Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঢাবি’র প্রতিষ্ঠা ও আমাদের অসাম্প্রদায়িকতাবোধ

প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম¥দ আবদুল অদুদ
১৯২১ সালের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক, গৌরবময় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। এটিকে এখন বলা হয়, গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সূতিকাগার। বলা হয়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ৯৫ বছর পরে আশঙ্কা করছি, এই বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মনে রেখেছে কি-না, কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো এই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। আমাদের অনেকেই জানি না, কারা তাদের সীমাহীন ত্যাগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকা- দিয়ে আলোকময় করেছিলেন এ অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে আর কাদের বিরোধিতার কারণে ঢাবি নামক শিশুটি ১০ বৎসর সময় নিল শুধু জন্মগ্রহণ করতেই। আমাদের কেউ কেউ এমনও আছি, যারা এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক’র নাম পর্যন্ত জানি না।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয প্রতিষ্ঠার সাথে বিশেষভাবে জড়িত ছিল একটি ঘটনাÑ‘বঙ্গভঙ্গ’। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জনের আমলে সংঘটিত ‘বঙ্গভঙ্গ’ ছিল ব্রিটিশ সরকারের দীর্ঘদিনের চিন্তা-গবেষণার ফসল, যার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৮৫৮ সাল থেকে। কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায় ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের লক্ষ্যে ‘বঙ্গভঙ্গ’কে বঙ্গমাতার অঙ্গহানি বলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করে। কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র বিরোধিতার কারণে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ‘বঙ্গভঙ্গ’র সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। অথচ আসাম ও পূর্ববাংলা এক থাকলে আজকের ঢাকা থাকতো আরো অনেক সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী। এই ভূখ- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গৌড় ইত্যাদি বহু নামে ও ভাগে বিভক্ত থাকলেও ‘বঙ্গমাতা’ নামে তা কখনো অভিহিত ছিল না, সেহেতু বঙ্গমাতার অঙ্গহানির প্রশ্নটি ছিল অবান্তর বা ¯্রফে রাজনৈতিক। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবার হলে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের ‘বঙ্গভঙ্গ’ বাতিলের ঘোষণা মুসলিম নেতৃবৃন্দকে হতভম্ব করে। সংবাদটি পূর্ব বাংলা ও আসামের শোষিত, বঞ্চিত মুসলমানদের বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করে। তারা তখন নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট ও তাহযীব তমুদ্দুন রক্ষায় সোচ্চার হন ও ব্রিটিশ সরকারের নিকট প্রতিবাদ জানান। মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকলে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ববাংলার মুসলমানদের অসন্তুষ্টির ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে ঢাকায় চলে আসেন এবং সাগ্রহে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সাথে এক বৈঠকে বসেন। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শের-ই-বাংলা এ কে ফজরুল হক প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনেক কথার পর তাকে জানান, যদি বঙ্গভঙ্গ রদ একান্তই পুনর্বিবেচনা করা না হয়, তবে পূর্ববাংলার মুসলমানরা সর্বদিক দিয়ে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের বিকল্প দাবী- কমপক্ষে ঢাকায় একটি বিশ^বিদ্যালয় করা হোক। জবাবে লর্ড হার্ডিঞ্জ বলেন,  That the Government of India realized that education was the true salvation of the muslims and that the Government of India as an earnest of their intentions would recommend to the secretary state, the constitution of a university at Dacca. On 2nd February 1912 a communiqué was published stating the decision of the Government of India that the constitution of a university of Dacca. (Dr. A.A. Rahim, The History of the University of Dacca, pp-4-5, Calcutta University Commission Report, Vol- IV, p-133).
