পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘আসসালাতু খাইরুম মিনার নাউম’ ফজরের আজান শুনে মসজিদের শহর ঢাকায় মানুষের ঘুম ভাঙে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য গত কয়েকদিন থেকে মানুষের ঘুম ভাঙছে মাইকের গান ‘নগরজুড়ে আইলো রে সিটি নির্বাচন’ শুনে। নির্বাচনী প্রচারণার নামে প্যারোডি গানের শব্দদুষণের ‘অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ ঢাকা মহানগরীর সব শ্রেণির মানুষ।
প্রার্থীদের উচ্চস্বরে নির্বাচনী গান প্রচারণার কান্ডজ্ঞানহীন ভয়ানক শব্দদূষণ পরীক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, নামাজি, শিশু, বয়োবৃদ্ধ মানুষ এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য হয়ে পড়েছে বিভীষিকাময়। আচরণবিধি লংঘন করে এমন ‘মগের মুল্লুকীয়’ প্রচারণা দেখেও নির্বাচন কমিশন ইশপের গল্পের ‘নিধিরাম সর্দারের’ মতোই নীরব। এমনকি কয়েকজন প্রার্থীর আচরণবিধি লংঘনের লিখিত শত অভিযোগ গ্রহণ করেও ইসি আচরণবিধি মানতে প্রার্থীদের বাধ্য করছে না।
আগামী ৩ ফেব্রæয়ারি, এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। রাজধানী ঢাকা তথা দুই সিটি কর্পোরেশনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। পরীক্ষা প্রস্তুতির পড়াশোনায় ছাত্রছাত্রীদের ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে সিটি নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের মাইকে ভোটের প্যারডি গান উচ্চস্বরে প্রচারণা। নির্বাচনী আচরণবিধিতে মাইক ব্যবহারের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
বেলা দুইটার আগে ও রাত আটটার পর মহানগরীতে মাইক বাজানো নিষিদ্ধ। ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির কোথাও এই আইন মানা হচ্ছে না। মাইকিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভ‚ত কর্মকাÐের ব্যাপারে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনের দুই রিটার্নিং কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়গুলো দেখভালের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন।
১ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটির নির্বাচন। প্রার্থীরা প্রচার চালাচ্ছেন উন্নত আধুনিক ঢাকা গড়বেন। নাগরিক সেবার হাজারো প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন। দেশের সর্ববৃহৎ হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি প্রায় শতাধিক হাসপাতালে লাখ লাখ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এসব রোগীর অনেকেই গুরুত্বর অসুস্থ। হার্টের রোগীর সংখ্যাও অনেক। উচ্চস্বর শব্দ এই রোগীদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিকট আওয়াজে ভোটের মাইকিং এবং প্রার্থীদের ভোট চেয়ে প্যারডি গানের প্রচারণায় গুরুতর এই রোগীদের জীবন হয়ে পড়েছে বিপন্ন। তা ছাড়াও শব্দদূষণে প্রকম্পিত হচ্ছে ঢাকা! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ভোটের প্যারডি গান ও প্রচারণায় মাইকের শব্দে হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীদের হাসফাঁস অবস্থা।
রাজধানী ঢাকা মসজিদের শহর। ফজর থেকে শুরু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করেন লাখ লাখ মুসুল্লি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। নামাজে দাঁড়িয়ে মাইকের শব্দে খেই হারিয়ে ফেলছেন মুসুল্লিদের অনেকেই। কোথাও কোথাও এমনো অভিযোগ রয়েছে ভোটের গানের প্রচারণার উচ্চস্বরের কারণে অনেক মুসুল্লি মসজিদের আযান পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছেন না। প্রশ্ন উঠেছে যেখানে নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণাতেই মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন; পলিথিন মোড়ানো পোস্টারে পরিবেশ দূষণ করছেন; শব্দ দূষণে বিড়ম্বনায় ফেলছেন মানুষকে; সেখানে কিভাবে আধুনিক ঢাকা গড়ে নগরবাসীকে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ দেবেন? কিভাবে নাগরিকদের নিরাপদে সুখে রাখবেন?
