দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
“বিশ্ব রক্তদাতা দিবস”। “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা” (ওয়ার্ল্ড হেলথ্ ওরগানাইজেশন) গত ইংরেজি ২০০৪ সাল থেকে “সবার জন্যে নিরাপদ রক্ত” স্লোগান নিয়ে পালন করে আসছে এ দিনটি। ইতিমধ্যে ১৮২ টি দেশ সম্পৃক্ত হয়েছে এ আন্দোলনে। বাংলাদেশেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয় এ দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে Blood donation and universal access to safe blood transfusion”. মানবতার কল্যাণে এটি একটি বিশেষ ও উত্তম উদ্যোগ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি জানা তাই সকল মানুষের জরুরি। বিশেষ করে যে ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা সংস্থা এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে তাদের জন্যে। এ নিবন্ধে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
ইসলাম বিশ্বধর্ম, মানবতার ধর্ম, পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব কল্যাণের প্রত্যেকটি বিষয় এখানে গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করা হয়েছে; নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সঠিক পথের। যে কোন প্রয়োজনে তাই ইসলামের বিধি-বিধান ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর আস্থা এ ধর্মের অনুসারীদের উপর অবশ্যকর্তব্য। রক্তদান আধুনিক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম এবং বর্তমান সময়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অপরিহার্য বিষয়। সুতরাং এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা সকল অনুসারীদের জানা আবশ্যক।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবদ্দশায় রক্তদান সংক্রান্ত কোন প্রয়োজনীয়তা কিংবা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর ব্যবহার শুরু না হওয়ায় সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহে বিষয়ের কোন উল্লেখ নেই। তদুপরি, এ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের বিধান, সেসবের দৃষ্টিভঙ্গি ও শরয়ি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (মাকাসিদ আল-শরিয়াহ) এসবের উপর ভিত্তি করে আধুনিক ইসলাম বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ের বিধান নিরুপণ করার চেষ্টা করেছেন। ফলে, কিছু সূক্ষè বৈপিরত্য একে অন্যের মতের মাঝে পার্থক্য দেখা গেলেও মৌলিক বিষয়ে কারো কোন দ্বিমত উল্লেখযোগ্য নয়। রক্তদান সম্পর্কীত এ মাস’আলার নি¤েœাল্লেখিত বিষয়সমূহ তাই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ইসলামে রক্তের বিধান: রক্ত মানব দেহের অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান। রক্ত ছাড়া কেউ এক মুহুর্ত বেঁচে থাকতে পারে না। শরীরে আভ্যন্তরে এর অবস্থান এবং যতক্ষণ তা শরীরের ভিতরে আছে তা পবিত্র। কিন্তু যখনই তা শরীরের বাইরে আসে তখন তা অপবিত্র। এটি কোন ক্রমেই ভক্ষণযোগ্য নয়। কুরআন এটিকে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছে। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে হারাম (নিষিদ্ধ) করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শুকরের গোশত এবং যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্যে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্যে কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ১৭৩; আরো দেখুন: সূরা মায়েদাহ, আয়াত ৩)
এসব আয়াতে রক্ত সম্পর্কীত দুইটি বিষয় সুস্পষ্ট। এক. রক্ত হারাম বা নিষিদ্ধ (উল্লেখ্য, হারাম বস্তুর অন্যান্য ব্যবহারও সর্বসম্মতিক্রমে অবৈধ) এবং দুই. অনন্যোপায় হলে তা বৈধ। ইসলামের এই বিশেষ ব্যবস্থাপনায়ই তাকে অনন্য করে তুলেছে। ইসলামের শরয়ি বিধান তাই সবসময়ই মানবতা এবং তার কল্যাণ ও প্রয়োজনকে গুরুত্বের সাথে নিশ্চিত করেছে।
রক্ত ক্রয়-বিক্রয়: উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে শরিয়ত এ বিষয়ের বিধান নির্ধারণ করেছে। সর্বসম্মতিক্রমে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রক্ত ক্রয় কিংবা বিক্রয় করা হারাম (অবৈধ/নিষিদ্ধ)। তিনটি কারণ এর পেছনে রয়েছে। প্রথমত: মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ অনান্য শারিরিক আনুসাঙ্গিক জিনিসের পূর্ণ মালিকানা আল্লাহর। তাই এটি কেনা-বেঁচার অধিকার সৃষ্টাকর্তৃক সংরক্ষিত। দ্বিতীয়ত: এটি অপবিত্র বস্তু। শরিয়তের বিধান হলো অপবিত্র এবং নিষিদ্ধ বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ব্যবসা সবই নিষিদ্ধ/অবৈধ। এবং তৃতীয়ত: জীবন নাশের হুমকি স্বরুপ। এটি ফলাফলগত কারণ। ইসলামী শরিয়তের পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে। যাকে পরিভাষায় “মাকাসিদ আল-শরিয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ” বলা হয়। তার মধ্যে প্রথম উদ্দেশ্য হলো ‘হিফজু আন-নাফস’ বা ‘জীবনের নিরাপত্তা/সংরক্ষণ’ নিশ্চিত করা। রক্ত ক্রয় কিংবা বিক্রয় উভয়ই মানব জীবন নাশের সম্ভাবনা তৈরি করে। সুতরাং তা থেকে দূরে থাকাকে বিধান করা স্বাভাবিক। ইসলামী আইনের একটি নিয়ম (কায়েদা) হলো: “মুকাদ্দামাতু আল-হারামি হারামুন” (কোন হারাম বিষয়/কাজের ভ‚মিকাও হারাম)।
