বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সবার সাথে মিলে ইমাম বুখারি রহ. এর কবর জিয়ারত শেষ করে যখনই চত্বরের এপাশ থেকে ওপাশে যেতে শুরু করেছি, তখন একজন গাইড বললেন, শাইখ, বিশেষ মেহমানদের জন্য এখন মূল কবরের কাছে যাওয়ার ‘তেহ্খানা’ খুলে দেয়া হবে। এবার সেখানে যাওয়া হবে কি না, সে নিয়ে আমি ভাবছিলাম।
এরই মধ্যে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সুরম্য সমাধি ভবনের একপাশে নেমে যাওয়া সিঁড়ির মুখ খুলে দিলেন। চেইন সরিয়ে হাত ইশারায় রাস্তা খালি করে ফেললেন তারা। একতলা নিচে মূল মাটির কবর। সেটিও স্থাপনাকেন্দ্রিক। তবে, উপরের মাজারটি পুরোই রেপ্লিকা। কিছুদিন আগে আল্লামা মুফতি তকী উসমানী এই তেহখানায় দাঁড়িয়ে বুখারি শরীফের কিছু অংশ তেলাওয়াত করে গেছেন। মাসখানেক পর আমাদের এই সফর হয়। এখানে অত্যন্ত আত্মিক পরিবেশে বিশেষ মনোসংযোগসহ কবর জিয়ারত করি।
এরপর আবার কমপ্লেক্সে ঘুরে বেড়াই। কিছু পেশাদার ফটোগ্রাফার নানা এঙ্গেলে পর্যটকদের ছবি তুলে। স্ক্রিনে দেখিয়ে বলে টাকা দিতে। দ্ইু মিনিটের মধ্যে তারা প্রিন্ট করে দেবে। দুনিয়ার নানা দেশ থেকে আগত পর্যটকরা ছবি সংগ্রহ করে নেয়। বিখ্যাত এই ইমামের স্মৃতি বিজড়িত কমপ্লেক্সের অসাধারণ ভবন, সৌধ, মিনার, মসজিদ, বাগান, ফোয়ারা, ফটক যে ছবিতে অপূর্ব লাগে। আমরা ছবিকে নিরুৎসাহিত করি। ছবি গুনাহের কাজ। অপারগ হয়ে অনেক সময় তোলা হয়।
শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজন হলে গুনাহ নাও হতে পারে। এমনিতে গুনাহ হয় বিশ্বাস করে যদি কখনো তুলি তাহলে তওবা-এস্তেগফার করতে থাকি। অকারণে তুললেও গুনাহ জেনেই তুলতে হবে। পেশাদারদের অফার গ্রহণ করিনি। বোখারা সমরকন্দের গ্রান্ড মুফতি ও ইমামগণের পোষাক ও তুর্কি টুপিতে নানা দৃশ্যপটে চিত্রগ্রাহকরা বিনা অনুমতিতেই আমাকে বহুবার বন্দি করেছে। খুব লোভ দেখাচ্ছিল তারা। ভুলভাল ইংলিশে বলেই চলছিল, শাইখ দেখুন কত সুন্দর ছবি। আমি বললাম, তোমরা রেখে দাও।
শেষ পর্যন্ত সফর সঙ্গীদের কেউ কেউ কিছু ছবি নিজেরা প্রিন্ট করে নিলেন। এক/দুই ডলার করে পোস্টার সাইজ ছবি। বিদায়ের সময় এক চিত্রগ্রাহক দৌড়ে এসে বিনে পয়সায় আমাকে আমার একটি ছবি দিয়ে যায়। বলে, আপনার কয়েকটি ছবি আমরা বিদেশিদের কাছে ভালো দামে বিক্রি করেছি। গাইড বললো, এ স্থাপনা, ঐতিহ্য ও পরিবেশের সাথে শোভনীয় আপনার ছবি তারা আকর্ষণীয় দৃশ্য হিসাবে আরও বিক্রি করতে থাকবে।
মহান ইমামের নাম মোহাম্মাদ। উপনাম আবু আব্দুল্লাহ। পিতা ইসমাইল। তিনি ১৯৪ হিজরীতে বোখারায় জন্মগ্রহণ করেন। ২৫৬ হিজরীতে মৃত্যু হয় সমরকন্দে। যেখানে এখন তার কবর। তার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন ইয়ামেন থেকে। তাকে যু’ফী বলা হয়। কারণ, এটি তার ইয়ামনী বংশ। একসময় পরদাদারা পারস্যে চলে আসেন। ‘বর দিজবাহ’ তার ইরানী সূত্র। বোখারায় এসেছিলেন তার দাদা। বোখারা তখন মধ্য এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নগরী। বাল্যকালে ইমাম বুখারী এতিম হয়ে যান। তার মা তাকে লালন পালন করেন। একসময় বালক বুখারী অন্ধ হয়ে যায়।
মা ছিলেন আল্লাহর ইবাদতগুজার বান্দি। ছেলের জন্য রোজা রাখতে শুরু করেন। ৪০তম রোজার শেষরাত্রে নবী করিম সা. কে স্বপ্নে দেখতে পান। নবীজি বলছেন তোমার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। তোমার ছেলের চোখ ভালো হয়ে গেছে। আর তাকে অসামান্য স্মৃতি শক্তি দেয়া হয়েছে। তার দ্বারা মহান রাব্বুল আলামীন আমার সুন্নাহ হেফাজতের বিশাল কাজ সম্পাদন করাবেন। ঘুম থেকে উঠে ইমাম বুখারীর মা দেখতে সত্যিই তার ছেলে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়েছে।
আমার জানামতে পৃথিবীতে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি চাঁদের আলোতে গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ ছিল তার নতুন পাওয়া দৃষ্টি শক্তির প্রখরতা। আর স্মৃতি শক্তির কথা কী বলব। বড় হয়ে গোটা মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করে তিনি ১২ লক্ষ হাদিস শুনতে পান। তার বাছাইনীতি অনুসারে এর সোয়া লক্ষ সহীহ। যার মধ্যে শব্দ, প্রতিশব্দ, বর্ণনাকারী বা অন্য কোনো ভিন্নতার কারণে কোনো কোনো হাদিসের দ্বিরুক্তিসহ ৭ হাজারের কিছু বেশি আর দ্বিরুক্তি বাদ দিলে নির্জলা ৪ হাজারের কিছু বেশি হাদিস তিনি তার জগদ্বিখ্যাত কিতাব বোখারী শরিফে সংকলন করেছেন।
যার পোশাকি নাম ‘আল জামেউস সহীহ লিল ইমাম আল বোখারী’। বিস্তারিত নাম আরও দীর্ঘ। যে হাদীসটি একবার শুনেছেন, ৩০ কি ৪০ বছর পরেও লিপিকারদের সাহায্যে তা হুবহু লিখিয়ে নিয়েছেন। বর্ণনাকারীর দাড়ি, কমা, সেমিকোলন, ভাব, অভিব্যক্তি, শ্বাস, প্রশ্বাসসহ সব ছিল তার স্মৃতির দর্পণে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।