রাজধানী ঢাকার যেসব স্কুল ও মাদরাসায় এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে; সেসব কেন্দ্রে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র করে ভোট গ্রহণ করা হবে। পরীক্ষা কেন্দ্র প্রস্তুত এবং বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর রোল নম্বর বসাতে দীর্ঘ সময় লাগে। তারপরও ভোটের কারণে সেটা পুষিয়ে নিতে শিক্ষকরা প্রস্তুত। কিন্তু পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা প্রস্তুতির বিঘ্ন ঘটানো প্রসঙ্গে শ্যামপুর এলাকার একটি হাইস্কুলের এক শিক্ষক অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, ভোটের গানে পরীক্ষার্থীদের পাড়লেখায় অসুবিধা হচ্ছে। প্রার্থীদের এভাবে মাইকিং সমর্থন যোগ্য নয়। পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টি দেয়া উচিত ছিল। ইসি সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
মসজিদের শহর ঢাকা যেন হয়ে গেছে নির্বাচনী পোস্টার আর প্যারডি গানের শহর। নগরে সিটি নির্বাচন ঘিরে চলছে তুমুল প্রচার-প্রচারণা। সেই প্রচার প্রচারণার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে পোস্টার, লিফলেট, মাইকিং এবং মাইকে প্যারডি গানের মাধ্যমে প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রার্থনা। একদিকে পলিথিনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে অন্যদিকে মাইকিং ও উচ্চশব্দে প্রচারণা চালিয়ে শব্দ দূষণ করা হচ্ছে। ‘টেকসই প্রচার’ তথা কুয়াশার হাত থেকে পোস্টার বাঁচাতে গিয়ে অনেক প্রার্থীরা পোস্টারে ব্যবহার করছেন পলিথিনের কভার। রাজধানী জুড়ে লাখ লাখ পলিথিন ঝুলছে এখন নির্বাচনী পোস্টার নিয়ে। সারা বিশ্বেই মতোই সরকার যখন পলিথিনের দূষণ নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে, নিষিদ্ধ করছে পলিথিনের ব্যবহার সেখানে আধুনিক শহর গড়ার প্রতিশ্রæতিশীলদের প্রচারণাতেই দূষণ।
২২ জানুয়ারি হাইকোর্ট পলিথিনের পোস্টার তুলে ফেলার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু প্রার্থীরা সে নির্দেশনা যেমন গ্রাহ্য করেননি; তেমনি নির্বাচন কমিশনও মহানগরীকে পলিথিনের পোস্টারমুক্ত করতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। গতকাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) লেমিনেটেড পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে ‘থার্মাল লেমিনেশন ফিল্মস : অ্যান ইনসিজিং হেল্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট হ্যাভক অব ঢাকা সিটি’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকশ করেছে। ওই গবেষণায় বলা হয় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লেমিনেটেড পোস্টার-ব্যানারে সয়লাব ঢাকা মহানগর। এ নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর প্রায় ১২ দিনের মধ্যেই ২ হাজার ৪৭২ টন লেমিনেটেড প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। পুরো নির্বাচনে পোস্টার থেকে বর্জ্য জমবে ২ হাজার ৫০০ টন। এছাড়া নির্বাচনী পোস্টারসহ সব মিলে গত বছরজুড়ে ঢাকা শহরে ১০ হাজার টন লেমিনেটেড পোস্টারের বর্জ্য তৈরি হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, যাদের হাতে পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য নগরী গড়ার দায়িত্ব যাবে, তারাই যদি নগরীর পরিবেশের ক্ষতিকর কার্যক্রমে জড়িয়ে যান, তাহলে এ নগরী রক্ষা করবে কে, পরিচ্ছন্ন রাখবে কে?
