বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন
প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশের ভাষা হিসেবে কান ধরে উঠবোস এক অভিনব সংযোজন। স্থান, কাল, পাত্রভেদে ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধের ভিন্নতা হেতু অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশেও ভিন্নতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং প্রতিবাদের নতুন ভাষা উদ্ভাবনের জন্য হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নিন্দিত না নন্দিত হওয়া উচিত বা সরকার ও প্রশাসন বিষয়টিকে কোন দৃষ্টিতে দেখছে সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, তারা দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী নয় শুধু, খোদ দেশকেও প্রকাশ্যে অপদস্ত ও অপমানিত করে প্রতিশোধ স্পৃহা নিবৃত্ত করলেন। তাদের চেতনার প্রকাশ্য অভিব্যক্তি ‘এদেশে জন্মগ্রহণ করায় যে পাপ হয়েছে, কান ধরে উঠবোস করে তারই প্রায়শ্চিত্ত করা হলো। আইন ও সংবিধান মতে, এটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ধৃষ্টতা কিনা, বা কোনো নাগরিক প্রতিবাদের হেন অধিকার আদৌ রাখেন কিনা, ঘটনার আকস্মিকতায় বিষয়টি যাঁদের বিবেচনায় নেয়ার কথা তাঁরাও তা বেমালুম হয়ে গেলেন যেন। এধরনের নির্লিপ্ততায় সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত এতই উৎসাহিত ও বেপরোয়া হয়ে গেলেন যে, এবার তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নয় বরং, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বসলেন। এরপরও কী কোনো প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান? কাক্সিক্ষত ‘ভোটব্যাংক’ ঠা-া রাখাই যেন একমাত্র কাজ।
রানা বাবুর নজরে বাংলাদেশ কী একটি ব্যর্থরাষ্ট্র? অথবা দুই সরকারের মাঝে কোম্পানি আমলের মতো দ্বৈত শাসনের কোনো গোপন চুক্তির বিষয় সম্পর্কে তিনি জানেন? এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, ‘সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় অন্য দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। তা প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের বিষয়।’ প্রশ্ন হলো, কোনো নাগরিক হেন অধিকার ধারণ করেন কিনা, তা না হলে এ বিষয় কোনো অ্যাকশন নেই কেন? বাংলাদেশ সরকারের অ্যাকশন থাকুক বা নাই থাকুক মোদি বাবু কিন্তু রানা বাবুর আহ্বানে প্রতিক্রিয়া জানাতে ভুল করেননি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় তিনি উদ্বিগ্ন! ভালো কথা, বাংলাদেশ সরকার কি উদ্বিগ্ন ভারতে মুসলমানদের পুড়িয়ে মারা বা ধর্মান্তরিত করণের ব্যাপারে? শুধু তাই নয়, যাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য হেন রূঢ় ভাষা বেছে নেয়া হলো সেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এর থেকে যৎসামান্য সবকও নিতে সমর্থ হয়েছেন এমন কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেল কী? তাই যদি হতো তবে দেশের প্রতি হেন তাচ্ছিল্য ও প্রকাশ্য বিদ্রোহের প্রতিবাদে ১৫ কোটি সন্তানেরই তো রাজপথে নেমে আসার কথা।
ভক্ত বাবুর বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীর অভিযোগ যাই থাকুক তার একটা বা দশটাই ছেঁড়া হোক, একবাক্যে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বলতে গেলে সারা দেশ। ব্যতিক্রম একমাত্র নারায়ণগঞ্জ। যে সভায় সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছিল সেখানে এলাকার গণ্যমান্য অনেক হিন্দুও উপস্থিত ছিলেন বলে প্রকাশ। দেশের সমস্ত মিডিয়া ভক্ত বাবুর একান্ত ভক্তের মতো ঘটনার নিন্দা ও সমালোচনায় এক কণ্ঠ হয়ে গেল। রাষ্ট্র ও প্রশাসনে