উল্লেখ্য, রক্ত দাতা যদি বিনামূল্যে রক্ত দিতে না চান, তাহলে জরুরি পরিস্থিতিতে রোগির কল্যাণের জন্যে রক্ত ক্রয় করা বৈধ হবে কিন্তু বিক্রয়দাতার পাপ হবে। (বিস্তারিত দেখুন: মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ, খÐ ২, পৃ. ৩৮)
রক্ত দান ও রক্ত দাতার বিধান: শরিয়তের প্রত্যেকটি বিধান যেহেতু মানবতার জন্যে, সৃষ্টির কল্যাণের জন্যে সেহেতু এ বিষয়গুলোকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন কোন অবৈধ (হারাম) বিষয়কে বৈধতা দিয়েছে শর্তস্বাপেক্ষে। ঠিক তদরুপ হলো রক্ত দান করার ব্যাপারটি। এটি যদি এমন পরিস্থিতিতে হয় যে, রক্তগ্রহীতার মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে এবং রক্তদাতার বিকল্প কোন কিছুই করা সম্ভব না হলে স্বাভাবিক ভাবেই রক্ত দেয়া বৈধ। এ বৈধতার ব্যাপারে দুইটি কারণ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
প্রথমত: রক্তগ্রহীতরা জীবন রক্ষার চেষ্টা করা: এ ব্যাপারে কুরআন সরাসরি বলেছে, “যে কোন একজন ব্যক্তির জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করল।” (সূরা মায়েদাহ, আয়াত ৩২) এ আয়াতের মাধ্যমে মানবতার জীবন রক্ষা করার জন্যে এসকল উপায়কে ব্যবহার করার প্রতি উৎসাহের নামান্তর।
দ্বীতিয়ত: অনোন্যপায় হওয়া। অর্থাৎ বিকল্প কোন কিছু না পাওয়া। (দেখুন: সূরা বাকারাহ, আয়তা ১৭৩) কারণ, প্রশ্ন উঠতে পারে রোগির জন্যে এটি বৈধ কিন্তু যিনি রক্ত দিবেন তিনি তো সুস্থ্য ও স্বাভাবিক। এজন্যে বিকল্প চিকিৎসা ও উপায় না পেলে তখন বৈধ হবে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে রক্তদান বৈধ হওয়ার ব্যপারে শরিয়ত বিশেষজ্ঞগণ যেসব যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলে মনে করেন তা হলো:
এক. শরীরের অন্য আনুসঙ্গিক বিষয়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। যেমন, মায়ের দুধ। এটি শিশুর প্রয়োজনে যেমন ব্যবহারযোগ্য তেমনি রক্তও অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্যে জরুরি। তাই এটি বৈধ।
দুই. এটিতে কাটা-ছোড়ার কোন প্রয়োজন পড়ে না। বরং ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্যাথাহীনভাবে নেয়া যায়।
তিন. নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেয়াতে ব্যক্তির কোন ক্ষতি হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, তিন মাসের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রক্তের প্রয়োজন পূর্ণ হয়। (বিস্তারিত দেখুন: মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ)
উল্লেখ্য, এটি অবশ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কর্তৃক নির্দেশিত হতে হবে। এবং এ ব্যপারটি নিশ্চিত করতে হবে, যেন রক্ত দেয়ার কারণে রক্তদাতার জীবন হুমকির সম্মুখিন না হয়।
অমুসলিমদের রক্ত দেয়া বা নেয়া: মুসলিমের জন্যে অমুসলিমের রক্ত কিংবা অমুসলিমের জন্যে কোন মুসলিমের রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে কোন বিধি-নিষেধ নেই। অর্থাৎ উপরোল্লেখিত পরিস্থিতিতে একজন মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম থেকে রক্ত নিতেও পারবেন, তাকে দিতেও পারবেন। (দেখুন: মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ, খÐ ২, পৃ. ৪০০) যদিও মুশরিকদেরকে কুরআনে অপবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। (দেখুন: সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত ২৮) তবে, রক্তের প্রভাব অন্য দেহেও পড়ার সম্ভাবনা আছে, তাই মুসলিমের জন্যে কোন মুসলিমের রক্ত নেয়ার চেষ্টা করা উত্তম।
স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্ত দেয়া-নেয়া: স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে রক্ত দিতে পারবেন। এবং সেক্ষেত্রে সম্পর্কের মধ্যে কোনরুপ প্রভাব পড়বে না। (দেখুন: মুফতি মুহাম্মদ শফি, জাওয়াহিরুল ফিকহ) মাতৃদুগ্ধের বিধান এখানে প্রযোজ্য নয়। অথ্যাৎ রক্ত দেয়া নেয়াতে সম্পর্কের উপর কোন প্রভাব পড়ে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।