মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
আকাশ ইকবাল
ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা চাই? এটা আবার কেমন ব্যাপার! দৌড় প্রতিযোগিতা, নাচ-গান, রচনা প্রতিযোগিতা খুব বড় জোর পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার প্রতিযোগিতার কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতার কথা তো কখনো শুনিনি! ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা কেন? ইতিহাসে যেসব বড় বড় মানুষেরা আছেন তারা কি সবাই ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা করেছিলেন? “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হইয়া চলি” এটাওকি ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতার জন্য? আমাদের চারপাশটা একটু খেয়াল করলেই এই উত্তরটা পাওয়া যাবে। এখন চারদিকে শুধু প্রতিযোগিতা চলছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতা, সেরা মডেল, সেরা গায়ক হওয়ার প্রতিযোগিতা। কার চেয়ে কে কত টাকা বানাতে পারে সে প্রতিযোগিতা। শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতার ধরন এখন বলতে গেলে আগের থেকে অনেক বদলে গেছে। বলা ভালো, আয়োজন করে বদলে ফেলা হয়েছে।
এখন কিশোরদের আলোচনার বিষয় হলো ক্লোজ আপ ওয়ান এর সম্ভাব্য বিজয়ী কে হতে পারে বা হলিউড-বলিউডের সাম্প্রতিক ছবির হিটলিস্ট কী? প্রতিযোগিতা চলতে থাকে কার থেকে কে বেশি হিন্দি সিনেমার গান গাইতে পারে। খোলা মাঠের খেলাধুলা আর সুস্থ-নির্মল আনন্দের পরিবর্তে শিশু-কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিডিও গেমস আর মোবাইল, টিভি চ্যানেলের অসুস্থ সব বিজ্ঞাপন ও ছবি। একা একা খেতে চাও তবে দরজা বন্ধ করে খাও এমন বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধুবৎসল শিশুদের কোমল মনকে চূড়ান্ত রকমের স্বার্থপরতার শিক্ষাই দিচ্ছে। শুধু নিজের কথাই ভাবার এই শিক্ষা তাদেরকে ভয়ঙ্কর জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তারই এক উদাহরণ পাওয়া যায় গত ২ বছর আগে ঐশী নামের এক কিশোরীর মাদকের টাকা না পেয়ে তার বাবা-মাকে হত্যার ঘটনা থেকে।
এক সময় ছেলেমেয়েরা অনুসরণ করত বড় মানুষদের চরিত্র। যেমন, ইশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের চাদর কিংবা রবীন্দ্রনাথের দাড়ি-গোঁফ রাখার প্রতিযোগিতা। কিন্তু আজকের দিনে তা কি হয়। এখন কার ছেলেরা অনুসরণ করে মেসি কিংবা নেইমারের চুল রাখার ধরন। আগে স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তিন গোয়েন্দার বই কিংবা শখের স্ট্যাম্প কেনার প্রতিযোগিতা হতো আর এখন টাকা জমানোর প্রতিযোগিতা চলে ভিডিও গেমস খেলা কিংবা অলিগলিতে সহজলভ্য পর্ণ, পত্রিকা আর সিডি কেনার জন্য। টাকা কামানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কোম্পানিগুলো টিভি, প্রত্রিকার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমন প্রভাব বিস্তার করছে এখন স্কুল ছাত্রদেরও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল। বিশেষজ্ঞদের মতে, কিশোর-তরুণদের মোবাইল ব্যবহার করার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে অশ্লীল ম্যাসেজ আর পর্ণ ক্লিপসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে। কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন আর পর্ণগ্রাফির কল্যাণে এখন ছেলেমেয়ে পরস্পর পরস্পর সম্পর্কে লালন করে এক ধরনের বিকৃত অসুস্থ মানসিকতা। অন্যদিকে শিক্ষা-সংস্কৃতি-ব্যক্তিত্ব সমস্ত কিছুকে এড়িয়ে গায়ের রং আর বাইরের সৌর্ন্দয্যই যে মেয়েদের একমাত্র যোগ্যতা, বিউটি ক্রিমের এই ধরনের বিজ্ঞাপনের কল্যাণে এখন ছোট বেলা থেকে কিশোরীদের মনে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে কী করে নিজেকে আরো সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায়। অভিভাবকরাও পাল্লা দিয়ে নিজের মেয়েকে সুন্দরী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকেন। গত কয়েক বছর আগে একটি খবর বের হয়- এক জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটেনের শিশুরা ব্রিটেনি স্পিয়ার্স এর মতো গায়িকা কিংবা বেক হামের মতো তারকা ফুটবলার হতে চায়। কিন্তু কোন শিশু বলেনি বড় হয়ে শেক্সপিয়ারের মতো বড় সাহিত্যিক বা আইনস্টাইনের মতো বড় বিজ্ঞানী হবো। এটা শুধু ব্রিটেনের চিত্র নয়। এটা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোতে একই অবস্থা। যা আমাদের বাংলাদেশেরও অবস্থা। কিছুদিন আগে এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? সে উত্তরে বলে, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। আমি বললাম, কেন ডাক্তার হওয়া ছাড়া আর কি কোন কিছু হতে পারবে না? সে আমাকে বলে, আর অন্য কিছুতে কি টাকা আছে? এতেই বুঝতে পারা যায় যে, খুব সহজে আমাদের কমল মতি শিশুরাও এখন টাকা কীভাবে আয় করা যায় তার চিন্তা করছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের বিশ্ব জোয়ারে শিশু-কিশোরদেরও এখন অন্যতম আলোচ্য বিষয় রোনালদো, রোনালদিনহো, নেইমার আর সবার আগে মেসি। অথচ মজার ব্যাপার হলো আর্জেন্টিনা সেরা না ব্রাজিল এই তীব্র যুদ্ধে অগ্রনী এইসব কিশোরদের ফুটবল কেমন খেলে জানতে চাওয়া হলে বলবে ভিডিও গেমস এ খেলেছে অথবা টিভিতে দেখেছে। ফ্ল্যাট বাড়ি স্কুল পরিবেশে বড় হওয়া এইসব শিশু-কিশোরদের মাঠ হচ্ছে কম্পিউটার মনিটর আর ফুটবলের অস্ত্র ভিডিও গেমসের বাটন। ম্যারাডোনা-পেলেদের নিয়ে গর্ব করলেও এরা জানেই না যে জীবনের সাথে কত কষ্টকর লড়াই করে ম্যারাডোনা-পেলেরা জুতা পালিশ করা ছেলে থেকে আজকের এই বিশ্ব তারকা হয়েছে। কারণ প্রচার মাধ্যমগুলোতে তাদের জীবনের এইসব দিককে আড়াল করে শুধুমাত্র তারকা খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার বিজ্ঞাপন বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা চলছে। তাই সুন্দর দিকগুলোর পাশাপাশি তাদের জীবনের এই ভালো দিকগুলোকে কাজে লাগানোর সুযোগ এই প্রজন্মকে দেয়া হচ্ছে না।
এত কিছুর পরও অদ্ভুত আমাদের অভিভাবকদের আচরণ। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ অথবা ‘শুধু নিজের টা ভাবে’। এইসব বাক্য মাথায় বদ্ধমূল করেই তারা নিজেদের সন্তানদের মানুষ করার মরিয়া চেষ্টা করেন। ক্লাসে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতাটি হলো এখনকার মা-বাবাদের কাছে একমাত্র অনুমোদনযোগ্য ব্যাপার। চারপাশে সমস্যা সংকট নিয়ে যাতে সন্তানরা ভাবতে না পারে, মাথা না ঘামাতে পারে এই ব্যাপারে তারা সদা সতর্ক। ছোট থেকে ছেলেমেয়েদের একটা কথা শুনাতে থাকেন ‘এত কষ্ট করে টাকা-পয়সা খরচ করে তোমাদের মানুষ করছি কি অন্যদের কথা ভাবার জন্য?’ শুধু আমাদের কথা ভাবা ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবতে পারবে না। আর যদি রাজনীতি বা সমাজ নিয়ে ভাবার কথা আসে ‘ঘরে খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর দরকার নেই’? অথচ আমাদের পড়াশুনা করার জন্য স্কুল-কলেজ নির্মাণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন প্রতিটি প্রয়োজন মেটানোর জন্যই যে আশা নিয়ে আমরা সমাজের কাছে কোনো না কোনো ভাবে ঋণী সেটা শিশু-কিশোরদের বুঝতেই দেয়া হয় না। দেশের অর্থনৈতির অপরিহার্য কারিগর হাজার হাজার শ্রমিক যখন নিজেদের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থানের জন্য বিদ্রোহ করে, ঈদের দিনে শ্রমিকদের যে বাড়ি এসে সবার সাথে আনন্দ-উল্লাস করবে কিন্তু শ্রমিকরা সেই ঈদের দিনেও ঢাকা শহরে তাদের মুজুরি আদায়ের জন্য আন্দোলন করে আসছে অথবা দেশের মানুষের অন্নের সংস্থান করতে গিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কৃষক যখন নিজের অন্নের জন্য হাহাকার করে মরে, তখন ছাত্রদের বোঝানো হয় ‘এইসব বিষয় নিয়ে ভাববার বিষয় নয় তোমাদের, তোমরা শুধু পড়ালেখা করবে’। অথচ শ্রমিক, কৃষক থেকে শুরু করে সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের করের টাকা দিয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বা হাসপাতাল নির্মাণ করা না হলে কারো বাবা-মায়ের সাধ্য নেই এককভাবে এসব নির্মাণ করে সন্তানের পড়াশোনা বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করাÑ এই সহজ কথাটাই শিশুদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা হয় নানা কথার মারপ্যাঁচে।
একসময় মানুষের জীবনের লক্ষ্যে থাকতো মানুষের মতো মানুষ হওয়া। ছোট শিশুদের মানুষ শুভ কামনা জানাতো ‘মানুষ হও, অনেক বড় হও’। বাবা-মায়ের চিন্তার বিষয় থাকতো সন্তানকে মানুষ করতে পারবো তো। ‘সৎ পথে চলবে, সত্য কথা বলবে, আর্তের সেবা করবে, অসহায়ের পাশে দাড়াবে’ এগুলো ছিল জীবন চলার পথে মানুষের জন্য অনুসরণীয় পথ। কিন্তু এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয় অনেক বড় হতে হবেÑ তবে সেটা মানুষ হিসেবে মানবিকতা নিয়ে নয়। বাবা-মায়েরাও তাই সন্তানদের এভাবে মানুষ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। স্কুল পড়ার টেবিল আর স্যারের বাসা, ক্লাসে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগিতা এর বাইরে কিছু যেন ভাবতে পারেন না। অথচ যে রাজনীতি করার জন্য বাবা-মায়েরা নিষেধ করে থাকেন সে রাজনীতি তাকে পরিচালনা করে থাকে। সে রাজনীতি তার জীবন গড়ে থাকে। সে রাজনীতি সে কতটুকু পড়ালিখা করবে সে আজ খাবে না পড়বে। এবং সে যে পড়ে বড় লোক হবে সেই বই নির্ধারণ করে থাকে রাজনীতি। পাড়া বা মহল্লায় কনসার্ট বা সংগীতানুষ্ঠান হলে সেখানে যেতে দেয়া হয় কিন্তু বন্যা-মঙ্গার জন্য বন্ধুরা মিলে ত্রাণ সংগ্রহ করার মতো ‘অকাজে’ অনুমোতি দেয়া হয় না। সেই জন্য বলছি, ভালো হওয়ার জন্য যদি একটা প্রতিযোগিতা দেয়া হতো তাহলেই ভালো হতো। অন্তত প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জনের জন্যে হলেও মানুষ ভালো হওয়ার প্রতিযোগিতা করত। নীতি-নৈতিকতা, সুস্থ রুচি, মূল্যবোধ নিয়ে শিশু-কিশোররা বড় মানুষ, মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতো।
অন্ধকারে থেকেও মানুষ আলোর স্বপ্ন দেখে। আশা রাখে। আমরাও স্বপ্ন দেখি। তাই বলছি, শিশুদের যা করতে ইচ্ছে হয় তা করার সুযোগ দিন। তাদের বড় মানুষ হওয়ার সুযোগ দিন। যারা পৃথিবীকে জয় করবে মানবিকতা দিয়ে, মনুষ্যত্ব দিয়ে, মানুষের জন্য তাদের ভালোবাসা দিয়ে।
ষ লেখক : সংবাদ কর্মী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।