দশ মাত্রার ভূ-কম্পনের আলামত লক্ষ করা গেল, ফলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে ভক্ত বাবু স্বীয় পদে সসম্মানে পুনর্বহাল হলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের নিমিত্তে তদন্ত কমিটি গঠিত হলো। সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান তীব্র বাক্যবাণে নাস্তানাবুদ হলেন। এতকিছুর পরও ঐক্য পরিষদের মন ভরল না? তাদের ক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহা নিবৃত্তকরণে দেশের হেন অপমান কী একেবারেই অপরিহার্য ছিল? লক্ষ্যণীয় এই ঘটনার দিন কয়েক পরেই সেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আর এক প্রধান শিক্ষক ফারুক আহম্মদকে জুতাপেটা করার অভিযোগ শোনা গেল নবনির্বাচিত কাউন্সিলর বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে। ঐক্য পরিষদ অসাম্প্রদায়িক না হলেও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে গুপ্ত বাবুকে উঠবোস করার কর্মসূচি নিতে বাধ সাধল কে? নীরব মিডিয়া, নীরব মন্ত্রীগণ, চেতনা রহিত এবার প্রশাসনও! কারণটা তাহলে কী? নামটাই সবার ঘুম পাড়িয়ে দিল কী? বছরখানেক আগের কথা। জুমার নামাজে প্রদত্ত খুতবা মহল বিশেষের মনমতো না হওয়ায় ইমাম সাহেবকে কানধরে উঠবোসপূর্বক ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার ঘটনায় আইনের সাশনের দেশে প্রতিক্রিয়ার কিছু টের পাওয়া গেল কী? এমন ঘটনা দু-একটি মিডিয়ায় দায়সারা প্রচার পেলেও তুফান ওঠার আলামত দেখা গেল কী? যেমনটি দেখা গেল ভক্ত বাবুর বেলায়?
‘সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ’ নামটি শ্রুতিকটু, সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের প্রতীক হলেও অভিন্ন স্বার্থে তারা নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষকে (মুসলিম ছাড়া) একই প্লাটফর্মে একত্রিত করতে পেরেছেন যা ভিন্ন বিবেচনায় প্রশংসার দাবিদার। তবে সংখ্যালঘু শব্দটা তারা এখন বাদ দিলেও পারেন এই কারণে যে, শতধা বিভক্ত ৯০ ভাগ সংখ্যাগুরুর মোকাবিলায় তারা এখন এককভাবে সংখ্যাগুরু। বিভাজনের শিকার এই কথিত সংখ্যাগুরুদের অনেকে আবার প্রতিপক্ষকে কাফের বা অমুসলমান বিবেচনায়ও দ্বিধা করে না। সুতরাং ইমাম সাহেবকে কানধরে উঠবোস করানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আগে জানা জরুরি তিনি কোন মাজহাব বা কোন পীরের অনুসারী? জামায়াতি না তাবলিগী, আওয়ামী পন্থী না বিএনপি? ওহাবী না মাজার পন্থী? সুতরাং, দেশের ৯ ভাগ সংখ্যালঘু (কথাটা অনিচ্ছায়ও উচ্চারণ করতে হলো) চাকরি ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ২০ থেকে ৩০ ভাগ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পেছনে ঐক্য পরিষদের অবদান থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এ সত্য অস্বীকার করবে কে যে, বিশেষ সুবিধাভোগী সম্প্রদায় হওয়ার সুবাদে উপজাতিরাই এখন সর্বক্ষেত্রে অগ্রগামী। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলের মতো ৩য়, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলতে এখন কেবলই মুসলমান। বস্তিবাসী, গার্মেন্ট কর্মী, মুটে-মুজুরের কোটার প্রায় শতভাগ একচেটিয়া দখল করে আছে তারাই। অন্যদিকে গুম, খুন, গণগ্রেফতার আর ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলোর ষোলআনা শিকারও তারাই। সুতরাং এ মুহূর্তে সুবিধাবঞ্চিত পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর জন্য সংবিধান প্রদত্ত কোটা সুবিধার ৯৫ ভাগই সংরক্ষণ জরুরি হলেও তাদের পক্ষে এ সত্যটি বলারও কেউ নেই। মানবিক বিবেচনায় সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ তাদের হয়ে যদি এগিয়ে আসত!
