Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চীন-সম্পৃক্ত প্রকল্প বহরে ধাক্কা

করোনাভাইরাসের সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

চীনে ভয়াবহ মহামারীর রূপ নেয়া করোনাভাইরাসের সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাবের মুখোমুখি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনীতির বড় অংশ। দেশে চলমান চীনের সম্পৃক্ত প্রকল্পবহরে পড়েছে ধাক্কা। চীনা বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তায় এসব প্রকল্প, গুচ্ছপ্রকল্প ও মেগাপ্রকল্পের বেশিরভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আরও অনেক প্রকল্প গ্রহণ চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে অথবা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় চীনে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস যেন দেশের অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগের সুদিন-সম্ভাবনার উপর বিনামেঘে বজ্রপাত।

চীনের বিপর্যস্ত পরিস্থিতির কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলমান জ্বালানি খাত, বিনিয়োগ-শিল্পায়ন বাস্তবায়ন, শিল্প-কারখানা স্থাপন, যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের যাবতীয় কর্মকান্ড পিছিয়ে যাবে। বেড়ে যাবে মেগাপ্রকল্প ও প্রকল্পবহরের ব্যয় এবং সময়সীমা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অনিশ্চিত হয়েও পড়তে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে গার্মেন্টসহ শিল্পের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজসহ শিল্প-কারখানা ও অবকাঠামোর যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে নিত্য-ভোগ্য পণ্যসামগ্রী সময়মতো পৌঁছা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। চরম দুশ্চিন্তা ভর করেছে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তা মহলে।

বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন ও চলমান মেগাপ্রকল্প, প্রকল্পবহরের মধ্যে রয়েছে- কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল, কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মাণাধীন জ্বালানি খাতের মেগাপ্রকল্প, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেললাইন মেগাপ্রকল্প, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, আনোয়ারায় বিশেষায়িত চীনা অর্থনৈতিক জোন ইত্যাদি। বাংলাদেশে বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলোতে কর্মরত এবং বিভিন্নভাবে যুক্ত এক হাজারেরও বেশি চীনা প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান, কর্মী। তাদের মধ্যে যারা চাইনীজ নিউইয়ার উদযাপন উপলক্ষে আগেভাগে ছুটিতে চলে গেছেন এখন তারা আর আপাতত ফিরতে পারছেন না। আর যারা রয়ে গেছেন তারাও আটকে গেছেন। স্বদেশে পরিবার-পরিজনদের অবস্থা নিয়েও আছেন চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। যারা চীন থেকে ফিরছেন তাদেরকেও পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে।

বাংলাদেশে চীনসম্পৃক্ত প্রকল্পবহরের ভাগ্য প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়েরর ইউজিসি অধ্যাপক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম গতকাল বুধবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। পূর্ব চায়নার অর্থনীতি থেমে গেছে। খুবই বিপজ্জনক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে জনগণের সুরক্ষায় পূর্ণ সাবধানতা জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন। কাজেই চীনের সম্পৃক্ত প্রকল্পের জন্য জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা শিথিল করা যাবে না।

ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যেক্তাগণ জানান, চীনা আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বর্তমানে বাংলাদেশে এক ডজনেরও বেশি মেগাপ্রকল্প বা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এতে চীনের বিনেয়োগ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। গতবছর জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্যদিয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। আগামী ২০২১ সালে চীন বাংলাদেশে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল।
গতবছর চীন থেকে এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়। এর বড় অংশই শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। আগামী ৮ ফেব্রুযারির মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশের বিভিন্ন চলমান প্রকল্পের যন্ত্রপাতি বোঝাই ৫টি জাহাজ আসার সিডিউল রয়েছে। পরের দুই সপ্তাহে আসার কথা আরও তিনটি জাহাজ। আগের শিপমেন্ট করা মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে যথারীতি এসে পৌঁছাবে। তবে ২৫ থেকে ৩১ জানুয়ারি চাইনিজ নিউইয়ার এবং ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চীনের অনেক কল-কারখানায় ছুটির থাকার সঙ্গে ভয়াল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মুখে দেশে শিল্পপণ্য, কাঁচামাল ও নিত্যপণ্য আমদানিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। এতে করে নিত্য ও ভোগ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে।

মহেশখালীর কালামারছড়া সোনারপাড়ায় সিপিপি-চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) এবং ডাবল পাইপলাইন নির্মাণের কাজ করছে। প্রকল্পের সাথে শতাধিক প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান ও কর্মী জড়িত। তাদের অনেকেই চীনা জাতীয় ছুটিতে স্বদেশে গিয়ে ফেরা অনিশ্চিত। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ২০২১ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেল বঙ্গবন্ধু টানেলের মূল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। প্রকল্পের নির্মাণকাজে অর্ধেক অগ্রগতি হয়েছে। এই মেগাপ্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত শতাধিক চীনা প্রকৌশলী ও কারিগর। ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেগাপ্রকল্পে প্রকল্প-ঋণ বাবদ চায়না এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ধাক্কা পড়ছে এখানেও।

মীরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে চীনের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তায় জুঝাউ জিনইয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি লিমিটেডের কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। এ শিল্পনগরে উৎপাদনে যাচ্ছে প্রথম এ চীনা প্রতিষ্ঠান। । এ শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ৮০ কোটি ডলারেরও বেশি। কিন্তু চীনা কারখানাটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে না যেতেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার মুখে পড়লো।

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীরে সমুদ্র বন্দর এবং নির্মাণাধীন টানেল সুবিধা কাজে লাগিয়ে চীনের একক বিনিয়োগে অর্থনৈতিক ও শিল্পজোন স্থাপনের কাজ কিছুদূর এগিয়ে স্থবির হয়ে আছে। আনোয়ারায় ‘চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন’ নামে এই শিল্পাঞ্চলে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা। এতে সরকারের ৩০ শতাংশ এবং চীনা বিনিয়োগকারীদের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে। ৭৭৪ একর জমিতে এ প্রকল্প গড়ে উঠছে। চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এই মেগাপ্রকল্পের উন্নয়ন ও নির্মাণকাজে সম্পৃক্ত। ২০২০ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহে উৎপাদনের টার্গেট ছিল। এমনিতেই বাস্তবায়ন থমকে থাকা আনোয়ারা অর্থনৈতিক জোনটি করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে আরও অনিশ্চয়তায় পড়েলো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