বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হোসেন মাহমুদ
বিশ্বের সর্বসাম্প্রতিক আলোড়ন তোলা ঘটনা হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগ। গোটা ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো এ ঘটনায় প্রকম্পিত। যুক্তরাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট দেবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল। তবে অনুমিত আশংকা আর বাস্তবতার মধ্যে যে অনেক পার্থক্য তা এখন দৃশ্যমান। ব্রিটেনের কনজারভেটিভ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ইইউ ত্যাগের বিপক্ষে ছিলেন। গণরায়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরাজিত ক্যামেরন ইতোমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের জনগণের মধ্যে নতুন করে ইইউতে থাকার ব্যাপারে একটি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ প্রবন্ধ লেখা পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এ বিষয়ে এক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। এ নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা হতে পারে। এদিকে এ রায়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকাও করছে কেউ কেউ। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউতে থাকতে চায়। যুক্তরাজ্যের মধ্যে থাকলে তা সম্ভব নয়। এদিকে এ ঘটনায় ব্রিটিশ পাউন্ড ও তার পাশাপাশি ইউরোর দাম পড়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে চলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের রফতানি খাতে বড় রকমের প্রভাব পড়বে বলে আশংকা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটো এবং বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সমর্থনের ক্ষেত্রে বড় রকমের ধাক্কা খেতে পারে। যুক্তরাজ্যের ইইউতে না থাকার সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে দু’ বছর পর। কিন্তু ইইউ মন্ত্রীরা ব্রিটেনকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চাপ সৃষ্টি করছেন বলে একটি খবরে বলা হয়েছে।
যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে যে তা অভিনন্দনযোগ্য কোনো ঘটনা হবে না, তা বুঝতে কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। বহির্বিশ্বের কোনো দেশই, এমনকি বাংলাদেশও যুক্তরাজ্যের ইইউ ত্যাগ চায়নি। কিন্তু ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্রিটিশ ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। পক্ষে ভোট দিয়েছেন ৪৮ দশমিক ১০ শতাংশ মানুষ। যারা ইইউতে থাকার পক্ষে বেশির ভাগ ভোট দিয়েছেন তারা হলেন রাজধানী লন্ডন, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মানুষ। লন্ডনের ৬০ শতাংশ মানুষ ইইউতে থাকতে চেয়েছেন। এখন লন্ডনের সদ্য নির্বাচিত মেয়র সাদিক খানের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে লন্ডনের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য। এ জন্য এক আবেদনে দেড়লাখ মানুষ স্বাক্ষর দিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে এ গণভোট গোটা ব্রিটেনকে জোর ঝাঁকুনি দিয়েছে। সৃষ্টি করেছে ব্রিটেনের ভেঙ্গে যাওয়ার হুমকি। ইইউতে থাকার জোর সমর্থক ছিল কনজারভেটিভ দল। সে কারণে ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন, কিন্তু তিনি হেরে যাওয়ায় আগামী অক্টোবরে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। তার স্থলাভিষিক্ত হতে চলেছেন লন্ডনের সাবেক মেয়র জনপ্রিয় নেতা বরিস জনসন। অন্যদিকে বিরোধী দল লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিনও ইইউতে থাকার পক্ষে ক্যামেরনের সহযাত্রী ছিলেন। এখন তার অবস্থানও নড়বড়ে। নেতার পদ থেকে শীঘ্রই অপসারিত হতে পারেন তিনি। অন্যদিকে গণভোটের পর মোটা দাগে বিভক্ত ব্রিটিশদের একটি বড় অংশ দ্বিতীয় দফা গণভোটের দাবি তুলেছেন। জানা যায়, ২৭ জুন সকাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ওয়েব সাইটে ৩০ লাখ মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। এখন নিয়মানুযায়ী বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপিত হবে। লন্ডন, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিক্ষোভ। এ বিক্ষোভ আরো ব্যাপক রূপ ধারণ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলো স্টারজিয়ন ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর বলেন, স্কটল্যান্ড ইইউতে থাকতে চায়। মন্ত্রিসভা ইইউতে থাকার পক্ষে মত দিয়েছে।
ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোর দর পতন হয়েছে। ধস নেমেছে পাউন্ড স্টার্লিংয়ের মূল্যমানে। তিন দশকের মধ্যে পাউন্ডের মূল্য সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে মূল্যমান কমেছে ১১ শতাংশ। ইউরোর বিপরীতেও কমেছে সাত শতাংশ। ১৬ শতাংশ কমেছে জাপানি ইয়েনের বিপরীতে। অন্যদিকে সুইডিশ ক্রোনার ও পোলিশ জিলটির দাম হ্রাস পেয়েছে যথাক্রমে ৫ ও ৩ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের গণভোটের রায় প্রকাশের পর সংবাদ মাধ্যম সমূহের খবর অনুযায়ী গোটা ইউরোপেই কূটনৈতিক কর্মকা- বেড়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি ২৭টি দেশ নিজেদের মধ্যকার ঐক্য ও সংহতি আরো জোরদার করার অঙ্গীকার করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সভাপতি ও মার্টিন শুলজ বলেছেন, যুক্তরাজ্যবিহীন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এগিয়ে নিতে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। যুক্তরাজ্যের এই চলে যাওয়া অর্থনৈতিকভাবে আমাদের তুলনায় তাদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত ও অস্থিতিশীল করবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ডোনাল্ড টুস্ক ২৪ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের পক্ষ থেকে বলেন, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের ফলে ইউনিয়নে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি হবে না। জানা গেছে, জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ জোটকে কীভাবে আরো নাগরিকবান্ধব করা যায় সে বিষয়টিকে প্রধান করণীয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
অন্যদিকে ভিন্ন কথাও শোনা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের দেখাদেখি বাকি ২৭টি দেশের মধ্যে কোনো কোনোটিতে ইইউতে না থাকার পক্ষে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। ডেইলি মেল ও ডেইলি এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, ইইউতে থাকা না থাকা নিয়ে গণভোটের দাবি তুলেছে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক ও সুইডেনের ডানপন্থী দলগুলো। দাবি উঠেছে হাঙ্গেরি, পোলান্ড, চেক রিপাবলিক এবং অস্ট্রিয়াতেও।
যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের ঘটনায় বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে, ইইউতে বাংলাদেশের পণ্যের বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে গার্মেন্টস শিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার ব্রিটেন। এর প্রায় ৪৭ শতাংশ পণ্যের ক্রেতা ব্রিটেন। ব্রেক্সিটের কারণে পোশাক খাতের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ব্রেক্সিটের ফলে ইতোমধ্যে পাউন্ড ও ইউরোর অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে ইউরোপের ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশের রফতানি করা পণ্যের মূল্য বেশি পড়বে। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পণ্যের দাম কমাতে বলা হবে। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ৩২০ কোটি ডলার। এ রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া চিন্তার বিষয়। তদুপরি বাংলাদেশের সব্জি, হিমায়িত মাছ, ফল-ফলাদিরও অনেক বড় বাজার দেশটি। হিমায়িত খাদ্য রফতানিকারকরা মনে করেন, ব্রেক্সিটের ফলে এ খাতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এদিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। সংগঠনটি মনে করে, ব্রেক্সিট-এর ধাক্কা বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার আওতায় পণ্য রফতানি এবং বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের ধারাকে প্রভাবিত করবে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাছাড়া রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের বহু অভিবাসী সমস্যার মধ্যে পড়বেন।