নিকট প্রতিবেশী বলে করিম-রহীমে যেমনি মারামারি এমনকি খুনখারাবিও হতে পারে, তেমনি হতে পারে রাম-রহীমেও। কিন্তু রাম-রহীমের ঘটনায় দোষ যারই হোক সংবাদ শিরোনাম হয় ‘সংখ্যালঘু আক্রান্ত’। সংখ্যালঘুর প্রতি বিশেষ দায়িত্ব সচেতনতা ভিন্ন কথা। এতে ন্যায়বিচার ও সত্য চাপা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে প্রবল এই সহজ সরল বিষয়টিও যেন ভাবছেন না কেউ। শুধু তাই নয়, অবচেতন মনে এটি জাতি হিসেবে দেশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ করা ছাড়াও সাম্প্রদায়িক বিভাজন রেখাকেই আরো পুরু ও গভীর করে তুলছে। এ লেখা যখন লিখছি ঠিক সেই সময় পটুয়াখালীতে একদল নরপশু কর্তৃক একই সঙ্গে মা-মেয়ের গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পত্রিকায় শিরোনাম হলো ‘সংখ্যালঘু’ পরিচিতিটাকে প্রাধান্য দিয়ে। শিরোনাম থেকে মনে হয় ধর্ষিতা সংখ্যাগুরু হলে এটা তেমন গুরুতর কিছু ছিল না। কিন্তু মা-মেয়ে একই সাথে ধর্ষণের ঘটনা সংখ্যালঘু হিসেবে প্রথম হলেও সংখ্যাগুরুদের বেলায় এটা প্রথম নয়। মাত্র মাস দুই আগেও এমন পাশবিক ঘটনা ঘটেছে মা-মেয়ের ওপর, কিন্তু সংখ্যাগুরু বলেই যেন মিডিয়ায় ঝড় ওঠেনি। তদন্ত বিচারে বিষয়টি তো সুদূর পরাহত। কারণ, ধর্ষক মাত্রই ক্ষমতাধর ও প্রবল, আর ধর্ষিতা মানেই মজলুম-অসহায়।
স্বামীর সামনে স্ত্রী, দুই বোনকে এক সাথে গণধর্ষণ, ছেলের সামনে মায়ের শ্লীলতাহানির ঘটনা কী করে সম্ভব? ঘটনাস্থল নোয়াখালী হোক বা পটুয়াখালী, নির্যাতনের শিকার নারী হিন্দু না হয় মুসলমান, ধর্ষকদের জাত-পরিচয় আজ সব ঘটনাতেই যে এক ও অভিন্ন এটি কিসের আলামত? ঐক্য পরিষদ না হয় সংখ্যালঘুদের হয়ে ‘কান ধরে উঠবোস’ করার মতো একটা প্রতিবাদী প্রোগ্রাম নিতে পারবে আবারও; কিন্তু সংখ্যাগুরুদের তো কোনো ‘ঐক্য পরিষদ’ নেই। তাহলে তাদের উপায়টা কী?
কিন্তু তাই বলে এই মাটিতে ‘জন্মটাই পাপ’ ঐক্য পরিষদ এমন ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাল কেমন করে? অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালিকাকে জোরপূর্বক বালা-সিঁদুর পরিয়ে বিয়ের নামে পাচারের চেষ্টায় বা নাম-পরিচয় গোপন করে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করার মতো ঘটনায়ও যে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় না, পরিমল জলধর, রতনকুমার, ভজনকুমার, সুভাষচন্দ্র, কিশোর চৌধুরীদের মতো ধর্ষকদের সিরিজ ধর্ষণের ঘটনায়ও যে জামিনে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা মাথাচাড়া দিতে দেখা যায় না, সেই জন্মভূমির প্রতি ঐক্য পরিষদের এত অসহিষ্ণুতা কেন?
