বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ মাহবুব হোসাইন
মাসিক ‘মদীনা’ নামটি উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে একজন বিশ্ব বরেণ্য ইসলামিক স্কলারের সদা হাস্যজ্জ্বল চেহারা। তাঁর জ্ঞানদীপ্ত প্রতিভা ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। মাওলানা মহিউদ্দীন খান একটি নাম একটি ইতিহাস। আদর্শিক আন্দোলনে যিনি ছিলেন সব সময় সাহসী ভূমিকায়। বাংলাদেশের বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি ছিলেন একজন অতি সম্মানের পাত্র। উপমহাদেশে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে তিনি ছিলনে অন্যতম। আমাদের পরিবার অনেক আগে থেকেই মাসিক মদীনার পাঠক ছিল। ছেলেবেলা থেকেই এই চমৎকার পত্রিকাটির সাথে আমার পরিচয় গড়ে উঠে।
১৯৮৮ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগ এর উদ্যোগে ৭ দিনব্যাপী ইসলামিক বুনিয়াদী শিক্ষার উপর একটি কর্মশালার আয়োজন করে। ঐ কর্মশালায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ২০০ জন শির্ক্ষাথী অংশ গ্রহণ করে। আমিও এই সুন্দর আয়োজনে অংশ নিয়েছিলাম। এই কর্মশালায় রাসুল সা. এর রাষ্ট্রনীতির উপর মাওলানা মহিউদ্দীন খান বেশ চমৎকার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। ১৯৯২ সালে তথাকথিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা ঘাদানিকের দেশের সংবিধান পরিপন্থি অপতৎপড়তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগঠন জাতীয় যুব কমান্ডের কর্মসূচীর প্রতি তিনি অকুণ্ঠ সর্মথন প্রদান করেছিলেন। এই সূত্র ধরে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়ে যায়। এই সময় সমমনা বেশ কয়েকটি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল সম্মেলিত সংগ্রাম পরিষদ। ঐ সময় জাতীয় যুব কমান্ড এই সম্মেলিত মোর্চার অন্যতম সদস্য সংগঠন হিসেবে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। এই সময় মাওলানা মহিউদ্দীন খানের সাথে আমিসহ জাতীয় যুব কমান্ডের অন্যান্য সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আরও গভীর হয়। তিনি সব সময় আমাদেরকে সময়োপোযোগী পরামর্শ দিয়ে উৎসাহিত করতেন। তাঁর অভিভাবক সুলভ ব্যবহারে আমারা মুগ্ধ হয়েছিলাম।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যায় অবস্থিত ষোড়শ শতাব্দীর প্রাচীনতম বাবারী মসজিদ উগ্রবাদী হিন্দুদের দ্বারা ভাঙ্গার পরের দিন ৭ ডিসেম্বর ১৯৯২ বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনতা এর প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জাতীয় যুব কমান্ড সেদিন দেশের মানুষের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। সকাল আনুমানিক ১০টায় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেইটে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পরে। আমরাও মিছিল নিয়ে দৈনিক বাংলার দিক যাচ্ছিলাম। এমন সময় একজন এসে বললেন মাওলানা মহিউদ্দীন খান আপনাদের সাথে কথা বলবেন। জাতীয় যুব কমান্ডের সেক্রেটারি জেনারেল আবু নাসির মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহসহ আজাদ প্রডাক্টের সামনে অবস্থানরত মাওলানার সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, মিছিল অনেক করা যাবে, আসল কাজ হলো আজকে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠেয় ভারতের ক্রিকেট খেলা বন্ধ করতে হবে। এটা করা গেলে আমাদের প্রতিবাদটা অর্থবহ হবে। তাঁর কথার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাকে সামনে রেখে বিশাল মিছিল নিয়ে ক্রীড়া পরিষদের পাশ দিয়ে খেলা বন্ধের শ্লোগানে স্টেডিয়ামের অভিমুখে যেতেই পুলিশের বাধা। সেদিন প্রতিবাদী মানুষরা মাওলানা মহিউদ্দীন খানের মতো সাহসী ও সম্মানিত মানুষ পেয়ে পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৯৪ সালের কথা, লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাস নিয়ে গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদমুখর। এ সময় তসলিমা নাসরিনের বিষয়ে হাইকোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। জননেতা আনোয়ার জাহিদ, মাওলানা মহিউদ্দীন খান, এ এস এম সোলায়মান, মাওলানা আব্দুল লতিফ নিজামী, শফিউল আলম প্রধানসহ আরও বেশ কয়েকজন জাতীয় নেতৃবৃন্দ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব এসে পরে আমার ওপর। বক্তাদের নাম ঘোষণার মাঝে আমিও আমার বক্তব্য উপস্থাপন করে যাচ্ছিলাম। আমার কথা বলার সময় হঠাৎ মাওলানা মহিউদ্দীন খান আমার হাত থেকে মাইক নিয়ে তিনি একজন বক্তার নাম ঘোষণা করেন। এর পর আমার হাত ধরে পিছনে নিয়ে গিয়ে বললেন, বক্তব্যের সময় সব কিছু খেয়াল রাখতে হয়। আমি প্রথমে তাঁর কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারিনি। পরক্ষণে তিনি বললেন, তোমার বক্তব্যটা সরাসরি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কেনো সেদিন তিনি আমার হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়েছিলেন। একজন ইসলামিক স্কলার হওয়া সত্ত্বেও দেশের বিধিবদ্য আইন ও সংবিধানের ব্যাপারে ছিল তাঁর যথেষ্ট পড়াশুনা। ২০০৮ সালে সালে ভারত কতৃক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে যখন সারাদেশে মিছিল-মিটিং হচ্ছিল; সেই সময় একদিন দুপুরে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক এডভোকেট আবেদ রাজাসহ মাসিক মদীনা ভবনে মাওলানার সাথে দেখা করতে যাই। টিপাইমুখ বিষয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয় তাঁর সঙ্গে। আলাপ করে আমার কাছে মনে হয়েছে উপমহাদেশের ভৌগোলিক বিষয়ে মাওলানার প্রচুর পড়াশুনা রয়েছে। টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চের প্রতি তিনি অকুণ্ঠ সমর্থনও দিয়েছিলেন।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান একজন উচ্চমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকার জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র মিলনায়তনে রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমেদ স্মরণে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ, কথা শিল্পী শাহেদ আলী, কবি আল মুজাহিদী, কবি ফারুক মাহমুদ ও কবি আব্দুল হাই শিকদারসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা মহিউদ্দীন খানও একজন আলোচক হিসেবে কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে বেশ অনবদ্য আলোচনা রাখলেন। পিনপতন নিরবতায় সবাই তাঁর বক্তব্য শুনছিলো। একজন আরবী সাহিত্যের ছাত্র হয়েও জীবনের সূত্রপাত করেছিলেন খবরের কাগজে কাজ করার মধ্য দিয়ে। তৎকালীন সময়ের খ্যাতনামা পত্রিকা মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতার কাজ করেছেন। দেশের প্রতিটি ক্রান্তীকালে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ইসলামিক স্কলারেদর অভিভাবক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে আদর্শ বিরোধী অপশক্তির তখতে তাউস কেঁপে উঠতো। আমৃত্যু আদর্শিক রাজনৈতিক বলয়ে থেকে কাবা কেন্দ্রীক জীবনের স্বপ্ন লালন করতেন তিনি। আর সে কারণেই বাংলাদেশের ইসলামিক রাজনীতিতে তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বেশ কিছু অবিস্মরণীয় কাজ করে গেছেন। যা দীর্ঘকাল বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর জন্য নেয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। মারেফুল কুরআনের অনুবাদসহ বহু ইসলামিক গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। আরবী বাংলা অভিধান তাঁর অনবদ্য কর্ম হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। ময়মনসিংহের গফরগাঁও-এর এই কৃতি সন্তান গত ২৫ জুন ২০১৬ না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন। তিনি যখন চলে গেলেন তখন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি ফ্যাসীবাদী অপশক্তির দখলে আর তাঁর সহকর্মীরা দুঃশাসনের কবলে পড়ে নিষ্পেসিত। সৃষ্টিকর্তা শীর্ষস্থানীয় ইসলামিক স্কলার মরহুম মাওলানা মহিউদ্দীন খানকে তাঁর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দিন।
য় লেখক : প্রবাস থেকে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।