Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

শিশুশ্রম বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি


সুমন (১৩/১৪) লেগুনার পেছনে এক হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে অন্য হাতে পাশে বা উপড়ে থাপ্পর দিয়ে চলার বা থামার সংকেত দিচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়েই আবার যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াও আদায় করছে। ক্ষুদে এই কন্ডাক্টর ঢাকা মহানগরীর সিপাইবাগ-গোড়ান থেকে গুলিস্তান রুটে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এমন অনেক শিশু শ্রমিককে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে দেখা মেলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি নগরীতে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দিন দিন অব্যাহতভাবে শিশুশ্রম বেড়েই চলছে। দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায়ই এখনও বেআইনিভাবে শিশুদের নিয়োগ দেয়া হয়। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। শিশুরা শ্রমের হাতিয়ার নয়, জাতির ভবিষ্যৎ/শিশুদের হাতে ভিক্ষার থলে নয়, চাই বই ও কলম। এ কথাগুলো আজ শুধুই বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ। তারা আজ বিভিন্ন কাজে শ্রম বিক্রি করেও প্রকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত। শিশুদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। অল্প বয়সেই অভাব-অনটনে বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। যে বয়সে তাদের স্কুলে গিয়ে হাসি-আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা সে বয়স থেকে ধরতে হচ্ছে অভাবী সংসারের হাল।
বর্তমানে রাস্তা-ঘাটে, অলি-গলিতে শিশুদের ভারি কাজ করতে দেখা যায়। ইটের ভাটায় ইট নামানো, বাস-লেগুনায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অল্প বয়সেই শিশুরা হেল্পারি করছে। গাড়িতে-লঞ্চে পণ্য উঠানো-নামানোর কাজও করছে শিশুরা। মাঝারি ভারি কারখানার মেশিনে কিংবা ওয়ার্কশপে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে শিশু শ্রমিকদের দেখা যায়। বিড়ি ফ্যাক্টরির বিষাক্ত তামাক পাতার মধ্যেও কাজ করছে শিশুরা। বানাচ্ছে বিড়ি। এ কারণে শিশুদের দৈহিক গঠনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। কাজের লোক হিসেবে শিশুদের দিয়ে ভারি কাজ করানো হচ্ছে। অনেক বাবা-মা শিশুদের অর্থ উপার্জনের তাগিদে অন্যের বাসায় কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে চলে শিশুদের ওপর শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। কাজে একটু ত্রæটি হলেই শিশুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
শিশুশ্রম বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। শ্রম ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু শ্রম শাখার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলায় ‘শিশু শ্রম পরীবীক্ষণ কমিটি’ থাকবে। এই কমিটির উপদেষ্টা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সভাপতি জেলা প্রশাসক। কমিটি জেলার শিশু শ্রম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। বাংলাদেশ শ্রম আইনেও শিশু শ্রম বন্ধে আইন রয়েছে। শ্রম আদালতের আইনে অপরাধীদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ ও অর্থদÐের বিধান আছে। তবে এসব কিছুই বইয়ের পাতায়, বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই।
দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এক জরিপে বলা হয়েছে, শিশু শ্রমিকের ৯০ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। ৪৭ ধরনের কাজ করে শিশু শ্রমিক। যে কাজের অনেকগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। সমাজ বিজ্ঞানিদের মতে, দরিদ্রতা, পারিবারিক বিচ্ছেদ, স্থায়ী বিচ্ছেদ, পিতা-মাতার পেশা, অভিভাবকের মৃত্যু, অনাকর্ষণীয় শিক্ষাসহ ২৫টিরও বেশি কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। মাত্র ১০ শতাংশ শিশু শ্রমিক কাজ করছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। খুবই কম মজুরিতে নিয়োগ দেয়া হয় শিশুদের। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু।
বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ড. মো জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দরিদ্রতা এবং পারিবারিক বিচ্ছেদের কারণে দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক শিশু শ্রমিক বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে করতে এক সময় ওরা মাদক এবং অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে শিশু শ্রমিকদের যথাযধ পরিচর্চার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় অথবা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের যথাযথ পরিচর্চার মাধ্যমে যদি কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতো তাহলে ওরা দেশের মানব সম্পদে পরিণত হতো।