ইসলাম, কোরআন ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে দেবব্রত উজ্জ্বল কুমার, দেবনারায়ণ, টুটল রায়, প্রদীপ কুমার ও ভক্ত বাবুদের কটূক্তি আর অশ্লীল বাক্যবাণের বিরামহীন আক্রমণের মুখেও সংখ্যালঘুদের কোনো ধর্মগুরুর প্রতি কটূক্তি বা পাল্টা আক্রমণের ঘটনা যে দেশে ঘটে না সেই দেশ মৃত্তিকার ওপর দায় চাপানোকে সত্যের অপলাপ ও ধৃষ্টতা বলা কী অশোভন হবে? ঐক্য পরিষদ নেতাদের এখানেও কী দ্বিমত পোষণের সুযোগ আছে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক কারো ইসলাম গ্রহণের কথা শোনামাত্র প্রশাসনের মাথায় যেখানে ‘বাজ পড়ে’ আর শুরু হয়ে যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক অথবা পাগল প্রমাণের সব আয়োজন। পরিশেষে চিকিৎসার জন্য ভারত পাঠানো। পক্ষান্তরে মুসলমানদের কেউ ধর্মত্যাগী হলে প্রশাসনের কাছে সবসময়ই স্বাভাবিক ঘটনা। তাহলে প্রকৃত অর্থে সুবিধাভোগী সম্প্রদায় কে? জানতে চাওয়া কী অসঙ্গত হবে, ঐক্য পরিষদের জন্য প্রেসক্লাবের দরজায় তালা দেয়া না হয়ে থাকলে পরিমল জলধর-টুটুল রায়দের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে সমস্যা ছিল কোথায়? বন্ধুরা যখন নিজেরাই সুযোগ করে দিলেন মনের কিছু চাপা ব্যথা বলে দেয়াই শ্রেয় বোধ করছি। পরাগ অপহরণ মামলার অগ্রগতির খবর কী? বিশ্বজিৎ হত্যার প্রতিক্রিয়া জানাতে নেতাদের প্রেসক্লাবে এসে ‘উঠবোস’ করতে দেখা গেল না কেন? পটুয়াখালীতে সংঘটিত পাশবিকতার বিরুদ্ধে আর একটা ‘উঠবোস’ প্রোগ্রাম নেয়া হবে কী? অবশ্যই নয়, কারণ ঘটনাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণে ব্যাংক-বীমা না হয় মেনে নেয়া গেল, কিন্তু ক্রসফায়ার, গুম-খুনের মতো অপরাধের দায়মুক্তিÑএ কোন সংস্কৃতি? ব্লগার অভিজিতের খুনি শরিফুল এবং রিপন চক্রবর্তীর ওপর হামলাকারী ফাহিম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পরও ন্যায়বিচারের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন কী ‘সংখ্যালঘু ঐক্য পরিষদ’? মানবাধিকারকর্মী হিসেবে এবং সংখ্যালঘুদের একজন হিসেবে এ প্রসঙ্গে রানা বাবুর প্রতিক্রিয়া জানাবেন কি?
