Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্ধলক্ষ হতদরিদ্রের মাথায় হাত

চট্টগ্রামে ‘মাল্টিপারপাসে’ অভিযান ৮ কোটি টাকা জব্দ গ্রেফতার ৩

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিধবা সাবিনা ইয়াসমিন। দুই শিশু কন্যা নিয়ে অভাব-অনটনে কাটছে দিন। এক কক্ষের একটি ঘরে খালার সাথে সাবলেট থাকেন। কাপড় সেলাই করে যা পান তাতেই টেনেটুনে চলে সংসার। এরপরও দুই কন্যার ভবিষ্যত চিন্তা করে মাসে তিন হাজার টাকা করে জমা করেছিলেন। এক বছরে ৩৬ হাজার টাকা জমা করেন তিনি। সুদসহ টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এরমধ্যে পুলিশি অভিযানের খবর পেয়ে জমা বই নিয়ে ছুটেন ‘রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে’।

তার মত হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষ কথিত এ মাল্টিপারপাস প্রতিষ্ঠানে ভিড় করছে। তারা লাভের আশায় কষ্টে অর্জিত টাকা জমা করেছিলেন ওই কোম্পানিতে। এখন লাভ তো দূরের কথা মূল টাকা ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়েই দুশ্চিন্তা আর নানান শঙ্কা প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের মাথায় হাত। চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড মোড়ের চৌধুরী ভবনে গত ৫ বছর ধরে কথিত ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে গ্রাহক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েকশ কোটি টাকা জমা করেছেন।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আকস্মিক ভবনটি ঘেরাও করে অভিযান চালায় পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) একটি দল চট্টগ্রাম নগর পুলিশের সহযোগিতায় ভোর রাত পর্যন্ত টানা অভিযানে সেখান থেকে নগদ সাড়ে ৮ কোটি টাকা জব্দ করে। গ্রেফতার করা হয় কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান মো. রাসেল হাওলাদার (৩৫), প্রকল্প পরিচালক মুসা হাওলাদার (৪০) ও ম্যানেজার মো. ফয়সাল (৩০)কে। পলাতক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার।

অভিযানের খবর পেয়ে হাজার হাজার গ্রাহক সেখানে জড়ো হন। জমানো টাকা ফেরত পেতে ভিড় করেন অফিসে। তবে কর্মকর্তাদের কেউ না থাকায় হতাশ হন গ্রাহকেরা। ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর নুরুল হুদা ইনকিলাবকে বলেন, বিগত ২০১৭ সালের একটি মামলায় ডিএমপির ডিবি পুলিশ প্রতিষ্ঠানটিতে অভিযান চালায়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিন ব্যক্তি তিন কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা করেছিলেন। ওই মামলার ভিত্তিতে অভিযান চালাতে এসে রূপসা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অফিসে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা পাওয়া যায়। এ নগদ টাকা ইপিজেড থানার হেফাজতে রেখে তিন আসামিকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

ওসি জানান, অভিযানের খবর পেয়ে হাজার হাজার গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটিতে ভিড় করছে। তারা এখন তাদের জমানো টাকা আদৌ ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত। তবে এ বিষয়ে থানায় কেউ কোন অভিযোগ করেনি। গতকাল দুপুরে রূপসা ফাউন্ডেশনের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শত শত গ্রাহকের ভিড়, আহাজারি। সবার হাতে ছিল জমা বই। অফিসে কয়েকজন স্টাফ ছাড়া কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। গ্রাহকেরা তাদের জমানো টাকা ফেরত চান। তবে এসব কর্মীরা কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।

নগরীর আকমল আলী এলাকার রিকশাচালক কামাল উদ্দিন এবং তার স্ত্রী ময়না বেগম সেখানে মাসে তিন হাজার টাকা করে জমা করেছেন। বছর শেষে তাদের জমা টাকা এবং প্রতি হাজারে ৯৬০ টাকা করে লাভ দেয়ার কথা। কিন্তু এখন মূল টাকা পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত এ দম্পতি। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হতদরিদ্র কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, দিনরাত রিকশা চালিয়ে না খেয়ে টাকা জমা করেছি। লাভের দরকার নেই, আমি আমার টাকা ফেরত চাই। একই দাবি জানালেন, সবজি চাষী যুবক শামীম। পতেঙ্গার মাইজপাড়া এলাকায় সবজি চাষ করে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে জমা করেছেন তিনি। এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।

গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জমানো টাকার উপর লাখে ২০ হাজার সুদ দেয়ার প্রলোভন দিয়ে গণহারে গ্রাহক সংগ্রহ করা হয়। চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার শ্রমিকদের বিরাট অংশ এখানে টাকা জমা করেছেন। এর পাশাপাশি ওই এলাকার হতদরিদ্র রিকশাচালক, দিনমজুর এবং খেটে খাওয়া মানুষ জীবনের সঞ্চয় জমা করেন এ কোম্পানিতে। প্রতিষ্ঠানটির অফিসের আশপাশে রূপসা কিং গ্রæপ নাম দিয়ে বেশ কয়টি প্রকল্পের সাইনবোর্ড ঝুলানো হয়েছে। গ্রাহকের টাকা নিয়ে এসব প্রকল্প চলছে জানিয়ে সেখান থেকে তাদের লাভের টাকা দেয়া হবে বলে প্রলোভন দেখানো হয়।
গ্রাহকরা জানান, তারা প্রতিষ্ঠানটির কথা বিশ্বাস করে টাকা জমা করেছেন। প্রতারিত হবেন এমনটা ভাবতেও পারেনি। অনেকে ইতোমধ্যে লাভের টাকা পেয়েছেন। তবে হঠাৎ করে একটি মামলায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার এবং সেখান থেকে নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন তারা। আদৌ এ টাকা ফেরত পাবেন কিনা কিংবা তাদের আমানত গচ্ছিত আছে কিনা সেটাও তাদের অজানা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীতে মাল্টিপারপাস ব্যবসার নামে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত। কিছু গ্রাহক দাবি করেছেন, তারা লাভের টাকা পেয়েছেন। তবে এ ঘটনার পর সবাই শঙ্কিত। গ্রাহকদের অভিযোগ পেলে বিষয়টি তদন্ত করবেন বলেও জানান নগর পুলিশের কর্মকর্তারা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