধ্যে যদি কোন সদস্য মারা যান বা দূর্ঘটনা কবলিত হন; তা হলে সেক্ষেত্রে এই তাবাররু‘ ফান্ড হতে সংশ্লিষ্ট বিপদগ্রস্তের বীমার দাবী সহজেই পরিশোধ করে দেয়া যায়। এখানে লটারীরও কোন সুযোগ ও প্রয়োজন নেই এবং জুয়াবাজিরও প্রশ্নই উঠে না। আমাদের সমস্যা হল, আমরা পুরোপুরি না বুঝে
ও না জেনে অথবা অবাস্তব শোনা কথায় বিশ্বাস করে, প্রশ্ন করে থাকি কিংবা অপপ্রচারে জড়িয়ে পড়ি। অথচ পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা হল -“যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না; কর্ণ, চক্ষু, হৃদয়-তার প্রত্যেকটির সম্পর্কেই কৈফিয়ত তলব করা হবে” (বনী ইসরাঈল: আয়াত নং-৩৬)।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘সহজেই বীমা’র দাবী শোধ’ করা য়ায কিভাবে? এক সঙ্গে পাঁচ লক্ষ, বিশ লক্ষ বা আরো বড় অঙ্কের ক্ষেত্রে তা কিভাবে সম্ভব? ছোট একটা অঙ্কের প্রিমিয়াম জমা করে, অল্প কিছুদিন পর মৃত্যুতে একটা বিরাট অঙ্ক প্রাপ্তিতে লটারী বা জুয়ার সাদৃশ্য -এর প্রশ্ন উঠছে না? তার জবাব হল, প্রতিষ্ঠত বড় বড় কোম্পানীগুলোর শেয়ার হোল্ডারদের মাসিক/ত্রৈমাসিক/সাম্মাষিক/বাৎসররিক প্রদেয় কিস্তি যা-ই হোক, গড়ে প্রতি মাসে হাজার হাজার সদস্যের যে প্রিমিয়ামগুলো জমা পড়ে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই একটা বড় অঙ্ক জমা হয়ে থাকে। যার ৫% হারে বিপদগ্রস্ত সদস্যের সাহায্যার্থে পূর্ব-সম্মতি ও শর্ত মোতাবেক ‘তাবাররু‘ ফান্ডে জমা হল; সেখানেও একটা বড় অঙ্ক হয়ে যাচ্ছে, অথচ প্রতি মাসে হাজার হাজার সদস্য বিপদগ্রস্ত বা মারা যাচ্ছেন না। মাসে বা ছয় মাসে একজন সদস্য মারা গেলে তার বীমার দাবীর বড় একটা অঙ্ক শোধ করা মোটেও কঠিন হয় না। কেননা, সংশ্লিষ্ট জড়িত অভিজ্ঞজনদের ভাষ্য মতে, এ ক্ষেত্রে এসব ঝুঁকি বা বীমার দাবী পরিশোধ করতে গিয়ে মূল প্রিমিয়ামে হাত দেয়ার প্রয়োজনই পড়ে না; কেবল তাবাররু‘ তহবিল থেকে শোধ করে, তাতেও বড় মাপের তহবিল অবশিষ্ট থেকে যায়। সুতরাং যেখানে ‘জুয়া’র অস্তিত্বই নেই সেখানে জুয়া বা জুয়া’র সাদৃশ্য খোঁজা বা তেমন কাল্পনিক চিন্তা বা যোগ-বিয়োগ সাজিয়ে ইসলামী ইন্সুরেন্সগুলোকেও সুদী বীমার কাতারে ফেলে, চোখ বন্ধ করে ফাতওয়াদানের অধিকার ইসলামী শরীয়ত কাউকে প্রদান করেনি। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।