এ গণভোট সম্পর্কে ব্রিটিশ নাগরিকদের কিছু বিক্ষিপ্ত অথচ কৌতূহলোদ্দীপক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। ওয়াশিংটন পোস্টের এক খবরে বলা হয়, ব্রিটিশরা যারা ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন তাদের অনেকেই জানেন না যে কেন তারা ভোট দিয়েছেন। বরং গণভোটের পর বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারে দরপতন ও ভবিষ্যত অর্থনীতিতে আরো ঝুঁকি সৃষ্টি হওয়ার কারণে বহু ব্রিটিশ ভোটার এখন হ্যাঁ ভোট দেয়ার জন্য অনুতাপ করছেন। ইইউ ছাড়ার পরিণতি নিয়ে তারা শুধু বিভ্রান্তই ছিলেন না, বরং অনেকে ইইউ কী বা এর গুরুত্ব কি তাও জানতেন না। এক ব্রিটিশ নারী নিউজ চ্যানেল আইটিভির সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, আমি ইইউ ছাড়ার পক্ষেই ভোট দিয়েছি। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত যে কী ধরনের আঘাত নিয়ে এসেছে তা আমি সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বুঝেছি। দ্বিতীয়বার ভোট দেওয়ার সুযোগ হলে আমি ইইউতে থাকার পক্ষেই ভোট দেব।
এদিকে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী ও বিশ্বসেরা ধনকুবের জর্জ সরোস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ব্রিটিশরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ার কারণে ইইউ জোটের ভাঙ্গন বাস্তবে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ওয়েবসাইটে এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ইইউ ছাড়ার কারণে যুক্তরাজ্য অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো থাকবে কি থাকবে না তার চেয়ে বড় কথা এর ফলে দেশটির অর্থনীতি ও জনগণ স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদের মধ্যেই দুর্ভোগে পড়বে।
বিশ্লেষকরা ইইউ ত্যাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশবাসীর সমর্থনের পিছনে আটটি কারণের কথা বলেছেন। প্রথম হচ্ছে, ব্রেক্সিটের জন্য অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে ইইউ বিরোধী যে প্রচারণা চালানো হয় তার উল্টো ফল ফলেছে। ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে যুক্তরাজ্যের মানুষ আরও গরিব হয়ে যাবে, প্রচারণা পর্বে এমন হুঁশিয়ারি মানুষ ক্রমাগত শুনেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয় মানুষ তা বিশ্বাস করে নি অথবা মনে করেছে সেই ঝুঁকি নিতে তারা প্রস্তুত। দ্বিতীয়ত হচ্ছেস্বাস্থ্যসেবা খাতে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি। ইইউ ত্যাগের পক্ষে ‘লিভ ক্যাম্পেইন’-এর স্লোগান ছিল ইইউ ছাড়লে এখন ইইউকে যে সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড দিতে হচ্ছে সে খরচ বাঁচবে। এ অর্থ স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ করা যাবে। এমন আকর্ষণীয় স্লোগান সব বয়সের, সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে টেনেছে। আর প্রচার বাসে এই স্লোগান ভোটারদের ইইউ ছাড়তে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। তৃতীয়ত হচ্ছে অভিবাসন বিষয় এ গণভোটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছে। অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে ব্রিটেন ব্যর্থ এই অভিযোগ তোলেন ইইউ বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ইউকিপ নেতা নাইজেল ফারাজ। তার অভিবাসন বিরোধী মন্তব্য এই প্রচারণায় ‘লিভ ক্যাম্পেইনের’-এর জন্য হয়ে উঠেছিল তুরুপের তাস। গত ১০ বছরে ব্রিটেনে ব্যাপক সংখ্যায় অভিবাসী আসা নিয়ে উদ্বেগ, সামাজিক জীবনে তাদের প্রভাব এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী বিশ বছরে কী হবেÑএসব তুলে ধরে সফল প্রচার চালিয়েছে ‘লিভ ক্যাম্প’। এর ফলে ইইউ-তে থাকার বিপক্ষে একটা শক্ত জনমত গড়ে তুলতে তারা সফল হয়। চতুর্থত ব্রিটিশ জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয় নি বা তার আহবানে সাড়া দেয় নি। ‘রিমেইন ক্যাম্প’-এ নেতৃত্ব দিয়ে এবং এর মধ্যমণি হয়ে তিনি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও ব্যক্তিগত সম্মানকে বাজি রেখেছিলেন। নয় মাস ধরে তিনি ইইউতে থাকার পক্ষে যে দেন-দরবার চালান, তা অসার বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন তার দলেরই ইইউ বিরোধী সদস্যরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য কেন সুফল বয়ে আনবে, প্রচারণায় তা তিনি বারবার জোরের সঙ্গে তুলে ধরলেও যেসব ভোটার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর কথাকে শেষ পর্যন্ত আমল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পঞ্চমত