Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাকার ঈদ ও ঈদ উৎসব

প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল
ঢাকা অতি প্রাচীন শহর। উপমহাদেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি ঢাকা। মুঘল স¤্রাট জাহাঙ্গীরের সেনাপতি ও সুবাদার ইসলাম খানের ঢাকা জয়ের পর থেকে এটা বাংলার রাজধানী। ঢাকাকে কেন্দ্র করেই সুবে বাংলার সকল আদেশ-নির্দেশ আনন্দ, উৎসব দেশময় ছড়িয়ে পড়ত। মুঘলদের আগে ঢাকার ঈদ সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। মুঘল নৌসেনাপতি মির্জা নাহানের “বাহারস্থান-ই গায়েবী” হতে ঢাকার ঈদ সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যদিও মুঘলদের আড়াইশ’ বছর আগে ঢাকায় মুসলমানদের অস্তিত্ব নারিন্দায় ও মিরপুরে পরিলক্ষিত হয়েছে। এ দুটি স্থানে যেহেতু প্রাচীন দুটি মসজিদ রয়েছে। সেহেতু ধারণা করা যায়, সেখানে অবশ্যই ঈদের নামাজও হতো। মির্জা নাথানের লেখনী হতে রমজানের ঈদ সম্পর্কে জানা যায়। তখন ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে মুঘল কেল্লা হতে কামানের গুলি ছোড়া হতো। আতশবাজি করা হতো। শাহী বজরা সেনাপতি পরিদর্শন করতেন। সুবাদার শাহী লোকদের পাহারা দিতেন। কিন্তু সাধারণ লোকেরা কীভাবে ঈদ পালন করত তা লেখা হয়নি। সে সময় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দামি পোশাক পড়তেন। পাঞ্জাবি, সেরোয়ানি পাজামা পরতেন পুরুষরা। যাতে জরী ও দামি মুক্তার কাজ করা থাকত। মেয়েরা শাড়ি ও সালোয়ার, কামিজ পরতেন। মুঘল হেরেমের মহিলারা মসলিন কাপড় পরতেন। দলবেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। ঈদের দিন ঈদ মিছিল হতো। এ ঈদ মিছিল ঢাকা শহর ঘুরত। ঢাকা শহরে ঈদের নামাজের জন্য ধানমন্ডিতে শাহ শুজার সময় মীর কাসিম ১৬৪০ খি. একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। এ ঈদগাহর আয়তন ২৪৫ঢ১৪৭ বর্গ ফুট। ধানমন্ডি ছাড়াও চকবাজার, কাওরানবাজার, লক্ষ¥ীবাজার, ইসলামপুর, লালবাগ এলাকায় ঈদের জামাত হতো। ঈদের দিন ঢাকায় ধনাঢ্যদের বাড়িতে দামি ও সুস্বাদু খাবার রান্না করা হতো। সমাজের নি¤œ শ্রেণীর লোকেরা কীভাবে ঈদ উদযাপন করত তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা যায় ভালো ভালো খাবার না হলেও একসাথে একই জামাতে হতো ঈদের নামাজ। জাকাত ফিতরার টাকায় একটা দিন ভালো চলতো সাধারণ মুসলমানদেরও।
এখন ঢাকার ঈদ চিত্র ভিন্ন। দেশের ১৬ কোটি জনগণের প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস ঢাকায়। এখন বাংলাদেশের বড় দুটি উৎসবই হলো ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজাহা। সারা মাস রোজা থাকার পর শাওয়াল মাসের ১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ঈদুল ফিতর। রমজানে ঢাকা যেন হয়ে পড়ে এক অপূর্ব নগরী। ইফতারসংস্কৃতি এখন শুধু ঢাকায়ই নয়, সমগ্র বাংলাদেশেই প্রচলিত। রমজানের ১৫ তারিখ থেকেই জাতীয় ঈদগাহ সাজাতে থাকে সরকার। জাতীয় ঈদগাহে রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যরা ও সংসদ সদস্যরা ঈদের নামাজ আদায় করেন নগরবাসীর সাথে। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীরা তাদের দফতরে সর্বসাধারণের সাথে সাক্ষাৎ দেন। দেশি-বিদেশি লোকেরা তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঢাকা সাজানো থাকে নানা রঙের বাতিতে। পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকে বেশ কয়েক দিন। ঈদুল ফিতরে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জাকাত ফিতরা গরিবদের মাঝে বিতরণ করেন। জাকাতের কাপড় আনতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনাও মাঝেমধ্যে ঘটে। বঙ্গভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বায়তুল মোকাররম মসজিদ সুন্দর করে সাজানো হয়। ঈদ উপলক্ষে ইসলামপুর, চায়নামার্কেট, সদরঘাট, গুলিস্তান, পল্টন, বসুন্ধরা, চাঁদনীচক, গাউছিয়া ও নিউমার্কেট বিপণি বিতানগুলোতে বেচা-কেনার ভিড় লক্ষ্যণীয়।
লাখ টাকায় বিক্রি হয় থ্রি-পিস ও লেহেঙ্গা। শাড়িও বিক্রি হয় অনেক দামে, ঢাকার বস্তি থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকায় ঈদের আমেজ শুরু হয় একমাস আগে থেকেই। ঢাকায় যাতায়াতের বিশেষ ব্যবস্থা থাকলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এতে ঈদ যাত্রীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা জেলা পরিষদের মাধ্যমে অনেকগুলো ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে প্রধান ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় সুপ্রিমকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। সবচেয়ে বেশি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। এখানে ৫-৮টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সব বয়সের সব শ্রেণীর লোক ঈদের নামাজে উপস্থিত থেকে নামাজ আদায় করেন। তাদের পরনে থাকে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা ও টুপি। আতর, গোলাপ, চন্দন ও সেন্টের সুবাস গায়ে মেখে ঈদগাহে উপস্থিত হন লাখোমুসলমান। ঈদের দিন ঢাকাবাসী সেমাই, লাচ্ছা, জর্দা, পায়েস, দই তৈরি করেন। রান্না করা হয় গরুর মাংস, খাসির মাংস, মুরগির মাংস, পোলাও এবং বিরিয়ানি। এ বাসায় ও বাসায় দেয়া হয় খাবার-দাবার। এতে বাড়ে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি। দুপুরে মধ্যাহ্ণ ভোজনের পর দলবেঁধে বেড়াতে যাওয়া হয় বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি। বিকালে ঢাকার যুবক-যুতীরা ঘর থেকে বের হয়ে রমনা পার্ক, শিশুপার্ক, টিএসসি অথবা প্রিয় কোনো জায়গায় বেড়াতে যান। তবে ভিন্ন দৃশ্য ঈদুল আজহায়। ঈদের এ দিনটিতে গরু, বকরী, উট কোরবানি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন ঢাকাবাসী। ঈদানীং কে কত বেশি দামে গরু বা উট কিনে খবরের শিরোনাম হবেন তা নিয়েই ব্যস্ততা থাকে ঢাকার ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য মহল।
ঈদ উৎসব এখন শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ উৎসব বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। হিন্দু মুসলিম সকলেই সমভাবে উপভোগ করছেন ঈদ উৎসব। স্বপন কর্মকার তার ছেলেকে ঈদের পোশাক কিনে দিলেন নিউমার্কেট হতে। প্রভারানী হালদার তার মেয়েকে কিনে দিয়েছেন থ্রি-পিস। এ থেকেই বোঝা যায় ঢাকার বর্তমান ঈদ “সার্বজনীন উৎসবে” রূপ নিয়েছে।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকার ঈদ ও ঈদ উৎসব

২ জুলাই, ২০১৬
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