রাজধানীর ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের চলছে পরীক্ষার প্রস্তুতি। পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা হলেও চাকরির বাজারে ছাত্রছাত্রীদের জন্য এসএসসি ও দালিখ পরীক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেট পরীক্ষা। সারাদেশের পরীক্ষার্থীরা যখন নির্বিঘেœ পড়াশোনার মাধ্যমে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; তখন রাজধানী ঢাকার পরীক্ষার্থীদের টেবিলে পড়তে বসে নির্বাচনী প্রচারণার বিকট শব্দে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। গগণবিদারী মাইকের আওয়াজ পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এই মহানগর যেন নাগরিকের জন্য নয়; ঢাকা যেন হয়ে গেছে প্যারোডি সংগীতের নগর। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামে ভোট প্রার্থনার নামে বিভিন্ন গানের প্যারোডি করে শহরের অলিগলি ঘুরছে মাইক। গানে গানে প্রার্থীর গুণকীর্তন আর মার্কার (প্রতীক) জয়গান পরীক্ষার্থীদের কান ঝালাপালা। প্রতিদিনই বেলা বাড়ার সঙ্গে প্যারোডি গানের অত্যাচার বেড়ে যায়। শনির আখড়ায় কানে এলো ‘চামচ মার্কার এবার জোয়ার এসেছে/ মজুমদার ভাই এবার প্রার্থী হয়েছে’। মমতাজের অনেক গান প্যারোডি করে নির্বাচনী প্রচারণায় মাইকে প্রচার করা হচ্ছে।
গতকাল যাত্রাবাড়ি মোড়ে মাইকে শোনা গেল ‘মধু হই হই বিষ খাওয়াইল্যা/ অমুক মার্কায় ভোট না দিলা’ ‘অমুক ভাইয়ের জন্য বুকটা ফ্যাইট্যা যায়’; ‘দে দে সিল মেরে দে, তোরা দেরি করিস না/ নৌকা মার্কা ছাড়া তোরা সিল মারিস না’; ‘সবাই মিলে ভোট দেব ধানের শীষে/ ধানের শীষে আছে রক্ত মিশে’; ‘বৈশাখী আপাদের এবার দিবই দিব ভোট’ ‘আপা গো তোমার ভোটটা দিয়ে দাও/ রেডিও মার্কায় তুমি তোমার ভোটটা দিয়ে দাও’; ‘১ তারিখের নির্বাচনে সবাই শপথ নিয়ো/ নির্বাচনে ভোটটা কুমড়া মার্কায় দিয়ো’; অমুক ভাইয়ের একটা মার্কা রয়েছে/ কুমড়া মার্কার পক্ষে নাকি জোয়ার এসেছে’; ‘আইল গেল কত ভাই, উন্নয়নের বালাই নাই/ অমুক ভাই, তমুক ভাই, চলেন সবাই ভুইলা যাই/ অমুক ভাইয়ের সালাম নিন, তমুক মার্কায় ভোট দিন’ এমন অসংখ্য প্যারোডি গান মাইকে উচ্চস্বরে বাজিয়ে নাগরিকের কান ঝালাপাল করা হচ্ছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে ‘ভোটের গান’। নির্বাচনী প্রচারণায় এই প্যারোডি গান নির্বাচনে বাড়তি রঙ যোগ করছে ঠিকই; কিন্তু দিনরাত উচ্চ স্বরে বাজানোয় অনেকের কানে পৌঁছাচ্ছে রীতিমতো আতঙ্ক হয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সংগীতকে চমৎকার দাওয়াই সংগীন এখন মানুষের জন্য বিভীষিকা হয়ে উঠেছে।
গতকাল যাত্রাবাড়ি মোড়ে মাইকে ভোটের প্যারোডি গান বাঁজছিল। শনির আখড়া থেকে গুলিস্তান আসার পথে বাসে মাইকে গান শুনে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসারত জনৈক আবদুর রহিমের পুত্র ইহসান অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘দয়া করে গান থামান। না হলে হাসপাতালে বাবা স্ট্রোক করে মারা যাবে। মরে গেলে তো আর ভোট দিতে যেতে পারবে না।’ বাসের অন্যান্য যাত্রীদের মধ্যেও দেখা গেল উচ্চ স্বরে প্রচারিত নির্বাচনের প্যারডি গান নিয়ে অসন্তোষ। একজন যাত্রী বললেন, মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা ৩ ফেব্রæয়ারি। কোচিং এবং বাসায় মাস্টার রেখে ১০টি বিষয়ে পড়িয়েছি। মেয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে বই নিয়ে টেবিলে বসলেই মাইকে ভোটের আওয়াজ। একদম পড়াশোনা করতে পারছে না। একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত এক সংবাদ কর্মী বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ‘মসজিদে নামাজে দাঁড়িয়েছি; কিন্তু মাইকে গানের বিকট আওয়াজ। ভোটের এই প্রচারণায় মানুষকে নামাজ পর্যন্ত পড়তে দিচ্ছে না’।
নির্বাচনী প্রচারণায় উৎসবমুখর পরিবেশের কথা বলা হলেও নির্বাচনী প্রচারণার কাÐজ্ঞানহীন শব্দদুষণ ও ভয়াবহ পরিবেশদূষণ নিয়ে নির্বাচন কমিশন ও প্রার্থীদের আদৌ ন্যুনতম কোনো উপলব্ধি রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহের অবকাশ আছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।