এবার ভিন্ন পাতায় নজর দেয়া যাক। সংখ্যালঘুদের দ্বারা নিজেদের মন্দিরে আগুন দেয়া, মূর্তি ভাঙার ঘটনার ব্যাখ্যা কী? নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সেবক কর্তৃক মূর্তি ভাঙচুর ও প্রতিমার অলংকার চুরির দায় মুসলমানদের ওপর চাপানোর ঘটনাগুলো কী ঐক্য পরিষদের নজরে পড়েনি? এসব ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া দেখা গেল কী? আমরা এমনটি বলছি না যে, তাদের ভূমি বা বাড়ি দখলের সব অভিযোগই ভুয়া। আমরা এমনটিও মনে করি না যে, নির্যাতনের ঘটনাগুলো সবই বানোয়াট। তাদের ওপর ‘জনম বাকি’ আর চাঁদাবাজদের হয়রানি বা চাপ নেই মোটেও এমনটি আমরা বলছি না। যদিও অভিযোগগুলো কূপের পানি নেয়া বা ‘নিষিদ্ধ খাদ্য’ ভক্ষণের অভিযোগে কাউকেও পুড়িয়ে মারা বা বলপূর্বক ধর্মান্তর করার সমতুল্য নয়। বরং আমরা বিশ্বাস করি যে, ইত্যকার ঘটনাগুলো যতটা না সাম্প্রদায়িক তার চেয়ে ঢের বেশি রাজনৈতিক। খুঁটির জোর ছাড়া জালিম ও নির্যাতক হওয়া যায় না। সুতরাং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ভিন্ন ‘কান ধরে উঠবোস’ সমাধানের কারণ হলে পনের দিনের মাথায় পটুয়াখালীর ঘটনাটি এমন নির্লিপ্তভাবে ঘটতে পারত না। ‘সংখ্যাগুরু’ মা-মেয়েকে নির্যাতনের পরও আইন যাদের টিকিটাও স্পর্শ করতে পারে না সংখ্যালঘুদের বেলায় তাদের হাত আরো লম্বা ও শঙ্কামুক্ত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, নির্যাতক মাত্রই ধর্ম নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক। কারণ সে সংখ্যাগুরু-লঘু চেনে না। তাছাড়া অপকর্ম সামাল দেয়ার স্বার্থে নির্যাতকরা সদা একজোটই নয় শুধু ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্টও। এখন প্রশ্ন, জালিমের মোকাবিলায় মজলুমরাও কী এক জোট? তাহলে সংখ্যাগুরু-লঘু বিভাজন কেন? নজরুল বলেছিলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কা-ারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার!’ বিশ্বজিৎকে রিকশাওয়ালা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তারের জিজ্ঞাসা ‘শিবির কিনা?’ বিষয়টি নিশ্চিত হতে বিলম্বই বিশ্বজিতের মৃত্যু ত্বরান্বিত হওয়ার অন্যতম কারণ। পরাগ অপহরণ ও গুম হওয়ার পর সুরঞ্জিত বাবুর উক্তি ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত।’ এদেশে গুম, খুন বা অপহরণের ঘটনা হিসেবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কী ‘লঘু’দের চেয়ে ভালো অবস্থায়? ডাক্তারের মতোই অপহরণকারীদের জাত পরিচয় জানার পর সুরঞ্জিত বাবুর শঙ্কা একেবারেই কেটে গেলÑ‘পরাগ’ প্রসঙ্গটি তিনি আর কোনোদিন মুখেই আনলেন না। পরাগ অপহরণের বিচার কোনোদিন হবে কী? কবিগুরু বলেছেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় সে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে’; সকল অনুরাগ-বিরাগ, ভয়-সংশয়ের ওপরে ওঠে মজলুম সংখ্যালঘুরা জালিমের বিরুদ্ধে সত্যিকার প্রতিরোধ গড়ার ব্যাপারে কী একমত?
তা হলে ‘সংখ্যালঘু’-‘সংখ্যাগুরু’ বিভাজনের ঊর্ধ্বে ওঠে ‘মজলুম মানুষের ঐক্য পরিষদ’ গড়–ন। তাহলে প্রতিকার পাওয়ার জন্য রাজপথে কান ধরে উঠবোস করার মতো কর্মসূচির প্রয়োজন হবে না। ‘সংখ্যালঘু’ বলে নিজদের পরগাছা ভাবা আদৌ মর্যাদার বিষয় নয়। নিজ দেশে বাঁচুন, ব্যক্তিত্ব নিয়ে বাঁচুন, নিজের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার দায় দেশ মৃত্তিকার ওপর চাপিয়ে আত্মপ্রহসন করা যায়, ব্যক্তিত্ব নিয়ে বাঁচা যায় না। সকল মজলুমকে সাথে নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে আরেকটি কর্মসূচি দিন, মিন মিন করে নয় দৃঢ়তার সাথে, আত্মবিশ্বাসের সাথে একবারই বলুন আমরা কারো পরগাছা নই। রাত পোহালেই দেখবেন সবকিছু ঠিক!
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।