লেবার পার্টি ইইউর পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও প্রচারণায় ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। তারা ইইউ-তে থাকার পক্ষে যথেষ্ট প্রচার চালায়নি বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। লেবার সমর্থকদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিল ইইউতে থাকার পক্ষে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রচার চালানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায় নি। গর্ডন ব্রাউন, সাদিক খান, অ্যালান জনসনের মতো শীর্ষ লেবার নেতারা যুক্তরাজ্যের ইইউতে থাকার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে কিছু প্রচার চালালেও লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন দলের সমর্থকদের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করতে পারেন নি বলে কিছু মহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে। ষষ্ঠত কনজারভেটিভ পার্টির দুই বড় নেতা লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন এবং বিচারমন্ত্রী মাইকেল গভ এই ব্রেক্সিট শিবিরে যোগ দেওয়ায় ‘লিভ ক্যাম্পেইন’ নতুন মাত্রা পেয়েছিল। জনগণের কাছে মাইকেল গভ-এর আকর্ষণ রয়েছে বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে আর বরিস জনসন হলেন তারকা রাজনীতিক। সপ্তমত বয়স্ক মানুষদের মধ্যে ইইউ ছাড়ার প্রবণতা বেশি থাকায় তারা ইইউ ত্যাগের পক্ষে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের ভোট ‘লিভ ক্যাম্পেইন’কে জয়যুক্ত করতে সাহায্য করেছে। ৬৫ ঊর্ধ্ব ভোটারদের প্রতি ৫ জনের ৩ জনই বলেছেন, তারা ইইউ-তে থাকার বিপক্ষে। অষ্টমত ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কখনই সহজ ছিল না। ইউরোপীয় কমিউনিটিতে যোগ দিতেও ব্রিটেন অনেক বছর সময় নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে যখন এ নিয়ে গণভোট হয়েছিল তখনও অনেকেই এটাকে সমর্থন জানিয়েছিল কিছুটা প্রতিবাদের সঙ্গে এবং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভের আশায়।
২৪ জুন ইরানের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে সাবেক রিগ্যান প্রশাসনের সহকারী অর্থমন্ত্রী ও বিশিষ্ট গ্রন্থকার এবং মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক পল ক্রেইগ রবার্টস বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার কারণে ২৮ জাতির এ জোট ভেঙে যেতে পারে। আর তা হলে আমেরিকার নেতৃত্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করা কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো সম্ভব হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এসোসিয়েট এডিটর ক্রেইগ রবার্টস এ সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মাধ্যমে পুরো বিশ্বের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তিনি বলেন, আশা করা যায়, ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভেঙে যাবে এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটও ভেঙে যেতে পারে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থাকার কারণে ন্যাটো এত শক্তিশালী। ব্রেক্সিটের কারণে এখন ন্যাটোও ভেঙে যেতে পারে। আমেরিকা এই ন্যাটোকে ব্যবহার করেই আফগানিস্তান, লিবিয়া ও ইরাক ধ্বংস করেছে। সিরিয়াকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে এবং ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছিল। একমাত্র ন্যাটোর কারণেই সে এসব করতে সক্ষম হয়েছে ।
কোনো সন্দেহ নেই যে ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগের ঘটনা বিশ্বকে বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। ২৭ জুন পর্যন্ত খবরে জানা যায় যে পাউন্ডের দরপতন অব্যাহত আছে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারেও দরপতন ঘটে চলেছে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে সোমবার ভাষণ দান কালে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন আবার গণভোট অনুষ্ঠান নাকচ করে দিয়েছেন। এখন আসলেই আর দ্বিতীয়বার গণভোট হবে কিনা , যদি হয় আবার ব্রিটেন ইইউতে ফিরে আসে কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
য় লেখক : সাংবাদিক
যথসধযসঁফনফ@ুধযড়ড়.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।