১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর ভারতের ৩৫ জন মুসলিম নেতা ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সিমলায় সাক্ষাৎপূর্বক মুসলমানদের ধর্মীয় ও বুদ্ধিগত জীবনের কেন্দ্ররূপে একটি মুসলিম বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট লর্ড হেয়ার ও লর্ড চার্লস বেইলির দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে এক জনাকীর্ণ সংবর্ধনা সভায় দুটি মানপত্রের মাধ্যমে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ও নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এভাবে মুসলমান নেতৃবৃন্দের পুনঃপৌনিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এতে একযোগে বাধার সৃষ্টি করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বিভিন্ন সভা-সমিতি ও পত্র-পত্রিকায় এব্যাপারে জনমত গড়ে তোলার জন্য বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সে সভায় সভাপতিত্ব করেন আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিপূর্বে ‘বঙ্গভঙ্গ’র প্রতিবাদে আহুত শোভাযাত্রা ও রাখিবন্ধন কর্মসূচিতেও তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। (আমিনুল ইসলাম, বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা, লেখা প্রকাশনী, ৫৬/ডি কলেজ স্ট্রীট, কলকাতা-৭৩, পৃষ্ঠা-১৪১)।
কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বনামধন্য ভিসি স্যার আশুতোষ মুখার্জির নেতৃত্বে ড. রাসবিহারী ঘোষ, বাবু গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জী প্রমুখ বাংলার এলিটগণ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জকে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন এবং ১৯১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত স্যাডলার কমিশনের কাছে নানারূপ আপত্তি উত্থাপন করতে থাকেন। এমনকি ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে হিন্দু প্রতিনিধি দল এক ঘৃণ্য অভিমত প্রকাশ করেন এভাবে যে, ‘ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবে না। ইত্যাকার নেতিবাচক ও নৈরাজ্যজনক কথা’। নেতৃবৃন্দ ১৯১২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায়, ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ফরিদপুরে, ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ ও বরিশালে বিক্ষোভ সভা করেন। তাদের বক্তব্যের মূল কথা ছিল, ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় হলে শিক্ষার মান নি¤œগামী হবে। কারণ, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মুসলমানই চাষা-ভুষা। (প্রফেসর মো. মোসলেম উদ্দিন শিকদার, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি: সাম্প্রতিক সমীক্ষা, প্রকাশ, মাসিক ইতিহাস অন্বেষা, ঢাকা, পৃ.৩৬)।
‘A history of the Freedom Movement’  গ্রন্থের চতুর্থ খ-ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমিকা অধ্যায়ে বর্ণিত আছে যে, পূর্ব বাংলার প্রায় দুইশ গণ্যমান্য হিন্দু ঢাকার প্রখ্যাত উকিল বাবু আনন্দ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশ^বিদ্যালয় স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করে ভাইসরয়কে একটি স্মারকলিপি দেন। হিন্দুদের এভাবে সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষোভ ও প্রতিহিংসায় তারা এটাকে মক্কা বিশ^বিদ্যালয় ও ফাক্কা বিশ^বিদ্যালয়, এমনকি তারা এও বলেছিল যে, A good college (Dacca College) was killed to create a bad university.’  (আশুতোষ ভট্টাচার্যি সম্পাদিত ‘আমার সেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়’)।
অবশেষে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ প্রদত্ত ৫০০ একর জমি, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রদত্ত কয়েক লাখ টাকা এবং শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও তাগিদে প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সকল বাধা দূরীভূত হয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই বিশ^বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৮ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবস্থাপক পরিষদের প্রথম বার্ষিক সভা ১৯২১ সালের ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মনে ব্যাথা লাগে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যারা প্রতিষ্ঠার সময়ে সবচেয়ে বেশি অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল, তারাই শিক্ষার জোরে দখল করলো অধিকাংশ চাকরি। ৩টি অনুষদের ১২টি বিভাগের প্রথম ৫৪ জন শিক্ষকের মাত্র ৮ জন ছিলেন মুসলমান। হাতেগোনা কয়েকজন ইউরোপীয় ছাড়া বাকী সবাই ছিলেন হিন্দু।
মজার ব্যাপার হলো, প্রতিষ্ঠার পরও বিরোধিতা শেষ হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ অ্যাফিলিয়েটিং ক্ষমতাসহ যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। প্রশ্ন হলো যাদের বিরোধিতার মুখে পড়ে বিশ^বিদ্যালয়টি ১০ বছর পিছিয়ে পড়ল এবং এটি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তাদের খুশি করার জন্য অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসাবে আমরা যে আমাদের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিকে ঘোষণা দিচ্ছি; আমরা কি কখনো নিজেকে প্রশ্ন করেছি, সেই বিরোধী পক্ষ কতখানি অসাম্প্রদায়িক? কেন তারা সেদিন বিরোধিতা করেছিলেন? আমরা অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই আমাদের ভালোবাসার প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে অসাম্প্রদায়িকতাবোধ সম্পর্কে ভালোভাবে জানা ও অনুধাবন আজ খুব বেশি জরুরি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামনিস্ট
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাবি’র প্রতিষ্ঠা ও আমাদের অসাম্প্রদায়িকতাবোধ
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