দেশে দারিদ্র্র্যের হার কমছে। তবে দারিদ্র্যের এই হার কমানোর ক্ষেত্রে শিশু শ্রমে রোজগারও ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে মহানগরী, বড় নগর ও শহরে যে বস্তি গড়ে উঠছে সেখানকার শিশুদের বড় একটি অংশ নিয়োজিত হয় নানা শ্রমে। শহর ও নগরীর পথশিশুরা দোকান এবং কোন প্রতিষ্ঠানের ফুট ফরমায়েশ খাটাসহ নানা ধরনের কাজ করে। কোনো শিশু আবর্জনার ভেতর থেকে রিসাইক্লিংয়ের জিনিসপত্র কুড়িয়ে মহাজনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। এদের নেই স্বাস্থ্য সচেতনা। গ্রামে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুকে পরিবারের আয় বাড়াতে রোজগারের পথে নামতে হয়। কৃষির নানা কাজে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশুদের কাজ করতে হয়। এতে কামলা কিষাণের খরচ অনেকটা বেঁচে যায়।
কৃষির শিশু শ্রমিকের একটি অংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী অতিক্রমের পর মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করতে পারে না। বেছে নিতে হয় কোনো না কোনো কাজ। মেয়ে শিশুরা প্রাথমিক পাঠ শেষ করে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশের পর অনেককেই মাধ্যমিক পরীক্ষা উত্তীর্ণ হওয়ার আগে ও পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। যদিও বালিকাদের বধূ হওয়ার (বাল্য বিয়ে) হার কমে আসছে, তবে এখনও শূন্যের কোটায় যায়নি। এই মেয়ে শিশুদেরও ঘর গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে কৃষির কঠিন কাজ করতে হয়।
এক জরিপে বলা হয়েছেÑ শিশু শ্রমিকের ৬৬ শতাংশ কৃষিতে, ১৮ শতাংশ শিল্প খাতে, ৪ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১২ শতাংশ গৃহভৃত্য ও অন্যান্য খাতে নিয়োজিত। পরিবেশ ও জীবন বিপন্নের অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে শিশু। বিশেষ করে বিড়ি ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের বড় একটি অংশ নারী ও শিশু। এই শিশুদের বেশিরভাগই অল্প বয়সে কঠিন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আয়ুষ্কাল কমে যায়। ব্যাধির কারণে শারীরিক গঠনেও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। এদের কেউ বিকলাঙ্গ হয়।
দেশের ৯০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তবে মাধ্যমিকের আগেই ঝরে পড়ে প্রায় অর্ধেক। এই শিশু শ্রমিকদের একটি অংশকে কাজে লাগায় অপরাধী চক্র। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ মাদককারবারিরা অনেক সময় মাদক বিক্রিতে বা বহনের কাজে শিশুদের ব্যবহার করে। ধরা পড়ার পর প্রকৃত অপরাধীর নাম বলতে পারে না। সংশোধনাগারে পাঠাবার পর এদের একটি অংশ ভাল হয়। এই হার কম। বেশিরভাগ পুনরায় অপরাধে ফিরে যায়। শেষ পরিচিতি হয় কিশোর অপরাধী। সেখান থেকে অপরাধীদের সহযোগী।
দেশের শ্রম আইনে বলা আছে, কোন প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে। কোনো অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে। এই কাজে কোনভাবেই শিশু নিয়োগ করা যাবে না। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনো কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না।
তবে এর মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের স্বার্থে শিশু শ্রমিক নিয়োগে ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। শ্রম আইনে একটি ধারায় বলা হয়েছে, বারো বছরের কোনো শিশুকে এমন কিছু হালকা কাজে নিয়োগ করা যাবে যাতে শিশুস্বাস্থ্য ও উন্নতির জন্য বিপজ্জনক নয় এবং শিক্ষা গ্রহণ বিঘিœত হবে না। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, মাঠ পর্যায়ে এই ধারাকে কাজে লাগিয়ে ভিন্ন খাতে শিশু শ্রমিককে কাজে নেয়া হচ্ছে।

 



 

Show all comments
  • ** হতদরিদ্র দীনমজুর কহে ** ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১০:০১ এএম says : 0
    হায়রে নিয়তী!যে বয়সে বইবগলে পাঠশালায় যাবে নাডাই হাতে ঘুড্ডি উড়াবে ব্যাট হাতে মাঠ চষে বেড়াবে।সেই বয়সে কমল নরম হাতে শক্ত ইটপাথর ভাংগে কেন?টুকরী ভর্তি ইট খোয়া বালু মাথায় বোঝা বহন করে কেন?এর অবসন কি হবেনা কোন দিন??
    Total Reply(0) Reply
  • ** হতদরিদ্র দীনমজুর কহে ** ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১০:৩৬ এএম says : 0
    মানুষে মানুষে এতো বৈসম্য কেনো?রাষ্টতো পাচঁটি মৌলিক চাহিদা পুরন করবে বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।কিন্তু এদের মৌলিক চাহিদা কোথায়?লিখককে ধন্যবাদ।এইসব ভাগ্যবিরাম্বিত অধিকার বন্চিত মানুষের কথা লিখুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমিক

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